X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র জয়ের গল্প

শেখ শাহরিয়ার জামান
২২ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:১৯আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:২৩

শেখ শাহরিয়ার জামান ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গোপসাগরের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্য পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হলেও বঙ্গোপসাগরের জন্য কূটনৈতিক যুদ্ধটি হয়েছে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’ পরিবেশে।
সমুদ্র সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ২০০৯ সালে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। মিয়ানমারের সঙ্গে মামলার রায়ে আদালতে মোট বিতর্কিত অঞ্চলের (ডিসপিউটেড এরিয়া) মধ্যে ১ লাখ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চল বলে রায় দেয়। আবার ভারতের সঙ্গে মোট ২৫ হাজার ৬০০ বর্গ কিলোমিটার বিতর্কিত অঞ্চলের (ডিসপিউটেড এরিয়া) মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটার।
কূটনৈতিক যুদ্ধের এ পথটি মোটেই মসৃণ ছিল না। এর জন্য বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ও অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের জন্য দর কষাকষি শুরু হয়। সেই সময় জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দি লস অব দ্য সি (ইটলস) প্রতিষ্ঠা হয়নি। ইটলস প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮২ সালে।

এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে কেন্দ্র করে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মিয়ানমার মেনে নেয়। এ ঘটনার কিছুদিন আগে বাংলাদেশ টেরিটোরিয়াল অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস আইন জারি করে। কিন্তু ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বভৌম দাবি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা তখন করা সম্ভব হয়নি। এ বিরোধ মীমাংসার জন্য দুইপক্ষের মধ্যে শেষ আলোচনা হয় ১৯৮৬ সালে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য আলোচনাটি হয় ১৯৭৯ সালে বিএনপি সরকারের প্রথম আমলে যখন দুইপক্ষ সমুদ্র সীমানা হিসাবে একটি ‘ফ্রেন্ডশিপ লাইন’ মেনে নেয় কিন্তু এটি চূড়ান্ত করার জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষর দরকার ছিল সেটি করা হয়নি।

ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের জন্য একাধিক বৈঠক করেছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে কোনও ধরনের সমঝোতা ছাড়াই শেষ আলোচনা হয় ১৯৮০ সালে।

২০০৫ এ তেল, গ্যাস ব্লক সমস্যা ২০০৫ এ তৎকালীন বিএনপি সরকার বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্লক নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়। মজার বিষয় হচ্ছে যে বিএনপি সরকার ১৯৭৯ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ লাইন মেনে নিয়েছিল, তারাই ২০০৫ এ সেই লাইনের বাইরে গিয়ে ব্লক নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়।

পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মোট ২৮টি ব্লক ঘোষণা করলে মিয়ানমার ও ভারত উভয়ই এর প্রতিবাদ করে। ২৮টি ব্লকের মধ্যে মিয়ানমার ১৭টি এবং ভারত ১০টি ব্লক তাদের অঞ্চল বলে দাবি করে। এ কারণে বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটি ব্লক ২০১০ সালে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপসকে দিতে সক্ষম হয়।

২০০৯ এ মামলা

২০০৮ এ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। সরকার গঠনের পরে সমুদ্র সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দীর্ঘ ৪০ বছরে সমুদ্রের মাত্র ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকেও কম অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ছিল। অর্থাৎ এ বিশাল সমুদ্রের সম্পদ আহরণের কোনও উপায় ছিল না বাংলাদেশের।

এ প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে ২০০৯ এর এপ্রিল মাসে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক কোর্টে মামলা করার।

প্রাথমিকভাবে এ সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র পাঁচজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

মামলা করার এ সিদ্ধান্ত নেওয়াটি ছিল কঠিন কিন্তু যুগান্তকারী। কয়েকটি কারণে এটি অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ ছিল।

এক. বাংলাদেশ জানতো মামলা করার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণে জড়িত সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আদালতকে দিয়ে দিতে হবে।

দুই. আদালতের রায় সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল অর্থাৎ রায়ে কম অঞ্চল পেলেও সেটি বাংলাদেশকে মেনে নিতে হতো।

তিন. ভারতের মতো একটি বৃহৎ প্রতিবেশীকে আদালতে নিয়ে যাওয়ায় দিল্লির প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত ঝুঁকি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এপ্রিল মাসেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এবং অতিরিক্ত সচিব এম খোরশেদ আলম এদের মধ্যে ফলি হগ ফার্ম, জেমস ক্রফোর্ড, অধ্যাপক আল্যান বয়েল, অধ্যাপক ফিলিপি স্যান্ডস, অধ্যাপক লিন্ডসে পার্সন, রবিন ক্লেভারলি, পল রিখলার, লরেন্স মার্টিন এবং পায়াম আখাভান আলোচনা করেন এবং পরবর্তীতে তারা বাংলাদেশের আইনি টিমে যোগ দেন। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনা শেষ করে মে মাসে এ আইনি টিম গঠন করা হয়।

গোটা প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গোপনীয়তা এবং দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে কারণ, মিয়ানমার বা ভারত যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেত বাংলাদেশ তাদেরকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তবে তারা এ আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি তাদের যে স্বীকৃতি সেটি প্রত্যাহার করে নিতো।

অক্টোবর ৯, ২০০৯

আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সমুদ্র সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। আর এ আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য ইটলস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর। সীমানা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ অন্য আন্তর্জাতিক আদালতেও যেতে পারতো কিন্তু আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল বেছে নেওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল এ আদালতে মামলা করতে অন্য পক্ষের সম্মতি বা অবহতির প্রয়োজন হয় না অর্থাৎ বাংলাদেশ মামলা করলেই এ মামলায় পক্ষ হতে ভারত ও মিয়ানমার বাধ্য থাকবে।

অক্টোবরের ৯ তারিখের আগে ভারত ও মিয়ানমার এ মামলা করার বিষয়ে কোনও কিছু জানতো না। ইটলসকে আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি একই দিনে ঢাকায় আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয় ভারত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে। কোনও কারণ ব্যাখ্যা না করে দুই রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মামলায় বাংলাদেশের পক্ষে প্রধান এজেন্ট দীপু মনি প্রথমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার দফতরে কথা বলেন এবং মামলার নথিপত্র (স্টেটমেন্ট অব কেস) ও মামলা বিষয়ে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পত্র তাকে হস্তান্তর করেন। যে মুহূর্তে দীপু মনি মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলছেন সেই মুহূর্তে ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাসেও এ মামলার নথিপত্র (স্টেটমেন্ট অব কেস) ও বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পত্র হস্তান্তর করা হয় এবং দূতাবাস যে এ ডক্যুমেন্টগুলো পেয়েছে সেটির প্রত্যয়ন স্বাক্ষর নিয়ে নেওয়া হয় যাতে করে মিয়ানমার পরবর্তীতে অস্বীকার করতে না পারে যে তারা কোনও কাগজপত্র পায়নি।

মিয়ানমার রাষ্ট্রদূত চলে যাওয়ার পরে ভারতের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেন দীপু মনি এবং একই প্রক্রিয়ার ভারতীয় দূতাবাসে মামলার নথিপত্র (স্টেটমেন্ট অব কেস) ও মামলা বিষয়ে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পত্র হস্তান্তর করে প্রত্যয়ন স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পত্রের উত্তরে একটি দেশ আন্তর্জাতিক আদালতে তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লিখিতভাবে বাংলাদেশকে অসন্তোষ জানিয়ে লিখেছিল, তোমরা আমাদের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছ (ইউ হ্যাভ স্ট্যাবড অন আওয়ার ব্যাক)।

এছাড়া মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আদালত থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেটি সফল হয়নি। পরবর্তীতে মিয়ানমার মামলাটি ইটলসে মীমাংসা করতে চাইলে বাংলাদেশ পক্ষ থেকে কোনও আপত্তি করা হয়নি। অন্যদিকে, দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিষয়টি সমাধানের প্রস্তাব করেছিল ভারত। সেসময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যার বিষয়ে আগ্রহ দেখানো হয়নি।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ