X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষকের কান্নায় বেড়েছে হাওরের পানি

প্রভাষ আমিন
১৬ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫২আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫৪

প্রভাষ আমিন হেফাজতে ইসলামের অন্যায় দাবির কাছে সরকারের নতি স্বীকার, বর্ষবরণের উৎসবে নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে হারিয়ে যাওয়া স্বতঃস্ফূর্ততা ইত্যাদি নানা কারণে পহেলা বৈশাখের ভোরে এবার মনটা তেমন ভালো ছিল না। সেই মন খারাপ ভাবটাকে প্রবল বিষণ্নতায় বদলে দিলো একটি খবর- ‘সুনামগঞ্জে আজ উৎসব নেই, আছে প্রতিবাদ’। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের একমাত্র সার্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষ সামিল হয় এই উৎসবে। গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা বসে। নানান আয়োজন দেশজুড়ে। আর তখন হাওরাঞ্চলে উৎসবের বদলে শোক, প্রতিবাদ। শোক আর কান্না আজ হাওরের কৃষকের ঘরে ঘরে।
অথচ হাওর মানেই যেন উৎসব। আমরা যারা শহুরে মানুষ তাদের কাছে হাওর মানেই থই থই জল, বাউল গান, পূর্ণিমার রাতে বজরায় চড়ে জ্যোৎস্না বিলাস। কিন্তু হাওরের সঙ্গে যাদের নিত্য বাস, তাদের মনে এবার রঙ নেই। অকাল বন্যা আর বাধভাঙা জোয়ারে তলিয়ে গেছে হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। এবার কৃষকেরা একমুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারেনি। তাদের মনে তাই সুখ নেই, রঙ নেই, উৎসব নেই। কৃষকের কান্না আমাদের শহুরে মানুষের মন গলাতে পারেনি, তাদের চোখের জল হাওরের পানির উচ্চতা একটু বাড়িয়েছেই শুধু।
মার্চের শেষ দিকের অকাল বর্ষণই এবার হাওরের মানুষকে পথে বসিয়েছে। আসলে বসার মতো পথও পাবে না তারা; তাদের সব স্বপ্ন, সব আশা, সারাবছরের খোরাকি ভেসে গেছে অথই জলে। অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া কৃষকদের আর কিছুই করার ছিল না। হাওরাঞ্চলের বেশির ভাগ জমিই এক ফসলি। বছরের এই একটি মাত্র ফসল কাটা শুরু হওয়ার আগেই তলিয়ে যাওয়ায় দেশের সাত জেলার হাওরের প্রায় ১২ লাখ কৃষক পরিবার দিশাহারা। ফসল হারানোর বেদনা সইতে না পেরে মারা গেছেন এক কৃষক। যারা বেঁচে আছেন, তাদেরও মরতে হবে তিলে তিলে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাত জেলা নিয়ে হাওরাঞ্চল। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই সাত জেলায় এবার ৯ লাখ ৩০ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬১ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতেই এবার অকাল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের সাত জেলায় সামগ্রিকভাবে ফসলের ক্ষতি হবে শতকরা ৩৫ ভাগের মতো। যদিও কৃষকরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। কোনও কোনও এলাকায় পুরো ফসলই তলিয়ে গেছে। তবু সরকারি হিসাব বিবেচনায় নিলেও ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার ৬২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

হাওরজুড়ে এবার তাই বাউল গান নয়, কৃষকের হাহাকার। ঘরে নিজেদের খাবার নেই, এমনকি নেই গবাদি পশুর খাবারও। গবাদি পশু আসলে গ্রামের মানুষের পরিবারের সদস্যের মতো। কিন্তু গবাদি পশুকে খাওয়াতে না পেরে এবং নিজেদের খাবার জোগাতে পানির দরে বেচে দিচ্ছেন প্রিয় পশুটিকে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন চালের দাম। ফলে সব দিক দিয়েই এবার মরতে বসেছেন হাওরের মানুষ।

অকাল বন্যায় প্রায় নিয়মিতই হাওরের মানুষদের ভোগায়। অন্য বছরগুলোতে বন্যা আরও পরে আসে। তাই পরিপক্ক ধান ডুবে গেলেও সেখান থেকে কিছুটা উদ্ধার করতে পারে কৃষকরা। কিন্তু এবার বন্যাটা একটু বেশি আগেই এসেছে। তাই পাকার আগেই ধান ডুবে গেছে। ফলে এবার তাদের না খেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ফলে যে হাওর এলাকা আমাদের খাবার জোগায়, এবার তারাই খেতে পাবে না। সুনামগঞ্জের কৃষক বাবর আলী বর্ষবরণ না করার কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘বৈশাখের পহেলা দিন নয়া ধানের চাউলের ভাত দিয়া শিরনি করি আমরা। ইটা বাপ-দাদার আমল থাকি চইলা আইছে। বাইচ্চারা কত খুশি অয়। ই-বার তো এক ছটাক ধানও কেউ তুলত পারছি না। কান্দন ছাড়া আমরার কোনও উপায় নাই।’

অতিবৃষ্টি, আগাম বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওলটপালট হয়ে গেছে প্রকৃতির ছন্দও। তাই অসময়ের বৃষ্টি বা আগাম বন্যার উৎপাত আরও নিয়মিত হবে। দুর্যোগটা প্রাকৃতিক, তাই বলে প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়ে হাওরের মানুষের দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার নানা কৌশল নিয়ে হাওরের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। এমনিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু হাওরের মানুষের ভাগ্যটাই কী খারাপ। তারা বারবার দুর্যোগে পড়ে, প্রতিবার ধ্বংস হয়, আবার ওঠে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের রক্ষায় কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হয় না কেন? এবারের অকাল বন্যার পর এই বিষয়গুলো অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। আলোচনায় আসছে বাঁধ নির্মাণে অদক্ষতা আর দুর্নীতির নানা খবর। হাওর এলাকার বাঁধগুলো সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। ফলে প্রতিবছরই বাধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর আসে। যেমন চলতি মৌসুমে সরকার সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সেই কাজ শুরুই হয় ফেব্রুয়ারিতে। প্রতিবছর একই ধরনের সংবাদ দেখেও কি টনক নড়ে না, আমাদের নীতিনির্ধারকদের? তারা কি টেকসই বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে পারেন না, পারেন না বেড়িবাঁধ মেরামতে অনিয়ম দূর করতে। হাওর এলাকার নদী-খাল-বিল নিয়মিত খনন করার মাধ্যমেও কৃষকদের রক্ষা করার চেষ্টা তো অন্তত করতে পারি। বাঁধ নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণের টাকা ইঞ্জিনিয়ার আর ঠিকাদারদের ভাগাভাগির খবর তো ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে বাঁধের টাকা কাদের পকেটে যায়।

দেশের ৭টি জেলায় হাওর আছে। তাই বলে হাওরের মানুষের কান্না শুধু হাওরের বাতাসেই যেন মিলিয়ে না যায়। হাওরবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এবার এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার জন্য সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের খাদ্য দিতে হবে। আগামী বছরের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে, বীজ দিতে হবে।

দেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ হাওর এলাকার মানুষ। হাওরের প্রতি তার মমত্ব আমরা সবাই টের পাই। রাষ্ট্রপতির প্রতি আকুল আবেদন তিনি যেন হাওরের মানুষকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। হাওর থেকে আমরা বাউল গানের সুরই শুনতে চাই, কান্না নয়, হাহাকার নয়।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ