X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

তেঁতুল হঠাৎ মিষ্টি হলো

শান্তনু চৌধুরী
২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:২৭আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৩২

শান্তনু চৌধুরী ‘তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা-তেঁতুল বড় টক, তোমার সাথে প্রেম করিতে আমার বড় শখ’। স্কুল জীবনে এক ছেলের ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রেমপত্রে প্রথম এই লাইনগুলো দেখি। পরে জানলাম এটা গানের লাইন। তো সেই যৌবন বেলায় প্রথম প্রেমপত্র খুব একটা সফলতা পায় না বলে প্রেম করার শখ পূরণ হয় না। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে সেটা পরিপূর্ণতা পায়। এই যেমন হেফাজত ইসলামের প্রেম এখন পরিপূর্ণ। সবকিছু তারা ধীরে ধীরে পেতে যাচ্ছে। যে হেফাজতকে ধ্বংসলীলার কারণে ‘পেদিয়ে’ তাড়াতে হয়েছে তারাই এখন রীতিমতো গণভবনে এসে ‘দাওরায়ে হাদিস’ এর মাস্টার্স সমমান সম্মাননা নিয়ে ফিরে গেছে। গ্রামীণ একটা প্রবাদ আছে, ‘আগের জুড়ি গাড়ি যেদিকে যায়, পরেরগুলোও সেদিকে যায়’। তো গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসের পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীতো বটেই মন্ত্রীরা পর্যন্ত হেফাজতের নানা প্রশংসা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন, আরো একদল এক কাঠি সরেস। বিজ্ঞের মতো মন্তব্য করছেন, ‘শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখুন’। আমরাও আস্থা রাখতে চাই বলেই এই লেখা। আবার বেশি আস্থা আছে বলেই না বেশি ভয়। কে না জানে দুধ কলা দিয়ে কালো সাপ পোষার পরিণতি ওঝাকে কিভাবে বহন করতে হয়। হেফাজত না আবার সেরকম হয়।
নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাতিলসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫মে ঢাকা অবরোধের পর বিকেলে মতিঝিলে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতকর্মীরা। ভোররাতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের তুলে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে সময় অবশ্য বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাদের না ওঠার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘সরকারের পতন ঘটিয়ে ঘরে ফিরতে’। তুলে দেওয়ার আগে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত মতিঝিল থেকে পল্টন এলাকায় চলে হেফাজতকর্মীদের তাণ্ডব। বহু প্রতিষ্ঠান, দোকান, গাড়ি পুড়িয়ে দেয় তারা, কেটে ফেলে সড়ক দ্বীপের গাছ, উপড়ে ফেলে সড়ক বিভাজক। এমনকি রাস্তায় বিক্রি করা নানা বইয়ের সঙ্গে তাদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় পবিত্র কোরআন শরিফও। ওই তাণ্ডবে ২০টি ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সংসদে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বক্তব্যে তাদের এই তাণ্ডবের উপস্থাপনা করেছিলেন।

ওই ঘটনার চার বছর পর গত ১১ এপ্রিল গণভবনে হেফাজতের আমীর আহমদ শফীসহ কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট আলেমদের নিয়ে বৈঠক করে ‘দাওরায়ে হাদিসকে’ স্নাতকোত্তরের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠক থেকে হেফাজতের দাবি মেনে সুপ্রিম কোর্টে স্থাপিত রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’র ভাস্কর্য সরানোরও আশ্বাস দেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় দুই ঈদের সময় এই ভাস্কর্যটি ঢেকে দেওয়া হবে কাপড় দিয়ে। অনেকে অবশ্য ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য না বুঝে দুটিকে গুলিয়ে ফেলে না ‘হিন্দুয়ানী’ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তারা আম পাবলিক বা খুচরো  নেতা। এখন সেই দলে শামিল হয়েছেন সরকার দলীয় মন্ত্রী-এমপি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম বলেছেন, ‘জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কারণ আমরা জনগণের মন পেয়ে নির্বাচিত হতে চাই।’ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা স্বীকৃতির হকদার। আওয়ামী লীগ তাদের নিয়ে রাজনীতি করতে চায় না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে হেফাজতের কোনও সম্পর্ক নেই। লাখ লাখ ছাত্র যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং দ্বীনের কাজ করতে পারে তাই এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।’ তবে এদের সবার চেয়ে এককাঠি সরেস নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের আলোচিত এমপি শামীম ওসমান। তিনি ‘নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান’কে রীতিমতো এক করে দাবি করলেন ‘চার বছর আগে রাজধানীর মতিঝিলে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল, তার সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীরা জড়িত নয়।’ তার মতে, ‘ওখানে জামায়াত যাইয়া ঢুইকা গেছিল। সে কারণে মামলা খাইছে হেফাজতের লোকেরা। ঘটনা ঘটাইছে জামায়াতের লোকেরা।’ হেফাজতের সঙ্গে নিজের অমিল নেই বলেও স্বীকার করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। সেই মঞ্চে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, হেফাজতসহ স্থানীয় অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। পেশাগত কারণে সেই বক্তব্যের পুরোটা শোনা হয়েছিল আমার। ওয়াজের সুরে সুরে বলা সেই বক্তব্য যদি শামীম ওসমানকে ‘না জেনে’ কেউ শুনে থাকেন তবে তা ‘বিশ্বাস’ করতে বাধ্য। কারণ সেই বক্তব্যে আকর্ষিক আবেগ রয়েছে। তবে সেখানে একটি কথা বেশ ভালো লেগেছে আর তা হলো, ‘মন্দির গির্জা বা চার্চের ওপর আঘাত এলেও তা রুখে দাঁড়ানো হবে।’

হেফাজতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ দাবিদার আওয়ামী লীগের এই সখ্যে কিছুটা শঙ্কিত নিরপেক্ষ সাধারণ মানুষ। তারা সাগরের মাঝে হয়তো নৌকাকে আঁকড়ে ধরে আছে। কিন্তু হেফাজতের হাওয়ায় সেটা দুলে ওঠলে তাদের ভয় হয়। কূলে এমন কেউ নেই যাদের ওপর ভরসা করা যায়। কারণ তারা জানে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কতো বড় বড় ঝড় গিয়েছে, সবকিছুই সামাল দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বড় বড় বিদ্রোহ, তাণ্ডব, প্রাকৃতিক ঝড়ের পরও মানুষ আশ্রয় খুঁজেছে আওয়ামী লীগের কাছে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগের নৌকা যদি ‘হেফাজতের’ মতো হাওয়ায় দুলে ওঠে তবে শঙ্কা জাগে বৈকি!

চট্টগ্রামে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সেই শঙ্কার কথাই জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম। তিনি দক্ষিণপন্থী ধারার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতাকে আশঙ্কা হিসেবে দেখছেন। কারণ এই হেফাজত পাকিস্তানি নেজামী ইসলামী পার্টির উত্তরাধিকারী। মনে পড়ছে আহমদ ছফার লাইনগুলো, ‘আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগ জিতবে। আর তারা হারলে সমগ্র দেশ ও জাতি হেরে যায়।’ কতটা সত্য জানি না, হেফাজত নাকি যতোবার আন্দোলনের হুমকি দেয় ততোবার তাদের রেলের জমি, টাকা বা নানা উপঢৌকন দিয়ে বশ করা হয়। বাংলাদেশকে অন্ধকূপে ফেলতে তারা এখন গণভবনে পৌঁছে দেন-দরবার করছে এবং সফল হয়েছে। তার একটি কারণ সম্ভবত আগামীতে ভোট।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘২০১৮ সালের শেষ বা ২০১৯ সালের প্রথম’ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।’ আগে জনস্বার্থে নানা আন্দোলন করতো বামদলগুলো। এদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন কম হয়নি। কিন্তু এখন আর তারা ‘কোনও বিষয়’ না। ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোকে কাজে লাগাতে চায় প্রতিটি দল। অথচ এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার প্রত্যাখান করেছিলেন সাধারণ মানুষ। সে কারণে দীর্ঘ সময় জামায়াত ইসলামী শক্তিশালী হতে পারেনি। ১৯৭২ সালের ৭জুন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’

হেফাজত নেতা আহমেদ শফী মেয়েদের ‘তেঁতুল’ এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বলে তাকে বলা হয় ‘তেঁতুল হুজুর’। তো এই ‘তেঁতুল হুজুর’ যখন নারী নেতৃত্ব হারাম বলেন তখন তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করলেন কেমন করে?’ তাদের জবাবটা ছিল শোনার মতো। ‘প্রধানমন্ত্রী নারী নন, আমরা বৈঠক করেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে’! জহির রায়হানের একটা কথা ‘সময়ের প্রয়োজনে’ আমার বেশ প্রিয়। সময়ের প্রয়োজনে কতকিছুই না করতে হয়। সময়ের প্রয়োজনে টক তেঁতুলও মিষ্টি বলে গিলে ফেলতে হয়। তবে সেই প্রয়োজন যাতে সময়কে টেনে অন্ধকারে নিয়ে পিছিয়ে না দেয় আমাদের নেত্বত্ব সেটা খেয়াল রাখলেই জনগণের মঙ্গল।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ