X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের ১০০ দিন এবং আমেরিকান বিউটি

আনিস আলমগীর
০২ মে ২০১৭, ১৫:৫৭আপডেট : ০২ মে ২০১৭, ১৭:০০

আনিস আলমগীর কারও কল্পনায় ছিল না, অনেকে ভাবতেও পারেননি এই অঘটন ঘটবে। তারপরও শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এবং ১০০ দিনও পার করে দিয়েছেন। অবশ্য তার বিজয়ের ব্যাপারে যারা দৃঢ় ছিলেন, তেমন একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আমার সঙ্গে টিভি টক শোতে বলেছিলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন সত্য কিন্তু আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা এবং বিশ্ব ব্যবস্থা তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলা ট্রিবিউনেও লিখেছিলেন তিনি।
বাস্তবে আমি কিন্তু এখন সে সম্ভাবনা দেখছি না। ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর ক্যালিফোর্নিয়া যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলেছিল তখন আমিও মনে করেছি আমেরিকার ঐক্যও মনে হয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর ১০০ দিন অতিক্রম করলেও অভ্যন্তরীণ বা বিশ্ব ব্যবস্থার কোনও ক্ষতি ট্রাম্পের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। ট্রাম্প নির্বাচনের সময় যেসব এজেন্ডা জনসম্মুখে প্রকাশ করেছিলেন, সেসব এজেন্ডার কারণেই মনে করেছিলাম ট্রাম্প তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গেলেই বিশৃঙ্খলা শুরু হবে। আর একগুঁয়ে ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুত কাজ করার উদ্যোগ নেবেনই।
ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই অভিবাসন সম্পর্কে, ওবামা কেয়ার বাতিল করে, মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ নিয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করেছেন সত্য কিন্তু আমেরিকার জনসচেতনতা, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠানগুলো এত সহজ নয় যে, তাদের পাশ কাটিয়ে ট্রাম্প তার ইচ্ছেমতো পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নেবেন, যা তার উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন গংরাও আশা করেছিলেন। রাজ্যে রাজ্যে সুসংগঠিত প্রতিবাদ সভা ও মিছিল, জন প্রতিনিধিদের কাছে হাজার হাজার চিঠি ও ই-মেইলের বন্যায় ভাসিয়ে আমেরিকানরা যে সৎ ও সচেতন নাগরিক, তার প্রমাণও রেখেছেন খুব জোরালোভাবেই।
রীতি-প্রথা ভঙ্গ করে শপথের দিনেই রাজ্যে রাজ্যে বিক্ষোভ করেছে হাজার হাজার মানুষ। শপথ গ্রহণের দিন আনন্দ ধ্বনির পাশাপাশি বিক্ষোভও ছিল শপথ গ্রহণের মাঠের পাশে। ১০০ দিনের শেষে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, ‘আগের দিনগুলোকে মিস করছি খুব বেশি। প্রেসিডেন্ট পদে থেকে কাজ চালানো খুবই কঠিন ব্যাপার’। অথচ সহজ-সরল পথে চলার ব্যবস্থাকে তিনিই রুদ্ধ করেছেন।
ট্রাম্প নিজে অনভিজ্ঞ লোক, কখনও কোনও রাজ্যপরিষদেরও সদস্য ছিলেন না, আবার ব্যবসায়ী মানুষ। আর যাদের উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন তারাও ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের শাসন কখনও ভালো হয় না। প্রমাণিত হয়েছে আমেরিকার মানুষ শতভাগ সচেতন সুতরাং ট্রাম্পের অনিয়মতান্ত্রিক কোনও কিছুকেই তারা ছাড় দেবেন না।
যে দলেরই হোক জনপ্রতিনিধিরাও সতর্ক। রিপাবলিকানদের কংগ্রেসে ভূমিকা দেখে মনে হয় তারাও যেন বিরোধী দল। ক্যাপিটাল হিলের কংগ্রেস হলো রিপাবলিকান আর ডেমোক্রেট দলের প্রবীণ অভিজ্ঞ সিনেটরদের লীলাক্ষেত্র। সেখানে বসে বসে তারা আমেরিকার মঙ্গলের কথাই চিন্তা করেন। ভেদাভেদ ভুলে কোনও বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে দ্বিধা করেন না। যে কারণে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ থাকার পরও এখন পর্যন্ত ওবামা কেয়ার বাতিল করা সম্ভব হয়নি। কংগ্রেসের কথা হলো অধম হলে উত্তম দিয়ে রিপ্লেইস করো। দীর্ঘ সময়ের একটা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে শূন্যতা তো সৃষ্টি করা যায় না।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে পরে চীনকে নিয়ে অনেক অলিক কথাবার্তা বলেছেন। অনেকে মনে করেছিলেন চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নেবে। কিন্তু চীন বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ধীরে সুস্থে ট্রাম্পের সব কথাবার্তা হজম করেছেন আর মৃদুকণ্ঠে বলেছেন একবার ট্রাম্প আমেরিকার সার্বিক ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকলেই সব কিছু উপলব্ধি করতে পারবেন এবং তখন ট্রাম্প নিজেই নিজেকে সংযত করে নেবেন।
দীর্ঘদিনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমেরিকার একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে ব্যবস্থাটা ভাঙা তো সহজ কথা নয়। আর তা কেউ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও সংকটের সম্মুখীন হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ব্যবস্থাও বিপন্ন হবে। এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে আর প্রবৃদ্ধির হারও নিম্নগামী হবে। সবকিছু যিনি বুঝেন তার পক্ষে তো অনুরূপ ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়টা নিয়ে ট্রাম্পের বোধ শক্তি কম বলে আদালত থেকে কংগ্রেস, সবাই তাকে গত ১০০ দিন সতর্ক পাহারায় রেখেছেন। উচ্চ আদালতে একজন রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ ছাড়া ট্রাম্পের কোনও প্রশাসনিক আদেশই এ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টা পরিষদ রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ। অনেকে মনে করেন সংবিধান বিষয়েও ট্রাম্পের বিভ্রম রয়েছে। এমন একটি গ্রুপের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা থাকলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন তারা।
এনবিসি নিউজ, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা চল্লিশ শতাংশ। গত পয়ষট্টি বছরের মাঝে এটি একজন প্রেসিডেন্টের জন্য সর্বনিম্ন। যেদিন বারাক ওবামা ক্ষমতা ছেড়ে যাচ্ছিলেন, সেদিনও তার জনপ্রিয়তা ছিল ৬৯ শতাংশ।
ক্ষমতা গ্রহণের আগে ট্রাম্প মনে করতেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অনেক ক্ষমতা। তিনি অনেক কিছু করতে পারেন। তিনি পাঁচটি মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। বিষয়টা যখন আদালত আটকে দিলেন, তখন তিনি নির্বাহী আদেশটি সংশোধন করে পুনরায় জারি করলেন। এরপর অন্য আদালত থেকে যখন সংশোধিত আদেশটির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো তখনই ট্রাম্প বুঝলেন যে রাষ্ট্রপতি হলে যা ইচ্ছে তা করা সম্ভব হয় না।
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও কঠোরতা আছে। অনেকে বলেন, তা হলে এমন একটি লোককে আমেরিকার মানুষ কেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ মনে করেছিল, নির্বোধকে চালানো যায় কিন্তু হিলারির বিশ্বস্ততা আর সততার অভাব আছে। সুতরাং তাকে রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য গুরুদায়িত্ব দেওয়া যায় না। নির্বাচনের সময় বহির্বিশ্বে হিলারি যেভাবে জনপ্রিয় ছিল, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অনুরূপভাবে জনপ্রিয়তা ছিল না। আর হিলারির বিকল্প ট্রাম্প ছাড়া কেউ তো ছিল না।
ট্রাম্প বহু দুর্যোগের মাঝে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত এক মনোরোগ সম্মেলনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ট্রাম্প মানসিক রোগী। জন হপকিনস মেডিক্যাল কলেজ ও হসপিটালের কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মস্তিষ্ক বিকৃতি ও বিভ্রমে আক্রান্ত ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মানসিক যোগ্যতা নেই। উত্তর কোরিয়ার উত্তেজনায় বিষয়টা চাপা পড়লেও ট্রাম্পের বিজয়ে রাশিয়া সাহায্য করেছিল, এ অভিযোগের তদন্ত করছে সিবিআই। সুতরাং বলা যায় অভিসংশনের দুর্ভোগও ট্রাম্পের পেছনে লেগে আছে।
আবার হোয়াইট হাউসে বসে তার সন্তানেরা ব্যবসার কাজ করার অভিযোগও উত্থাপিত হচ্ছে। আর এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে ইমপিচমেন্ট অবধারিত। নির্বাচনে রাশিয়ার সাহায্য গ্রহণ, মানসিক ভারসাম্য বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ আর হোয়াইট হাউসে বসে ব্যবসা পরিচালনা আর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা- তিনটাই গুরুতর অভিযোগ। সুতরাং অভিসংশনের বিষয়টাও তার পক্ষে দীর্ঘদিন এড়িয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে হয় না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected] 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ