X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাস্থ্যসেবা: সবখানে টাকাটাই শেষ কথা

নাদীম কাদির
২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৩০আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৪১

নাদীম কাদির কয়েক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ রকমের অ্যালার্জি সমস্যায় ভুগছিলাম। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পর যখন এই লেখাটি লিখতে বসি, তখন লন্ডনের চিকিৎসাসেবা নিয়ে আমার খুব রাগ হচ্ছিল। ভাবছিলাম, লন্ডনে যথাযথ চিকিৎসা করানোর মতো যথেষ্ট টাকা আমার কাছে নেই কেন? নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা আর অন্যদের অভিজ্ঞতার গল্প শুনে উপলব্ধি করলাম, ঢাকায় বিনামূল্যের চিকিৎসা আর লন্ডনের বিনামূল্যের চিকিৎসা একই ধরনের।
ব্রিটেনের বাসিন্দাদের জন্য বিনামূল্যের যে চিকিৎসাসেবা রয়েছে তাকে বলা হয় ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)। যারা টাকা দিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে অক্ষম তাদের জন্য এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যে ক্রমাগত এই ধরনের চিকিৎসা সেবার মান কমছে।
আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ছুলির মতো হয়েছিল এবং তা খুব চুলকাতো। আমি বার বার এনএইচএস-এর চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছিলাম। আমাকে অ্যান্টি বায়োটিক ও অ্যান্টি হিস্টামিন দেওয়া হলো। বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা রক্ত পরীক্ষা দিতে রাজি হলো না। খাবার কিংবা পোকার কামড় থেকে ওই অ্যালার্জি হয়েছে ধারণা করে তারা আমাকে ওষুধ দিয়েছিল।
অসহ্য হয়ে আমি মধ্য লন্ডনের বিইউপিএ ক্রোমওয়েল হাসপাতালের শরণাপন্ন হলাম। রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হলো। আমি শারীরিক পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় এবং অস্থিরতাজনিত মানসিক সমস্যা (অ্যাংজাইটি অ্যাটাক) হওয়ায় ফলাফল পাওয়ার আগেই আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো।
রক্তচাপ কমিয়ে আনতে আমাকে অ্যান্টি-বায়োটিক, অ্যান্টি-হিস্টামিন ও বিভিন্ন ওষুধ দেওয়া হলো। জরুরি ভিত্তিতে করা একটি রক্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বোঝা গেলো রক্ত প্রণালীতে সংক্রমণ ও অ্যালার্জিজনিত চাপ তৈরি হয়েছে। এরপর অনেক খরচের বিনিময়ে বিইউপিএ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ফলাফল পাওয়া গেলো। তারা নিশ্চিত করলো, পোকার কামড়ের কারণে এ অ্যালার্জি হয়েছে।
এই মৌসুমে বিভিন্ন কারণে ব্রিটেনে অ্যালার্জির সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা দেয়, আমাকে পোকামাকড়ের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে... ইত্যাদি ইত্যাদি বলে চিকিৎসকরা আমাকে শান্ত করলেন। আমার স্বদেশীরা এর জন্য ছারপোকাকে দায়ী করলেন। ইংল্যান্ডে ছারপোকা খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও আমার বাড়িতে কোনও ছারপোকা পাইনি।
আমাকে আরও বলা হলো, এ ধরনের কামড়জনিত অ্যালার্জি সারতে সময় লাগে। যথারীতি ওষুধ চলতে লাগলো এবং আমিও সেরে ওঠার আশায় বুক বেঁধে রাখলাম। এবার আমি এক অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলাম। বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিতে গেলে আমার প্রায় গোটা মাসের বেতনই শেষ হয়ে যায়!
কিন্তু কেউ যদি ভালোভাবে এবং দ্রুত সুস্থ হতে চায় তবে টাকা ছাড়া উপায় নেই। সেকারণে ঢাকায়ও সরকারি স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে এবং আমরা যখন চিকিৎসকদের কাছে বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিতে যাই তখন অনেক ফি দিতে হয়। বিনিময়ে আমরা যথাযথ চিকিৎসা পাই।

তবে আমি মনে করি মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। এখনও অনেক কিছুতে উন্নয়ন আনার প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও মেডিক্যাল কলেজগুলো দারুণ কাজ করছে। আমাদের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের আরও বেশি নিবেদিতপ্রাণ হওয়া প্রয়োজন। তাদের আচরণ ভালো হওয়া প্রয়োজন।

সরকার সমর্থক নেতারা আমাদের দেশের চিকিৎসকদের কিছু কিছু অর্জনের প্রশংসা করে থাকেন। অত্যাবশ্যক হয়ে না উঠলে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদেরকে বিদেশে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করারও আহ্বান জানিয়ে থাকেন তারা।

এবার আরেক ভুক্তভোগীর কথা বলি। এনএইচএস-এ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আমার এক সহকর্মী তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। আমার সহকর্মীর অভিযোগ, তার স্ত্রীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে এনএইচএস-এর চিকিৎসকদের ব্যাপক অসাবধানতা ছিল; আর এর কারণে ধীরে ধীরে অকাল মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে তাকে।

আমার সহকর্মীর স্ত্রীর নাম চয়নিকা মনির (সাহা)। স্ত্রীকে হারানোর পর এখন দুই শিশু সন্তান আর চাকরি সবকিছু একসঙ্গে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন আমার সেই সহকর্মী। এনএইচএস-এর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, ‘তারা অনৈতিক মেডিক্যাল চর্চা করেছেন, বর্ণবৈষম্য করেছেন, চিকিৎসায় অবহেলা করেছেন এবং অপেশাদারিত্বের সঙ্গে চিকিৎসা চর্চা করেছেন’।

২০১৫ সালের নভেম্বরের ২ তারিখে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন আমার সহকর্মীর স্ত্রী। আর প্রসবোত্তর বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে এবং সন্তোষজনক চিকিৎসা না পেয়ে পরের বছরের অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৭ মে তিনি মারা যান। সিজারিয়ান অপারেশন হওয়ার সময় তার মূত্রথলির ৬ মিলিমিটারেরও বেশি কেটে ফেলা হয়েছিল। অথচ কোনও ধরনের অনুশোচনা প্রকাশ না করেই পরের দিনই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

স্বামী-স্ত্রী দুইজনই বাংলাদেশি সরকারি চাকরিজীবী। এখন স্ত্রী নিহত হওয়ার ঘটনায় ন্যায়বিচার চাইছেন স্বামী। কিন্তু স্ত্রীকে তো আর ফিরে পাবেন না তিনি। জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। খুব কাছ থেকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না যে কতটা কষ্ট বুকে চেপে রেখে দিন পার করছেন তিনি। লন্ডনে তার এমনই দুর্ভাগা জীবন।

তবে যদি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য থাকতো, তার জীবনটা আজ হয়তো ভিন্নরকম হতে পারত। পরিবারে নতুন এক অতিথির আগমনকে উদযাপন করতে পারতেন তারা।

হে খোদা, যাদের ভাগ্যে পর্যাপ্ত টাকা পয়সা জোটেনি, আপনি তাদের সহায় হোন।

লেখক: সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ