X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

'ও'-তে ওড়না, বড় ভয়ঙ্কর

শান্তনু চৌধুরী
১৭ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫৮আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:০৪

শান্তনু চৌধুরী পাঠক শিরোনাম পড়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। সেই কবে সারাদেশে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বই উৎসব করার পর জানা গেলো হেফাজতে ইসলামের দেওয়া ফরমায়েশ অনুযায়ী (ওই দলের নেতাদের বক্তব্য) সারাদেশে সরকার পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে বেশ সাম্প্রদায়িক জোশ এনে দিয়েছে, সেই নিয়ে এতোদিন পর লেখা কেন? এই নিয়েতো কম জল ঘোলা হয়নি। ছয়জন কর্মকর্তা ওএসডি হলো। ‘ও’ এর পর ‘ঔ’ নিয়েও ঝামেলা হলো। ‘ঔষধ’ তো সাধু ভাষা। এরপরও কত ইস্যু এলো গেলো। কত বিষয় সংবাদমাধ্যমের নজর এড়ালো। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ইস্যু, তিস্তার জল গড়ালো তোরসা পর্যন্ত, শাকিব-অপু ইস্যু, এরপর এলো গ্রিক দেবীর শাড়ি পরা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ‘রাষ্ট্রের প্রধান আধ্যাত্মিক মুরব্বি’র উপস্থিতিতে ঘোষণা দেন ভাস্কর্য সরানোর। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করে বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন। কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ধর্মীয় উস্কানি, চট্টগ্রামের চারুকলায় ম্যুরালে মৌলবাদের মোবিল থাবা। এ নিয়ে ইস্যু তৈরি হতে না হতেই এলো মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি। এতো কিছুর ভিড়ে হঠাৎ ‘ওড়না’ প্রসঙ্গ কেন?
শ্যালো মেশিন নামে এক যন্ত্র আমদানি করা হয়েছিল কৃষকের ক্ষেতের কাজে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু সেই মেশিনই কাল হলো। কেবল ক্ষেতের কাজ নয় নৌকায় এ ইঞ্জিন বসিয়ে করা হলো যন্ত্রচালিত নৌযান। আর সড়কপথে বিভিন্ন গাড়িতে শ্যালো মেশিন বসিয়ে তৈরি করা হলো নানা রকমের গাড়ি। কোথাও সেটির নাম ভটভটি, কোথাও আলমসাধু বা নছিমন, করিমন নামেও পরিচিত। অনেকটা ‘জলবৎ তরলং’এর মতো। এই মেশিন যেখানে বসে সেখানেই নতুন নাম। এসব গাড়ির কারণে একের পর এক ঘটতে লাগলো দুর্ঘটনা। এটি প্রথাসিদ্ধ কোনও যান নয়। তাই এসব যানের কোনও রুট পারমিট বা লাইসেন্স নেই। চালকও প্রশিক্ষিত নয়। নেই যাত্রীর হিসাবও। নেই গতিনিয়ন্ত্রক হাইড্রলিক ব্রেক। সে কারণে এই গাড়িতে ওঠে ‘অগস্ত্য যাত্রা’ হয় অনেকের। যার মধ্যে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায়। চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর মহাসড়কে ট্রাকের সঙ্গে ভটভটির সংঘর্ষে মারা যান ১৩ জন। যারা সবাই ভটভটির যাত্রী এবং খেটে খাওয়া মানুষ।

এবার আসা যাক ওড়নার প্রসঙ্গে। সাংঘর্ষিক দুর্ঘটনা ছাড়াও এসব গাড়ির ইঞ্জিনে ওড়না পেঁচিয়ে নারীদের মৃত্যুর খবর আমরা প্রায় পড়ি। এরপরও ‘জীবন পাতার অনেক খবরের’ মতো অনেক খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। বিশেষ করে মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর পরিণতি না হলেওতো ঠাঁই পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বেশ ভালো একটি প্রতিবেদন প্রচার হয়েছে ৩০মার্চ জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে। তাদের ভাষায়, ‘নষ্ট রাস্তার স্পষ্ট আপদ’ এই যানের কারণে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করতে গিয়ে বিশেষ করে মফস্বল শহরগুলোতে কত নারীকে অসহায় পঙ্গু হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এই যানগুলোর মাঝ বরাবর ফাঁক দিয়ে ওড়না ঢুকে পেঁচিয়ে পক্ষঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে ভর্তি আছেন অনেক নারী।

সিআরপি’তে সাম্প্রতিক সময়ে ওড়না পেঁচিয়ে পঙ্গু অবস্থায় ভর্তি আছেন ৩৭ জন। ৪ এপ্রিল নোয়াখালীতে অটোরিক্সায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু হয় এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর। রাজধানীর পল্লবীতে স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফেরার পথে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে মারা যান এক নারী, শনিরআখড়ায় অটোরিকশার চাকার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী জ্যোতি মারা যান। বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চাকার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে এক নারীর মৃত্যু, তেজগাঁও নাখালপাড়ায় এক কিশোরী গৃহকর্মীর মৃত্যু হয় রিকশার চেইনে ওড়না পেঁচিয়ে, গাজীপুরে অটোরিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে মারা যান এক কলেজছাত্রী। পঞ্চগড়ের বোদায় বড়শশী ইউনিয়নের তেতলির মোড়ে স্বামীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এক স্কুল শিক্ষিকার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তার সাত মাস বয়সী মেয়ে আহত হয়। বেঁচে যান স্বামী। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি স্পিনিং মিলে ববিন মেশিনে ওড়না পেঁচিয়ে এক নারী শ্রমিক মারা যান। নারায়ণগঞ্জে ট্রলারের ইঞ্জিনে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লেগে এক স্কুলছাত্রী মারা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কদমরসুল এলাকায় একটি কারখানায় তাঁত মেশিনের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে এক নারী শ্রমিকের মৃত্যু। এসবই সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আসা খবর। এরপরও কত খবর রয়ে গেছে অগোচরে। তার মানে যতো বিপত্তি ওই ওড়না নিয়ে আর সবচেয়ে এটা বেশি ঘটছে স্বল্পমূল্যের যানবাহনে। সে কারণে একবার সরকারের পক্ষ থেকে মহাসড়কে এসব যান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘যেই লাউ সেই কদু’। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দেদারছে চলছে এসব যানবাহন, ঘটছে প্রাণহানি। গলার ফাঁস হচ্ছে ওড়না।

কিন্তু এরপরও দেখা যায়, এই ওড়না নিয়েই যতো বিপত্তি। মৌলবাদীরা সোচ্চার, গৃহকর্মী ওড়না না পড়লে সোচ্চার গৃহকর্ত্রী, মেয়ে না পড়লে মা চিন্তিত আবার অফিসে কেউ না পড়লে সহকর্মীদের নানা ব্যঙ্গ। কিন্তু আমিতো দেখি বাড়তি এই বস্তু সামলাতে নারীদের কতনা কষ্ট সহ্য করতে হয়, কত না খেয়াল রাখতে হয়। একটু বেখেয়াল হলেই বিপত্তি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই ওড়না যারা পরছেন না তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যা শুধু যারা লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে দেখছে তাদের। এদের লোলুপতার ভার বহন করতে হচ্ছে নারীকে। অনেকে যে ব্যবহার না করে থাকছেন আমিতো তাদের মধ্যে অসুন্দর দেখি না। বরং তারা অনেক বেশি সাবলীল। কখন ওড়না স্থানচ্যুত হলো, রিকশা, ভটভটিতে পেঁচালো, রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কোনও আংটার সাথে লেগে বিব্রত হতে হলো। তাই মনে হয়, ও’তে ‘ওড়না’ না পরে ‘ওল’ খেয়ে গলা চুলকালেও ওড়না না পরলে যাদের চোখ চুলকায় তাদের ভিটামিনের অভাব হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক    

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাতে নামছে বার্সা-পিএসজি
রাতে নামছে বার্সা-পিএসজি
জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করতে যে শর্ত দিলো চীন
জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করতে যে শর্ত দিলো চীন
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ