X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণের জন্য রাজনীতি করুন

লীনা পারভীন
২৮ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৩১আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৫০

লীনা পারভীন ভোটের মাধ্যমেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল হয় তাই ভোটের রাজনীতিকেই অগ্রাধিকার দেবে সবাই।  এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সব কি এই ভোটকে কেন্দ্র করেই হয়? নাকি হওয়া উচিত? তাহলে দেশ কোথায়? বাস্তবে এখন দেশে যা চলছে তাতে করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাটা একজন নাগরিক হিসাবে আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।  এই দেশে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিরোধীদল বা অন্যান্য দলের যা কার্যক্রম বা যেসব কৌশল তারা নিচ্ছেন এর সবই নাকি ভোটকে কেন্দ্র করে।  অর্থাৎ সামনে যে নির্বাচন আসছে তাকে সামনে রেখে সবাই এখন যে যার গণিত কষতে ব্যস্ত।
এই মুহূর্তে ক্ষমতায় আছে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ; যে দলের নেতা ছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।  আমরা সবাই জানি শেখ মুজিব ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক নেতা যিনি এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।  জীবনের বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে কারাগারে।  এর একটাই কারণ, তিনি আপোস করেননি তার দেশের জনগণের মুক্তির দাবির সাথে।  তিনি যদি আপোস করতেন তাহলে তিনিও পেতেন একটি  আয়েশের জীবন, হয়তো দীর্ঘকাল ক্ষমতায়ও থাকার বন্দোবস্ত করতে পারতেন।  কিন্তু তিনি তা করেননি।  আপোসের চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় জ্ঞান করে তিনি চিরকাল লড়াই করে গেছেন।
শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় শক্তির নাম ছিল বাঙালি জাতি আবার তার সবচেয়ে দুর্বলতার নামও ছিল এই বাঙালি।  সেই শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ তেইশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে।  খুব বেশি আশাব্যঞ্জক না হলেও ১৯৭৫ পরবর্তী দোলাচলের বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা একটি দলের ক্ষমতায় আসাটা ছিল অনেক বেশি প্রত্যাশার।  পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে জনগণ আবার স্বাদ পরিবর্তনের অংশ হিসাবে বেছে নিয়েছিলো বিএনপিকে।  সেই সময়কার শাসনামল আমাদের সকলের কাছেই পরিচিত। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে।  বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।

 স্বাধীনতা পর বাংলাদেশে এত লম্বা সময় ধরে আর কোনও নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেনি।  বিতর্কিত হলেও সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় আসাকে জনগণ কিন্তু একদম দ্বিধাহীন না হলেও মেনে নিয়েছিল।  এর পেছনে অনেক রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ কাজ করেছে।  সবচেয়ে বড় যে হিসাবটি কাজ করেছে জনগণের সেটি হচ্ছে, যুদ্ধপরাধীদের বিচার আর আওয়ামী লীগের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখা।

তাই এই আওয়ামী লীগের ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে তারা ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্রান্তিকাল পার করছি আমরা।  সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবকিছু মিলে এরকম অস্থির সময় জাতির জীবনে আর ছিল কিনা জানি না।  একদিকে জনগণ আস্থা খুঁজে পাচ্ছে না তারা আদৌ স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে কী পাচ্ছে না।  অন্যদিকে ক্রমশ সরকারের আপোসকামীতার মনোভাব আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলছে নানাবিধ প্রশ্ন।  জনগণ কোনদিকেই সংশয়হীণ থাকতে পারছে না সরকারের ভূমিকা নিয়ে। দিনে দিনে যেন সেই কুয়াশা আরও ঘন হয়ে আসছে।

সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা আমাদেরকে আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।  মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ বিরোধী সরকারকে আমরা দেখলাম হঠাৎ করেই যেন নত হয়ে পড়ছে আরেক মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী হেফাজতের কাছে। সবাই জানি হেফাজতের জন্মের ইতিহাস।  ২০১৩ সালে এই সংগঠনটি অন্য দলের পকেটে ঢুকে নিজেদের পকেট ভারী করা ছাড়া আর কোনও কাজ করেনি, নেই কোনও অর্জনের ইতিহাস।  তারা কখনোই এদেশের স্বাধীনতা, শিক্ষা সংস্কৃতি বা ইতিহাসকে ধারণ করেনি।  বিএনপির পকেটে থাকা হেফাজত তাই হঠাৎ করেই হয়ে গেলো আওয়ামী লীগের অত্যন্ত কাছের একটি গোষ্ঠী।  এমন কাছের যে এখন সরকারের মন্ত্রী এমপিরাও তাদের মুখপাত্র হয়ে কথা বলছে।

যে হেফাজতের জ্বালাও পোড়াও কাণ্ড আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ২০১৩ সালে, সেইদিনের সেই নিকৃষ্ট ঘটনাকেও এখন বলা হচ্ছে হেফাজত করেনি।  অথচ সমস্ত দলিল, প্রমাণ লেখা আছে সেইদিন হেফাজতের ডাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিলো সেইসব অধর্মের কাণ্ড।  প্রশ্ন হচ্ছে, যদি হেফাজত নাই করে থাকে তাহলে করেছিলো কারা? সরকারের একজন এমপি যখন প্রকাশ্যে এই কথা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন তখন কিন্তু সন্দেহটা আরও বেড়ে যায়।  তার মানে কী দাঁড়ায়? সরকার জানে কারা করেছিলো? যদি জেনেই থাকে তাহলে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? আর হেফাজত যদি নির্দোষই হয়ে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা বিচারাধীন আছে সেগুলো কী হবে?

কওমি মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে সেখানে জাতীর সঙ্গীত গাওয়া হয় না, ধর্মীয় বিষয়ের বাইরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আর কোনও বিষয় সেখানে পড়ানো হয় না।  তা হলে একটা বেসিক প্রশ্ন দাঁড়ায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যসব বিষয়গুলো না পড়ে একজন ছাত্র কেমন করে জাগতিক বিষয় সম্পর্কে জানবে? কেমন করে জানবে রাষ্ট্র কী, রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন করে গড়ে উঠে? সংবিধান কী? সাংবিধানিক অধিকার কী?

বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে কেবল ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী হলেই কি চলে? ধর্মীয় শিক্ষাকে অস্বীকার করার উপায় নাই কিন্তু তাই বলে সমাজ, রাষ্ট্র কী কেবল ধর্মীয় শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে? আবার অন্যদিকে যদি তা না হয় তাহলে আপনি বা আপনারা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে সমাজের আলোকিত ধারা থেকে বঞ্চিত করছেন যা আপনাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে না।  ধোঁকাবাজি করছেন সেইসব কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে।  ভুয়া কথায় ভুলানোর চেষ্টা করছেন তাদেরকে।  সান্তনা দিচ্ছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন? উত্তর পাই, ভোটের জন্য।  কেবল ভোটের স্বার্থেই আপনি এই কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন মন্ত্রী? কষ্ট হয়।  আপনি এই দেশের আপামর জনতার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে শপথ নিয়েছেন। কিন্তু আপনি কথা বলছেন একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য। ভোটের হিসাবে তারা কত অংশ? জানার অধিকার রাখি আমরা।  তাহলে আমরাও সিদ্ধান্ত নেব আর আপনিও সিদ্ধান্ত নিন আপনার কোন অংশের ভোটের দরকার আছে আর নাই।

দেশ স্বাধীন হয়েছিলো ভোটের হিসাবে নয়।  ভোটের হিসাব করতে গেলে এই বাংলাদেশের জন্ম হতো না।  দর কষাকষির মাধ্যমেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটতো কেবল।  এখনো আমরা থাকতাম পরাধীনতার শৃঙ্খলে। সেইদিন যদি জাতির পিতা পাকিস্তানিদের সাথে টেবিলে বসে হিসাব করতেন তার ক্ষমতায় থাকার, তাহলে তিনি নিশ্চিন্তে পাকাপোক্তভাবেই থেকে যেতে পারতেন। তিনি আপোসের রাজনীতিকে ধারণ করতেন না বলেই ক্ষমতার লোভে পড়েননি। লড়াই করে গেছেন। আরামের জীবন ছেড়ে জেলখানার একাকীত্বের জীবন বেছে নিয়েছিলেন বিনাদ্বিধায়।

কষ্ট হয় যখন দেখি আপনারা সবাই ভোটের রাজনীতি করছেন। কেউ জনগণের রাজনীতিকে ধারণ করছেন না।  যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিলো কেউ সেই বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি করছেন না।  আপনাদের সামগ্রীক চিন্তা এখন ২০১৯ সালের নির্বাচন।  সাংবিধানিক নিয়মে নির্বাচন হবে, ক্ষমতার পালাবদল হবে, আমরাও ভোট দিতে যাব কিন্তু তার আগে অবশ্যই আমরাও চিন্তা করবো বিগত বছরগুলোতে আমাদের জন্য আপনারা কী করেছেন আর কী করেননি? জানি সেখানে করার হিসাব অনেক কিন্তু দুই একটি আপোসের ফলাফল হয়তো গড়ে তুলতে পারে অনেক বড় পার্থক্য।  এই মাটির জনগণ চিরকাল তাকেই বেছে নিয়েছে যে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ধারণ করেছে।  মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশকে ঠকিয়ে কেউ কখনও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি পারবেওনা। ভোটের হিসাবেও যদি আপনারা ভুল করেন তাহলে ক্ষমতায় যাওয়ার সিড়িতো কেবল সংকীর্ণ হয়ে পড়বে।  আপনারা কী তাই চান? ভোট আদায়ের কৌশল হিসাবে যে পথ আপনারা বেছে নিয়েছেন জানি না সেটা কতটা সফল হবে কিন্তু এর পরিণাম হয়তো ভোগ করবে সমগ্র বাংলাদেশ।  ব্যালটের হিসাবের আগে তাই আবারও বিনীত অনুরোধ, আপনারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ধারণ করে এগিয়ে যান ভোটের দায়িত্ব আমাদের।  কথা দিলাম।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
গাজা নিয়ে মার্কিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় গণগ্রেফতার
গাজা নিয়ে মার্কিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় গণগ্রেফতার
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মশলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মশলা
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ