X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

গণনৈরাজ্য

আমীন আল রশীদ
১৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৫৩আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:২৪

আমীন আল রশীদ গণপরিবহন, গণস্বাস্থ্য, গণতন্ত্র, গণনীতি— ইত্যাদি গণসম্পর্কিত শব্দগুলোর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, এখানে ‘গণ’টাই বিযুক্ত। বিশেষ করে আমরা যখন গণপরিবহন নিয়ে কথা বলি, তখন এটা ধরেই নিই যে, এখানে কেবল ‘পরিবহন’ শব্দটাই বহাল এবং ‘গণ’ শব্দটি হাস্যকররূপে বিদ্যমান। সেটা রাজধানী ঢাকায় কিংবা বিভাগ অথবা জেলা-উপজেলায়।
রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তার মোড় থেকে মহাখালী পর্যন্ত একটা লেগুনার সার্ভিস আছে। ‘সার্ভিস’ শব্দের বাংলা ‘সেবা’ হলেও এখানে পড়তে হবে ‘চলাচল’। তো এই বাহনে মাঝেমধ্যে মহাখালী যাওয়া-আসা করি। পেছনে দুই সারিতে ১২জন এবং সামনে ড্রাইভারের পাশে দুজন। ড্রাইভারের পাশের সিটে একজন বসেন এবং এই দুজনের মাঝখানে উঁচু জায়গায় আরেকজন। এটা দেখতে যেমন অশ্লীল তেমনি বসাও কঠিন। দুটি সিটের মাঝখানে আরেকজন বসলে চালকেরও অসুবিধা। কিন্তু প্রতি ট্রিপে বাড়তি ১০টাকার জন্য এই নির্মম পদ্ধতি। এ নিয়ে একবার এক চালককে প্রশ্ন করলে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, সবাই তো এভাবেই বসায়। আমারে জিগান ক্যান? আবার ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী এসব লেগুনার অধিকাংশের চালকই বয়সে তরুণ, কিশোর এমনকি শিশু। যাদের কারোরই লাইসেন্স নেই। তারা যেভাবে বেপরোয়া চালায় এবং রিকশা মেরে দেয়, তাতে মনেই হয় না দেশে গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণে কোনও আইন আছে।
তো এ নিয়ে আপনি কাকে প্রশ্ন করবেন? সড়কমন্ত্রীকে, পরিবহন মালিককে না পরিবহন শ্রমিক নেতাকে? বাস্তবতা হলো, দেশের সড়ক পরিবহন খাতে যে বিভীষিকাময় নৈরাজ্য, সেখানের সিন্ডিকেটটা মালিক-শ্রমিক-সরকার ত্রিপক্ষীয়। যার সবশেষ উদাহরণ রাজধানীতে সিটিং বাস বন্ধ।

এই সিটিং বাসকে মানুষ মূলত চিটিং সার্ভিস নামে অভিহিত করে। ফার্মগেট থেকে আসাদগেটের দূরত্ব এক কিলোমিটার। কিন্তু আপনি তথাকথিত ওই সিটিং বাসে উঠলে এই পথেই ভাড়াই দিতে হতো ১৫ টাকা। সিটিং সার্ভিস বন্ধের পর এই নৈরাজ্যের বোধ হয় আপাতত নিরসন হয়েছে। অর্থাৎ এই সামান্য পথে এখন আর ১৫ টাকা হয়তো যাত্রীকে দিতে হয় না। কিন্তু নৈরাজ্যের ধরন পাল্টেছে।

গণমাধ্যমের খবর এবং রাস্তায় চলতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, ১৬ এপ্রিল থেকে অর্থাৎ যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়েছে, সেদিন থেকে এই মহানগরীর মানুষের জীবনে মিনি কেয়ামত নেমে এসেছে। বিশেষ করে যারা এই তথাকথিত গণপরিবহনে যাতায়াত করেন। ফেসবুকে একজন এই নৈরাজ্যের চেহারা দেখে লিখেছেন, ‘এটা ঢাকা না সিরিয়া?’

সিটিং বন্ধ হলেও আদতে লাভ মালিকদেরই। তারা আগে যে বাসে ৩০জন যাত্রী তুলতেন তারাও এখন গাদাগাদি করে সেই বাসে যাত্রী তোলেন ৬০ জন। অনেকে আবার সিটিং সার্ভিসের আমলে যে ভাড়া ছিল, সেটাই নিচ্ছেন। এ নিয়ে যাত্রীদের সাথে কন্ডাকটরদের বচসা নিত্য। আবার পরিবহন শ্রমিকরা এতটাই বেপরোয়া যে, সিটিং সার্ভিস বন্ধের দ্বিতীয় দিনের চিত্র দেখতে গিয়ে শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন দুজন সাংবাদিক। তারা দুজনই দেশের প্রতিষ্ঠিত দুটি গণমাধ্যমে কাজ করেন।

এই তথাকথিত সিটিং বন্ধের সবচেয়ে বড় ভিকটিম নারীরা। আগে তাও তারা সিটিং সার্ভিসে বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও নির্ঝঞ্ঝাটে ওঠে একটু আরামে বসে গন্তব্যে যেতে পারতেন। এখন মানুষের ঠেলাঠেলির কারণে তারা আর বাসে উঠতেই পারছেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে রাস্তার পাশে। আবার কোনোমতে বাসে উঠতে পারলেও সিট খালি নেই। মহিলা সিট নামে যে কয়টি আসন নির্ধারিত থাকে, তাও খালি থাকে না। পুরুষেরাই বসে থাকে। অনেক পুরুষ অন্য যাত্রীদের দ্বারা ভর্ৎসনার শিকার হলেও মহিলা সিটে নির্লজ্জের মতো বসে থাকেন। বরং পাল্টা প্রশ্ন করেন, পুরুষের সিটে কেন নারীরা বসেন? তো এরকম সাংস্কৃতিক আর রুচির মান নিয়ে যারা গণপরিবহনে চলাচল করেন, তাদের সঙ্গে বচসাও যাওয়াও বরং মূর্খতা।

আবার এই মহিলা সিট নামে যে অত্যন্ত অসম্মানজনক আসনগুলো রাখা হয় চালকের বাম পাশে একটি বেঞ্চের মতো জায়গায়, তার সামনেই থাকে ইঞ্জিন এবং ইঞ্জিন থেকে অনবরত বের হতে থাকে গরম বাষ্প। ফলে মহিলা সিটের এই অদ্ভুত আইডিয়া নারীর প্রতি আমাদের যে মানসিকতার প্রকাশ ঘটায়, তাও সমাজবিজ্ঞানের একটা গবেষণার বিষয় বলে মনে হয়।

সিটিং বাস বন্ধ এবং সঙ্গে সঙ্গে এর নজরদারি করছে বিআরটিএ। যানবাহন নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ সমালোচনা আছে। ঘুষ-দুর্নীতির এন্তার অভিযোগের পরও গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তারা কিছু উদ্যোগ নেয় বটে। কিন্তু যখনই তারা কোনও উদ্যোগ নেয় তখনই ঢাকার রাস্তায় গণপরিবহনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। মালিকরা আনফিট গাড়িগুলো মামলার ভয়ে বের করেন না। কেউ কেউ সরকারি সিদ্ধান্তের নিরব প্রতিবাদ হিসেবেও গাড়ি গ্যারেজে রেখে দেন। সিটিং বন্ধের ক্ষেত্রেও মূলত তা-ই হয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছিলো, ঢাকায় যে পরিমাণ পাবলিক বাস চলে সেগুলো নিয়মিত চলাচল করলে কোনও যাত্রীকেই বাসের জন্য বেশিক্ষণ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না এবং একটা বাসে অনেক গাদাগাদি করেও লোক উঠবে না। কারণ একটার পরে আরেকটা বাস আসবে। কিন্তু দেখা গেলা স্রেফ এর উল্টো। মালিকরা ইচ্ছে করেই কম বাস রাস্তায় ছাড়ছেন এবং সিটিং বন্ধের ফলে যে মিনি কেয়ামত তারা নাজিল করেছেন তাতে করে যাত্রীদের তরফেই এই দাবি উঠবে যে, ভাই সিটিং আবার চালু করেন। সিটিং সার্ভিস যেহেতু আইনে অনুমোদিত নয়, তাই যাত্রীদের এই দাবির মুখে সরকারও শেষমেষ বলবে যে, ঠিক আছে সিটিংই ভালো।

তবে রাস্তায় পাবলিক বাসের সংখ্যা কমে যাওয়া এটিই প্রথম নয়। বরং বিআরটিএ যখনই এরকম অভিযান শুরু করে তখনই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যায়। এর প্রধান কারণ গাড়ির ফিটনেস ও কাগজপত্র ঠিক না থাকা। অর্থাৎ ভ্রাম্যমাণ আদালত ফিটনেসবিহীন এবং কাগজপত্র ঠিক না পেলেই মামলা করবে এই ভয়ে মালিকরা গাড়ি বের করেন না। তাছাড়া এবার গাড়ির ছাদের ক্যারিয়ার এবং বেপরোয়া চালানো রোধে অ্যাঙ্গেল খুলে ফেলার নির্দেশনাও রয়েছে। ফলে যেসব গাড়ি এখনও ক্যারিয়ার ও অ্যাঙ্গেল খুলে ফেলেনি তারাও গাড়ি বের করছে না। আবার কিছু মালিক হয়তো সিটিং বাস বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেই গাড়ি বের করছেন না। সব মিলিয়ে একটা ভজঘট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হলো এই ভোগান্তি কতদিন? গণপরিবহন কি কোনোদিনই গণবান্ধব হয়ে উঠতে পারবে না?

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খাদে পড়া গাড়ি উদ্ধারের সময় বাসচাপায় প্রাণ গেলো ২ জনের
খাদে পড়া গাড়ি উদ্ধারের সময় বাসচাপায় প্রাণ গেলো ২ জনের
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধ জাহাজ
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধ জাহাজ
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ