X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিব-অপুর ঘটনা এবং নারীর শিক্ষা

লীনা পারভীন
১২ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:৩২আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:৩৭

লীনা পারভীন প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে এই বিষয়গুলো নতুন কিছু নয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই সৌন্দর্য নিহিত আছে এই নারী-পুরুষের সম্পর্কের মাঝে। এই সৌন্দর্যে পাগল হয়েই তৈরি হয় গান, কবিতা, সাহিত্য। জগতের যত নান্দনিক সৃষ্টি আছে তার বেশিরভাগই আবর্তিত হয়েছে প্রেম থেকে। প্রেমে পড়লে মানুষ নাকি সবকিছুকে সুন্দর দেখে, চারদিকে তার কাছে কেমন প্রেমময় লাগে। ঘোর কাজ করে প্রেমকে ঘিরে। প্রেমকে বলা হয় স্বর্গীয়। স্বর্গ দেখতে কেমন তা আমরা না দেখলেও কল্পনায় তার একটি সুখের চেহারা এঁকে রাখি।
আচ্ছা, প্রেম কি বলে কয়ে আসে? কেউ কি রুটিন করে ভালোবাসে? কেউ কি আগে থেকেই জানে যে সে কার প্রেমে পড়বে?
মূল কথায় আসি। গত দুইদিনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নায়ক শাকিব খান ও নায়িকা অপু বিশ্বাসের বিয়ে, বাচ্চা এবং সম্পর্কের স্বীকৃতি। এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি অনেক। সমাজের আনাচে-কানাচে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। পার্থক্য হচ্ছে আজকাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকের কল্যাণে এইসব খবর দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
আগের অনেক ঘটনারি প্রতিবাদ হয়নি কিছুটা অজানা থাকার কারণেও। কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছি আমরা। এমনকি সু-বিচার পেতেও সহায়তা করছে এসব প্রতিবাদ।

সেলিব্রিটিদের জীবনে এইসব ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। এমনকি সমাজের উঁচুতলার লোকেদের কাছেও আজকাল আর বিয়ে, সন্তান, সম্পর্ক, বিশ্বাস, আস্থা, প্রতিজ্ঞা কোনোটাই কিছু না। আগেরকালে এমন কিছু ঘটলে আমরা খুব একটা কান দিতাম না। ধরে নিতাম এসব তাদের নিজেদের ব্যাপার। বেহায়া লোকদের কাণ্ডকারখানা। সমাজে এমনি প্রচলিত ধারণা। যারা প্রেম করে একজনের সঙ্গে আবার বিয়ে করে আরেকজনকে বা বিয়ের পরেও যদি কেউ কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তবে তাদেরকে আমাদের সমাজে একপ্রকার খারাপ মানুষ বলেই ধরে নেওয়া হয়। একটা সম্পর্কে গভীরতা দিয়ে বিবেচনা না করার কারণেই মূলত আমাদের মাঝে এই ধারণার জন্ম।

কিন্তু বাস্তবে আমরা যেসব দেখি সেগুলো হচ্ছে যে কোনও ঘটনার ওপরের দিকের ফল। বিশেষ করে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি খুব টিপিক্যাল। একদম সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা দেখতে চাই সবকিছু। আসলেই কি তাই? মানুষের সম্পর্কের বিষয়টা কি এত সহজ? এককথায় কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় কি? একটা সম্পর্কের ভিত্তি কি থাকে? সেখানে কি স্টপওয়াচ দিয়ে চর্চা করা যায়? উত্তর হচ্ছে- না।

সম্পর্ক সে নারী-নারী, পুরুষ-পুরুষ বা নারী-পুরুষ যাদের মধ্যেই হোক না কেন, তার ভিত্তি থাকতে হয় পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস, ভরসা। যার ভিত্তিতেই একে অপরের কাছে আসে, নিজেকে বিলিয়ে দেয় একে অন্যের মাঝে। সমর্পিত হয়। এখানে ট্রাফিকের কাজ করে ব্যক্তির নিজস্ব মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা ইত্যাদি।

কিছুদিন আগেই আমাদের আলোচনায় ছিল ক্রিকেটার রুবেল আর হ্যাপির সম্পর্কের বিষয়টি। এ নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। তারপর এলো আরেক ক্রিকেটার আরাফাত সানি। সেও এক মেয়েকে বিয়ে করে স্বীকার করছিল না। আমাদের শিক্ষিত সমাজ ব্যস্ত ছিলাম সেসব ঘটনার কিছু আলোচনা-সমালোচনা করা নিয়ে। হামলা-মামলা করে ফলাফল কী এলো আর কে কী পেলো সেসব পরের কথা। কিন্তু একটা জায়গা আমরা আলোচনায় আনি না আর সেটা হচ্ছে- মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তি আসলে কোথায়? কেন দুইজন মানুষ একে অপরের কাছে আসে? হতে পারে সেটা কেবলি জাগতিক কোনও প্রয়োজনে আবার হতে পারে দুজন মানুষের মধ্যে একধরনের মতের মিলের কারণে। সম্পর্কের মাত্রা যাই হোক না কেন, প্রতিটা সম্পর্কের মাঝেই আছে কোনও না কোনও কারণ। কিন্তু প্রতিটা ঘটনারই ভিকটিম কেন নারী?

এই মুহূর্তে আমাদের আলোচ্য বিষয় শাকিব খান আর অপু বিশ্বাসের সম্পর্ক এবং তাদের সন্তান। ঘটনাটি খেয়াল করে দেখবেন এর ভেতরে অনেকগুলো বিষয় আছে যেগুলো হতে পারে অন্যদের জন্য খুব শিক্ষণীয়।

শাকিব খান যেমন একজন ‘হিট নায়ক’ ঠিক তেমনি অপু বিশ্বাসও ‘হিট নায়িকা’। দুজনের জনপ্রিয়তা কারও চেয়ে কারও কম নয়। তার মানে দুটি সমান ক্ষমতাধর ব্যক্তির মধ্যেই সম্পর্ক হয়েছিলো। জানি না এর পেছনে কতটা প্রকৃত প্রেম ছিল আর কতটা সাময়িক মোহ ছিল বা কতটা উদ্দেশ্যমূলক ছিল। উদ্দেশ্য যাই থাকুক, দুজনেই কাছে এসেছিলো, বিয়ে করেছিলো। পরে একটি সন্তান জন্ম নিয়েছিলো। তাহলে প্রশ্ন জাগে, কেন শাকিব খান অপুকে সামনে আসতে দিচ্ছিলেন না? কেন একটি সন্তানের জন্ম হওয়ার পরও শাকিব সেটা স্বীকৃতি দিতে চাইছিলো না?

খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, শাকিব খান চাননি নিজের ক্যারিয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। কারণ তার ধারণা ছিল ভক্তরা একজন বিবাহিত নায়ককে আর মেনে নেবে না। অর্থাৎ সে ‘ভার্জিন’ হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে বাজার ধরে রাখতে চেয়েছে। অন্যদিকে অপুর ক্যারিয়ারেও কিন্তু বিবাহ একটি ফ্যাক্ট হওয়ার কথা। প্রচলিত অর্থে একজন বিবাহিত নারীকেও কিন্তু তার দর্শকরা গ্রহণ করার কথা নয়। কিন্তু অপু কী অবলীলায় নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়ে শাকিবের ক্যারিয়ারকে সামনে নেওয়ায় সহায়তা করে গেছেন। সন্তান জন্ম দিয়েও থেকেছে সবার আড়ালে। এখানে শাকিব খান একজন পিতার সম্মানকেও বিসর্জন দিয়েছে।

ঠিক যখন অপু সামনে এলো তখন শুরুতে অস্বীকার করলো অপুকে স্বীকার করতে। একদিকে একজন নায়িকার ক্যারিয়ার ক্ষতির জন্য সে দায়ী আবার অন্যদিকে একজন নারীকে তার যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে সে পিছু হটলো। কিন্তু কেন? বাস্তবে শাকিব ভালোবাসেনি অপুকে। সাময়িক মোহে শাকিব বিয়ে করতে অপুকে বাধ্য করেছিল হয়তো! মোহ কেটে গেছে ভেবেছিলো এমন করেই যদি দিন কাটে তো ক্ষতি কী? সমাজের চোখে অবিবাহিত থেকেও বিবাহিত জীবন কাটানোর মজা কয়জন পায়?

ধিক! সেই পুরুষকে, যে নিজের লালসার জন্য একজন প্রতিষ্ঠিত নারীকে তার শিকার বানায়। খেয়াল করে দেখবেন, এমন পুরুষ আমাদের সমাজে অনেক আছে, যারা নারীর ভালোবাসায় মজে কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়া বা পরবর্তীতে সে সম্পর্ককে টেনে নেওয়ার বেলায় থাকে দ্বিধাগ্রস্ত। না পারে ধরতে, না পারে ছাড়তে। এরকম চরিত্রের পুরুষদের ধরে ধরে শাস্তি দেওয়ার বিধান জারি করা দরকার। একজন নারীকে তার লালসা পূরণের খেলনায় পরিণত করার দায়ে সে অবশ্যই দায়ী। আবেগের সঙ্গে প্রতারণাকে আমি কোনও অংশেই অন্যান্য প্রতারণার থেকে আলাদা মনে করি না। নিজেকে অবিবাহিত হিসাবে দেখিয়ে আরো অনেক মেয়েকে নিজের শিকার বানানোটা অনেক পুরুষেরই চরিত্রে থাকে। সেসব পুরুষদেরকে চিহ্নিত করার দিন এসেছে।

একজন প্রকৃত প্রেমিক বা স্বামী কখনও তার প্রেমিকা বা জীবনসঙ্গীর শারীরিক গঠন নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করতে পারে না যা করে দেখিয়েছে নায়ক শাকিব।

শাকিব খানের এক ঘটনায় আমাদের সমাজের অনেকের চরিত্র ফুটে উঠেছে। বাস্তবে এসব পুরুষেরা হয় কাপুরুষ তারা একজন নারীর সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করবে, তার আস্থা ও বিশ্বাসের সুযোগে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজের যৌন ক্ষুধাকে শান্ত করে কিন্তু সেই সম্পর্কের স্বীকৃতির বেলায়, তাকে টেনে নেওয়ার বেলায় বা সম্পর্কের ইতি টানার বেলাতেও এককথায় পিছপা হতে তাদের বিবেকে বাধে না। যেকোনও সম্পর্কের একটি দায় বোধ থাকতে হয়, থাকতে হয় কিছু দায়িত্ববোধ। সম্পর্কের সম্মান বজায় রাখাটা নারী পুরুষ উভয়েরই দায়িত্ব থাকে। একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার যেমন কোনও কারণ থাকে ঠিক তেমনি সেই সম্পর্ককে ভেঙে দিতেও থাকতে হয় যুক্তি। না হয় সেটা মর্যাদার সম্পর্ক হয় না।

অপু বিশ্বাসের এই সরল স্বীকারোক্তি অনেক মেয়ের জন্য সচেতন হওয়ার উদাহরণ। আপনি যাকে সবচেয়ে নির্ভরশীল বলে জীবনে টেনেছেন বাস্তবে কি সে অতটা নির্ভরশীল হতে পেরেছে? আপনি যাকে বিশ্বাস করে নিজেকে সমর্পণ করেছেন সত্যি কি সে আপনার বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে পারছে? নাকি বিশ্বাস ও ভরসার সুযোগে আপনার কাছাকাছি এসে আপনার চূড়ান্ত সর্বনাশের কোনও পরিকল্পনা করে যাচ্ছে?

চারপাশে নীতি নৈতিকতার এক চরম ধস নেমেছে। মানুষ এখন আর কমিটমেন্টে যেতে চায় না। দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় আগেই কেটে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে একজন নারী এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। অপু বিশ্বাসের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত নারীর ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে ভাবতে বাধ্য করে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি আসলে সব মুক্তিকে নিশ্চিত করে না। তার মানসিকতার মুক্তি ঘটাতে হবে আগে। মিথ্যে আবেগের দুনিয়া থেকে মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি বলি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা সবটাই ছিল অপুর। কিন্তু তারপরও আজকে কেন সে নিগৃহীত? কোথায় আটকে আছে আমাদের সমাজের নারীরা? আমার কাছে উত্তর একটাই, নারীর মানসিক জগতে আনতে হবে বিরাট পরিবর্তন। পুরুষের ওপর তার মানসিক নির্ভরতার জায়গায় শৃঙ্খলমুক্তি ঘটাতে হবে সবচেয়ে আগে। যেইদিন নারীরা এক কথায় তথাকথিত আবেগের দুনিয়া থেকে বাস্তবের জগতে পা রাখতে পারবে, যেদিন নারীরা পুরুষের মেকি ভালোবাসাকে বুঝতে শিখবে, যেদিন নারীরা সব হারিয়ে সর্বহারা হওয়ার আগেই ঘুরে দাঁড়াতে জানবে, যেদিন নারীরা পুরুষের উন্নতির জন্য নিজের উন্নতিকে বিসর্জন দেওয়ার মতো আবেগীয় বেড়াজাল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে সেদিন হয়তো ঘটবে প্রকৃত নারী মুক্তি।

সবশেষে সবাইকেই বলতে চাই, নিজেকে স্বাধীন মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতে শিখুন। চোখের পানি দিয়ে নয়, প্রতিবাদ দিয়ে কাপুরুষদের মোকাবিলা করতে শিখুন। জীবন আপনার, সিদ্ধান্ত আপনার। প্রকৃত বন্ধু চিনতে পারাটাও একধরনের সক্ষমতা অর্জন যা একজন নারীকে অর্জন করতে হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ