X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

এরশাদ খালাস!

শুভ কিবরিয়া
২০ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৫৬আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:১০

শুভ কিবরিয়া ইংরেজি ২০১৭ সালের এপ্রিলের ১৯ এবং বাংলা ১৪২৪-এর বৈশাখের ৬ তারিখ, যে বিকালে আকাশে ছিল মেঘভার করা বেদনা-বিষাদ, সেই বিকালেই এক সুখ সংবাদে উদ্ভাসিত হলো এরশাদের মুখমণ্ডল। এই দিনেই এক সময়ের দোর্দণ্ড ক্ষমতাধর শাসক, সাবেক সামরিক স্বৈরাচার লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাডার ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় ঢাকা মহানগরের এক আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেলেন।
মনে রাখতে হবে স্বৈরাচার এরশাদ এখন বিশেষ মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে গঠিত সরকারের অংশীজনও এরশাদ। সরকারের মন্ত্রীসভায় এরশাদের দলের অংশিদারিত্ব আছে। আবার সংসদের বিরোধী দলের কাতারেও আছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। সেই হিসাবে বর্তমান সরকারের সঙ্গে নানান ঐক্যের সূত্রে আবদ্ধ এরশাদ ও তার রাজনৈতিক দল। শেখ হাসিনার শাসনামলে ঢাকা মহানগর জজ আদালতের বিচারে দুর্নীতি মামলা থেকে এরশাদের বেকসুর খালাস তাই এইসব সরকারি আত্মীয়তার প্রভাবের দিক থেকেও বিবেচ্য হতে পারে। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণ এবং এরশাদের আইনজীবীর মতামত বিবেচনায় নিতে পারি:-
এক. আদালতের রায়ে বিচারক বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে রাডার কেনার ব্যাপারে অর্থ আত্মসাৎ বা কাউকে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই ব্যর্থতা দুই কারণে হতে পারে। প্রথমত, রাষ্ট্রপক্ষের সক্ষমতার অভাব। অথবা রাষ্ট্রপক্ষের ইচ্ছার অভাব। সরকারের প্রতিপক্ষ সহ বিভিন্ন মামলায় গত এক দশকে রাষ্ট্রপক্ষ যেভাবে সফল হয়েছেন তাতে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। বরং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের ইচ্ছারই হয়তো প্রতিফলন ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষ হয়তো চেয়েছেই এই মামলার রায় এরশাদের বিপক্ষে না যাক।
দুই. এইচ এম এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম মিডিয়াকে জানান, রাষ্ট্রপক্ষ যেসব সাক্ষী আদালতে উপস্থাপন করে; তারাই প্রমাণ করেছেন এরশাদ নির্দোষ। আর যেসব নথি আদালতে উপস্থাপন করা হয়, সেখান থেকেও প্রমাণিত হয়েছে এরশাদ কোনও অপরাধ করেননি। এরশাদের আইনজীবীর এই বক্তব্য প্রমাণ করে ‘ডাল মে কুছ কালা হায়’!

০২.

এরশাদের বিরুদ্ধে বিমানবাহিনীর রাডার ক্রয়ে দুর্নীতির এই মামলা হয় ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর। এরশাদের দুর্দিনেই বিমানবাহিনীর রাডার ক্রয়সংক্রান্ত এই দুর্নীতির মামলাটি দায়ের করা হয়। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার। ১৯৯২ সালের ৪ মে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এরশাদ সহ আরও তিনজন আসামিকে অভিযুক্ত করে দুর্নীতি কমিশন এই মামলাটি দায়ের করে।

মামলার অভিযোগে বলা হয় আসামি এরশাদ সহ অপর আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ইচ্ছা করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিমানবাহিনীর প্রস্তাবিত ১৯৮১ সালের রাডার মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ফ্রান্সের সিএসএফ কোম্পানির রাডার না কিনে বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টিং কোম্পানির রাডার কেনেন। এতে সরকারের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।
এই মামলার অপর আসামিরা হলেন, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান সুলতান মাহমুদ, বিমানবাহিনীর সাবেক সহকারি প্রধান মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক এ কে এম মুসা (মামলা চলাকালীন অবস্থায় পলাতক থাকেন। পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করায় মামলা থেকে নিস্কৃতি পান)। উল্লেখ্য এই মামলার রায়ে প্রধান অভিযুক্ত এরশাদসহ অপর দুইজন আসামিকেও বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

০৩.

এরশাদের বিরুদ্ধে এই মামলার নিস্পত্তি হতে সময় লাগে প্রায় দুই যুগ। এই মামলার বাইরেও এরশাদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা চলমান। আপাতত সেটি রাষ্ট্রপক্ষের নিস্ক্রিয়তায় চাপা পড়ে আছে।

হাইকোর্টের এক বিচারককে ঘুষ দেওয়ার ক্যাসেট কেলেঙ্কারির মামলায় এরশাদের সাজা চ্যালেঞ্জ করে দেওয়া রায় উচ্চ আদালতে বিচারাধীন প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে।

সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করার সময় জাতির কাছে প্রদত্ত ঘোষণায় যে তিনটি প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন তার অন্যতম ছিল দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের মুলোচ্ছেদ করে প্রশাসন ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা  ফিরিয়ে আনা। তিনি সেসময় ঘোষণা করেছিলেন, তিনি কখনও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করবেন না। দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের অঙ্গীকার করেছিলেন সেসময় এরশাদ। বলা বাহুল্য এসব প্রতিশ্রুতির  কোনোটাই রক্ষা করেন নাই এইচ এম এরশাদ। বরং প্রতিটি অঙ্গীকারের ব্যতয় ঘটিয়েই ঠাণ্ডা মাথায়, হিসেব-নিকেশ করে, ধীরস্থিরভাবে একটি প্রচলিত রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। এবং ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সালের শেষভাগ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকেন সকল বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করেই।

০৪.

স্বৈরাচার এরশাদ দুর্নীতির সমর্থক ছিলেন তার শাসনামলে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই গোষ্ঠীর চক্ষুশূল ছিলেন তার ক্ষমতাকালিন সময়ে। তারপরও দুর্নীতির মামলায় সরকারি পক্ষের নিস্ক্রিয়তায় খালাস পেলেন এরশাদ। কিন্তু কেন?

এক. এরশাদ তার রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছেন। কখনও কখনও সফলও হয়েছেন। বিশেষ করে তার শাসনামলে রাজনৈতিক খেলায় আওয়ামী লীগকে এরশাদ তার সঙ্গে পেয়েছেন। ১৯৮৫ সালে  আন্দোলনের মাঠ থেকে হঠাৎ উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোটের মাঠে নামাতে সমর্থ হয়েছিলেন এরশাদ। সেক্ষেত্রে তার ক্ষমতার মেয়াদে এরশাদ বরাবরই বিএনপির চক্ষুশূল ছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের এই ‘পুরাতন প্রেম’ সম্ভবত এরশাদকে রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলা থেকে রেহাই দিতে প্রণোদনা হিসাবে কাজ করেছে।

দুই. ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রেখে এরশাদকে একপ্রকার জোর করে নির্বাচনে রাখার ক্ষেত্রে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংহের প্রকাশ্য তৎপরতা ছিল দৃশ্যমান। এরশাদ তার পুরো শাসন জমানায় ভারতীয় সমর্থন পেয়েছেন। আবার সেই সমর্থনে যখন ঘাটতি পড়েছে তখনই তিনি বিপত্তির মুখে পড়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শেখ হাসিনার সাথে থাকার পুরস্কার হিসাবেই হয়তো এই দুর্নীতির মামলা থেকে খালাস পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ জোরদার ভূমিকা রেখেছে। কিংবা পুরনো দিনের মতো এক্ষত্রেও পর্দার আড়াল থেকে তিনি ভারতীয় বন্ধুদের সহায়তা পেয়েছেন।

তিন. মিত্র হিসাবে এরশাদ কখনোই বিশ্বস্ত নন। তাই প্রতিপক্ষ একধরনের চাপে রেখেই তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ফায়দা হাসিল করেন। এবারও এরশাদের এই মামলার খালাস পাওয়া হয়তো সেই প্রক্রিয়ারই অংশ।

চার. সামনের নির্বাচনে এরশাদকে কাছে পেতে চান শেখ হাসিনা। বিপদজনক এরশাদ যাতে কাঙ্ক্ষিত সময়ে বেঈমানি করতে না পারেন তার একটা ট্রায়াল সিগনাল এটি। এরশাদের বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলা সহ আরও একটি মামলা আছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ সক্রিয় হলে এরশাদের রাজনৈতিক ও স্বাভাবিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

পাঁচ. নিজ দল এবং জনগণের একটা বড় অংশের চাপের মুখেও আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব হেফাজত ইসলামির দাবি-দাওয়া মেনে তাদেরকে যে কারণে পাশে পেতে চাইছে ঠিক একই কারণে এরশাদকেও দরকার। সেই দরকারের কাফফারা হিসাবে দুর্নীতির মামলা থেকে এরশাদের এই খালাস মিলেছে।

আপাততত একটা দুর্নীতির মামলা থেকে খালাস পেলেন এরশাদ। সামনে সরকারের 'কথামতো চললে' হয়তো আরও পুরস্কার জুটবে এরশাদের ভাগ্যে। কিন্তু এভাবে ‘কথামতো চললে’ রাজনীতিতে পুরনো গৌরব, ক্ষমতা কি ফিরে পাবেন এরশাদ? নাকি রাজনীতির বলির পাঠা হয়ে আরও অনেক দুর্দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তাকে, দেখার বিষয় এখন সেটাই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ