X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার ও সুশীল সমাজের প্রতি

জাহানারা নুরী
২৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:৪৫আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১২:১১

জাহানারা নুরী বাংলার লোকসমাজ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ করছে, সরকার মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। কওমিপন্থীদের সঙ্গে সরকার প্রধানের বৈঠকের নানা ছবিও দেখছি। আশঙ্কা হচ্ছে মৌলবাদের ফাঁদে সরকার আটকে পড়েছে কিনা!
প্রধানমন্ত্রী এককভাবে কোনও দলের, ভাবধারার, আদর্শের নন। তিনি একটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের প্রধান, যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান হলেও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীও এ জনপদের অংশ। এ দেশ বহু ধর্মের, মতের ও পথের। এই রাষ্ট্রের সংবিধানে জাতিবৈচিত্র্যও স্বীকৃত। এর রক্তঝরা ইতিহাসে লিখিত রয়েছে ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া, লোকজীবনাচরণ-চর্চা। রয়েছে এই চর্চার সঙ্গে ধর্মীয় চরমপন্থীদের সংঘর্ষের তথ্যও। বহু এক নায়কের, সামরিক শাসকের নিপীড়নেও বাঙালি তার কৃষ্টি, আচার বদলে ফেলেনি। আমি বিশ্বাস করি না, বাঙালিকে দিয়ে তা করাতে চাইছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আওয়ামী লীগ।
আশঙ্কার কথা হলো, সরকার বিগত কয়েক বছরে যা কিছু পরিবর্তনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, তার অধিকাংশই বিস্ময়করভাবে লীগের ওপর স্থাপিত গণ-আস্থার বিপরীত।  অনেকটাই ২০১৩ সালে হেফাজত ও তাদের জোটের উত্থাপিত তের দফা দাবিরই বাস্তবায়ন। জনপ্রতিনিধিরা ভুলে গেছেন যে, তাদের গৃহীত একটি ছোট্ট ভুল পদক্ষেপের সুযোগে-দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় তাদেরই হাতে জনগণের তুলে দেওয়া ক্ষমতার ভাগের ছিঁটেফোঁটা ভোগকারী একক ও দলীয় অশুভ শক্তিগুলো জনগণকে নিপীড়নের সীমাহীন ক্ষমতা অপব্যবহারের অবাধ স্বাধীনতা লাভ করে।  
মৌলবাদী ধারা ইসলামের অসংখ্য সেক্টরের একটি। বাংলাদেশের মৌলবাদ স্পষ্টত সৌদি ওয়াহাবি বা সালাফিবাদ, যা প্রচারিত হচ্ছে জামায়াত ইসলাম ও তার সহ-সংগঠনগুলো দ্বারা। পাকিস্তানভিত্তিক এ সংগঠনটির রাজনীতির একটিই লক্ষ্য—ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের হাতকে দীর্ঘ করা।

এর নিকৃষ্টতম উদাহরণ দেশে দেশে রয়েছে। সৌদি আরবে গতবছর একটি বিদ্যালয়ে অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচতে ছাত্রীরা বেরিয়ে আসতে শুরু করলে কয়েকজনের মাথায় হিজাব না থাকায় তাদের জ্বলন্ত ভবনে ফের ঢুকে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করে সে দেশটির পুলিশ। মৌলবাদী ইসলামি রাষ্ট্র পুলিশি রাষ্ট্র, সামরিক রাষ্ট্র। ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি রাষ্ট্র বহাল হওয়ার পর থেকে দেশের বাহাই সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এসব রাষ্ট্র দেশের উন্নয়নে নারীর মেধা ও শ্রমকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাজে লাগায় না। বেশিরভাগ ধর্মীয় কেতাব পড়ুয়া পুরুষের দক্ষতা চলতি শ্রমবাজারের অনুপযুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রেও বর্তমানে দেশ চালনায় মৌলবাদী ইসলামের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এককালের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সমাজ ও পরিবার আজ ধ্বংসের মুখে। ইরাক, আফগানিস্তানের মৌলবাদী আইনগুলো কোটি মানুষের শ্রমে ও প্রেমে গড়া সমাজ, পরিবার ও জনপদকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। নিজ পায়ে ফের ঘুরে দাঁড়াতে এসব জাতি কঠিন বাধার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। উদার গণতন্ত্র থেকে এসব দেশের এমন পতনের কারণ সরকারগুলো মডারেট নাগরিকদের দাবিয়ে রেখে মৌলবাদীদের বাড়তে দিয়েছে। রাজনীতিবিদরা হাতে ধরে দেশকে চূড়ান্ত দারিদ্র্যের ও নাগরিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছেন।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়  ২০০৪ সালে একটি জনমত জরিপ চালায়। ওই জরিপে উঠে এসেছে,  ধর্ম বিষয়ে সরকারে কোনও বিশেষ ভূমিকা পালন করা উচিত কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে মুসলিম দেশগুলোয় ৪৯% উত্তর ছিল, ‘ধর্ম ও সরকার পরস্পরকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে একে অন্যের অধিকার, ভূমিকা ও দায়ি-দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’ সাম্প্রতিক জরিপে প্রকাশ, ৫৫% ভাগ ইরাকি মনে করেন, ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা থাকলে ইরাক উন্নততর দেশ হতো।

বাংলাদেশ তুলনায় অনেক বেশি উদারনৈতিক রাষ্ট্র ছিল। এখনও ‘রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা থাকবে’—এই মতের সমর্থকদের মাঝে আমরা একটি দল দেখে আসছি, যারা রক্ষণশীল হলেও বিশ্বাস  করেন আল্লাহর একটি ভূমিকা তাদের জীবনে থাকা উচিত। রাষ্ট্রের ধর্ম থাকবে কিনা, এ বিতর্কে তারা অংশগ্রহণ করেন না, দ্বিমতও প্রকাশ করে  না। মধ্যপন্থী  জনগণের এ দৃষ্টিভঙ্গি উদারনৈতিক গণতন্ত্রে দেশ পরিচালনারই পক্ষে।

গভীর সংকটের আবর্তে চলা এ সময়ে এই মধ্যবর্তী উদার মুসলিমদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা ইসলামের মৌলবাদী, মৌলবাদীদের সমর্থন ও সহায়তা না যোগাতে রক্ষণশীলদের প্রতি আহ্বান রাখুন। মৌলবাদের চাপে নতি স্বীকার না করতে সরকারের কাছে দাবি তুলুন। এতকাল আপনারা নীরব নাগরিকদের অংশ ছিলেন। খেয়াল করুন, মৌলবাদীরা যদিও সংখ্যাল্প, তবু তারা অর্থ জোগাড় করেছে, টেকনোলজির ওপর দখল নিতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া তারা অত্যন্ত চতুর ও জিঘাংসু আত্মঘাতী দলবল গড়ে তুলেছে।   আমাদের রাষ্ট্রের ও সমাজের নানা জায়গায় তারা ওঁৎ পেতে আছে, সাধারণ মানুষের মনে দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। ইসলামি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আজ এদের ‍বিরুদ্ধে প্রত্যেক মধ্যপন্থী মুসলমানকে রুখে দাঁড়াতে হবে।

আমরা যদি মানবাধিকারের সমস্ত শর্ত পূরণ করে দেশ পরিচালনা ও আইনের ন্যায্য শাসন প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিকে বাধ্য করি, তবে মানবিকতা শিক্ষা, মানবাধিকার চেতনা প্রসারের মাধ্যমে আমরা এমন গণতান্ত্রিক রিপাবলিক ও সামাজিক নৈতিকতা গড়ে তুলতে সক্ষম হব, যা ধর্মাচরণকেও মূল্যবান করে তুলবে। সামাজিক, আর্থিক, গোষ্ঠীর ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের নানান উপাদান একত্রে লোকসমাজের নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে তোলে।   

উদার গণতন্ত্রের পক্ষের মডরেটদের তারা ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে তাদের মনে এই ভয় জন্মাতে চায় যে, ‘রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা’ভাবলেই বুঝি মুসলমানিত্ব কমে যাবে। আজ থেকে শত শত বছর আগে খ্রিস্ট ধর্মের জগৎ ঠিক একই দ্বিধার ভেতর দিয়ে গেছে। সাধারণ ধার্মিকগণ খ্রিস্টীয় মৌলবাদীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। সিভিল আইনে রাষ্ট্র চলা এবং ধর্ম ব্যক্তিজীবনে থাকার মানে কিন্তু ইসলামকে জীবন থেকে আলাদা করা নয়। এভাবেই প্রতিটি ধর্মের স্বাধীনতাকে ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার বিপজ্জনক ভুলের মাশুল  আজ বাংলাদেশ দিচ্ছে। ইসলামে ধর্মীয় মত ও পথের ব্যাখ্যা মূলত চারটি ও তার সেক্ট প্রায় বায়াত্তরটি। প্রতিটি মাজহাব ও সেক্টকেই মেনে রাষ্ট্রের ধর্ম হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে একটি মাজহাব বা পন্থাকে গ্রহণ করতে হয় এবং অন্য মাযহাবগুলোকে অমান্য করতে হয়, যা ধর্মোচিত নয়।

মৌলবাদীরা যেহেতু মনে করে যে বাদশাহ আলমগীরের পর থেকে বিগত আড়াই শত বছর তারা গণতান্ত্রিক সরকারের নিগ্রহে জীবনযাপন করছে। সরকার এ অভিযোগ আমলে নিয়ে সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্র ও সরকার থেকে আলাদা করার প্রয়াস গ্রহণ করাই সঙ্গত। সরকারের অধীনে থাকলে যদি ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সরকার ও সরকারি অর্থায়ন থেকে তার দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে সরকার যদি ধর্মকে অবমূল্যায়ন করে থাকে, তাহলে রাজনীতিও ধর্মকে অপব্যবহার করেছে, সেটিও বন্ধ করতে রাজনীতি থেকে ধর্মকে প্রত্যেকে দূরে রাখতে হবে।

ইসলামের মৌলিক দর্শনের মূল বক্তব্য হলো প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের কাজের জন্য স্রষ্টার সামনে জবাবদিহি করবে ও সাজা কিংবা পুরস্কার পাবে। সুতরাং চূড়ান্তবিচারে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের কাজের জন্য ধর্মের নামে মুক্ত।  একইসঙ্গেহ নিজ নিজ ধর্মের কাছে দায়বদ্ধ।  

মৌলবাদীদের ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবির কেন্দ্রে রয়েছে রাজনীতি হবে শরিয়া মোতাবেক। অর্থনীতি চলবে একনায়কের হাতে। ইসলামি রাষ্ট্রের জনগণ তাদের পুরস্কার পাবে মৃত্যুর পর বেহেশতে গিয়ে। এ প্রস্তাবনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কুরআন এক অর্থে মুসলমানকে স্বাধীনতা দেয় নির্ধারিত নিয়মের অধীনে ধর্মপালনের। ইসলামি রাষ্ট্র এই স্বাধীনতা প্রমাণে ব্যক্তিকে বাধা দেয়, কেননা রাষ্ট্র যারা চালান, সেই ব্যক্তিবর্গের ব্যাখ্যা করা নিয়মে ব্যক্তিকে চলতে হয়। ইসলামি রাষ্ট্রে কিভাবে ব্যক্তি তাহলে তার ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার উপভোগ করবে?

রাষ্ট্র বিশেষ ধর্মের প্রভাবে চলতে থাকলে ও ধর্মের বাইরের জনগণের প্রতি ন্যায় আচরণ করার নিশ্চয়তা নেই। ইসলামি রাষ্ট্রের দাবিদার ছাত্র শিবির ও অন্যান্য ইসলামি দলের অনলাইনে ও প্রকাশ্যে প্রায় এই যুক্তিহীন তর্ক ওঠে যে, বিশ্বে অনেক বেশি রক্তাক্ত যুদ্ধ ঘটেছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে। কিন্তু অন্যান্য কারণে ক্রুরতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বলেই ধর্মের গায়েও রক্তবন্যার অনুরূপ কালিমা লেপন করতেই হবে মুসলমানকেও? মানুষের ওপর একই চরম অন্যায় যদি ধর্মের হাত দিয়েও সংঘটিত হয়, তবে ধর্ম পার্থিব অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে আলাদা কোনও মর্যাদার দাবিদার হতে পারে কি? অন্যান্য বৈষম্যের মতোই একটি চরম বৈষম্যমূলক ব্যাবস্থা হয়ে ওঠে না কি?

সম্ভবত মডরেটরা তাদের শত্রু নয়, রক্ষণশীলদের এটা বোঝাতেই আওয়ামী লীগ সরকার মৌলবাদীদের সঙ্গে করমর্দন করছে। কিন্তু কিভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে সে আলোচনায় না গিয়ে সরকার ও মৌলবাদী বন্ধুত্ব বর্তমানে মানুষের যে সামান্য স্বাধীকারটুকু ছিল সেটুকুও ছিনিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি তারা প্রজন্মের জ্ঞানের অধিকার সীমিত করছে।

সিভিল সরকার থেকে ধর্মকে দূরে রাখার আমাদের যে দাবি তার বিরোধিতায় দাঁড়িয়েছে আমাদেরই নির্বাচিত সরকার এবং চরমপন্থী ও রক্ষণশীল মোল্লারা। উভয়পক্ষই যেকোনও সময় চরমপন্থীতে পরিণত হতে বাধ্য।

এটিও বিচার্য যে, এ যাবত যত দেশ, রাষ্ট্র ও সরকার থেকে ধর্মকে আলাদা করতে চেয়েছে, তারা কম বেশি ধর্মের প্রতিকূলেই  কাজ করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি ধর্মের পক্ষে থেকেও রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ সিভিল আইনে চালানোর একটি সৃজনশীল পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। তা একমাত্র শেখ হাসিনাই নিতে পারেন। তা বিশ্বে অনন্য নজির রূপে স্থাপিত হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ