X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এই ঘরে সাপ আছে

আমীন আল রশীদ
৩০ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:২৩আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:২৫

আমীন আল রশীদ ধরা যাক একটি পরিত্যক্ত বাড়ি। লোকের ধারণা বাড়ির ভেতরে সাপ আছে। কারণ অনেকেই ওই বাড়ির ভেতরে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনেছে। কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকে দেখেনি বা দেখার সুযোগ পায়নি যে, আসলেই বাড়ির ভেতরে কতগুলো সাপ আছে বা সেগুলো কতটা বিষধর। ফলে এই বাড়িটি নিয়ে মানুষের রহস্য ও ভয় ক্রমেই বাড়তে থাকে। ছড়াতে থাকে গল্পের ডালপালা।
উত্তর কোরিয়ার অবস্থাও সেরকম। এই দেশটিকে আমরা কিভাবে চিনি এবং কেন তাকে আমরা ভয় পাই? একে আমরা ততটুকুই চিনি যতটুকু আমাদের চেনায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। উত্তর কোরিয়াকে আমরা সেভাবেই চিনি যেভাবে পশ্চিমা গণমাধ্যম তাকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে। তাকে আমরা ভয় পাই কারণ গণমাধ্যমের বরাতে আমরা কেবল উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের ভয়ঙ্কর মূর্তিটিই দেখতে পাই। উত্তর কোরিয়া মানেই এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যারা পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে বিশ্বের তাবৎ মানুষের দিকে তাক করে আছে এবং যেকোনও সময় সে এই পরমাণু অস্ত্র আমাদের দিকে ছুড়ে মারবে এবং কোটি কোটি লোক মারা যাবে। উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে এরকম একটা ভীতির সৌধ আমাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে এবং অবশ্যই সেটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্বার্থে।
উত্তর কোরিয়ায় মুক্ত গণমাধ্যম নেই এবং সেখানে বিদেশি সাংবাদিকদের ওই অর্থে প্রবেশাধিকারও নেই। আবার উত্তর কোরিয়ার সরকারও তার শৌর্যবীর্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কেবল সমরাস্ত্র প্রদর্শন ছাড়া আর কোনও ছবি বিশ্ববাসীর সামনে তুলেও ধরে না। রাশি রাশি অস্ত্র, কামান, বোমা আর যুদ্ধবিমানের বাইরেও যে উত্তর কোরিয়ার আরও বহুবিধ জিনিস বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে তাদের একটা আলাদা ইমেজ বা ভাবমূর্তি গড়ে তোলা সম্ভব-সেই চেষ্টা কখনও উত্তর কোরিয়ার তরফেও পরিলক্ষিত হয়নি। তারা বরং নিজেদেরকে একটা সামরিক জাতি এবং পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য নিজেকে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক বলে প্রচার করেই আত্মতৃপ্তি পায়। আর এই সুযোগটিই নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার কারণে সবচেয়ে ভীত তার প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া, যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা।

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ উত্তর কোরিয়াকে বলেছিলেন ‘শয়তান চক্রের অংশ’। এর পেছনে রয়েছে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ যা শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে। কোরিয়ান ওয়ার নামে পরিচিত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে আর চীন ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষে। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৫৩ সালে। তবে দুদেশের মধ্যে কোনও শান্তিচুক্তি হয়নি।  ফলে দু্‌ই দেশের উত্তেজনা শেষ হয়নি।

মনে রাখা দরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে মূল দুই শত্রুর নাম ইসলাম ও কমিউনিজম। যে কারণে একদিকে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া এবং অন্যদিকে মুসলিম ও ইসলাম প্রধান দুনিয়াকে অস্থিতিশীল করে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। চীন ও রাশিয়ার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি হুমকি দেয় উত্তর কোরিয়া এবং এটি একনায়িকতান্ত্রিক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। সুতরাং এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কেবল অর্থনৈতিক বা সামরিক স্বার্থই নয়, বরং এই আদর্শিক স্বার্থও জড়িত। সেই সাথে জড়িত তার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার সুরক্ষা। এটা না ভাবার কোনও কারণ নেই যে, যদি উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র না থাকত বা তারা পরমাণু অস্ত্র আছে বলে প্রচার না চালাত, তাহলে উত্তর কোরিয়া বহু আগেই ম্যাসাকার হয়ে যেত এবং সেটি বহু আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কব্জায় চলে যেত। সুতরাং বলা যায়, উত্তর কোরিয়ার জনগণকে বাঁচিয়েছে তাদের পরমাণু অস্ত্র অথবা এই অস্ত্রের ভীতি। আসলেই তাদের কী পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র আছে বা সেগুলো সত্যিকারেই কতটা শক্তিশালী বা কতদূর আঘাত হানতে সক্ষম-তা জানার কোনও উপায় আপাতত নেই। ফলে এই যে তথ্যশূন্যতা-এটিও উত্তর কোরিয়ার জন্য একটা বাড়তি সুবিধা। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব ধারণা করছে যে, ওই ঘরের ভেতরে সাপ আছে। কিন্তু আসলে কী পরিমাণ সাপ আছে এবং সেগুলো কতটা ভয়ঙ্কর- তা জানা নেই। ফলে এই সাপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে কী পরিমাণ শক্তি সামর্থ্য লাগবে বা সেই আক্রমণের ফলাফল কী হবে- তা নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের ধারণায় নেই। ফলে যদি শেষতক ‘মাথাগরম’  ট্রাম্প এবং ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’কিম জং উন যুদ্ধ বাঁধিয়েই দেন, তাহলে তার পরিণতি  কী হবে- তা আন্দাজ করা কঠিন।

ধারণা করা হয়, উত্তর কোরিয়ার এক হাজারের বেশি বিধ্বংসী মিসাইল আছে যা আমেরিকায় সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পথেও দেশটি বেশ এগিয়েছে বলে শোনা যায়। সম্প্রতি তারা ঘোষণা দিয়েছে, তারা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রেরও পরীক্ষা চালানোর দক্ষতাও অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার মাঝারি মাত্রার যেসব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তা দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপানে আঘাত হানতে পারে। এসব কারণে একটা বড়সড় যুদ্ধের দামামা এখন কোরীয় উপদ্বীপে। এরইমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার জলসীমানায় পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজ। পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ডুবোজাহাজ ‘ইউএসএস মিশিগান’দক্ষিণ কোরিয়ার জলসীমানায় ঢোকে বলে খবর দিয়েছে বিবিসি। এই জাহাজে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও ১৫৪টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, ৬০ জন বিশেষ প্রশিক্ষিত সেনা এবং কয়েকটি ছোট আকারের ডুবোজাহাজ রয়েছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া উত্তপ্ত সম্পর্কের মধ্যে এই ডুবোজাহাজের অবস্থান ওই অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে এতকিছুর পরও ভরসার জায়গা সম্ভবত চীন। কারণ উত্তর কোরিয়ার মিত্র চীন এই মুহূর্তে কোনো ধরনের যুদ্ধের পক্ষপাতি নয়। চীন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বার্থেই চাইবে একটা স্থিতিশীল এশিয়া তথা বিশ্ব। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র যতই হুমকি দিক বা উত্তর কোরিয়া যুতই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিক না কেন, শেষতক একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রতিহত করতে চীন সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক লেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ