X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

এটা আত্মহনন নাকি সামাজিক হত্যাকাণ্ড?

চিররঞ্জন সরকার
০৪ মে ২০১৭, ১২:৪৭আপডেট : ০৪ মে ২০১৭, ১২:৫১

চিররঞ্জন সরকার এ ধরনের খবরগুলো পড়তে পড়তে আমরা ক্লান্ত। গণমাধ্যমও এখন খবরগুলোকে খুব একটা গুরুত্বও দেয় না। আবার কেউ কেউ নিয়ম রক্ষার জন্য ছোট করে ভেতরের পাতায় ছেপে দেয়। তেমনই একটা খবর। ‘ধর্ষণের বিচার না পেয়ে গাজীপুরের এক পিতা মেয়েসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে!’
গাজীপুরের হযরত আলী ছিলেন একজন দরিদ্র ব্যক্তি। তার নিজের সন্তান না থাকায় আয়শাকে সে দত্তক নেন। নিজের সন্তান হিসেবেই আয়শাকে লালনপালন করছিলেন। তার টাকার জোর ছিল না। ছিল না সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি। তার শিশুকন্যার ওপর স্থানীয় যুবক ফারুকের কু-নজর পড়েছিল। ফারুক নানাভাবে আয়শাকে উত্ত্যক্ত করতো। এমনকি তাকে জোর করে সাইকেলে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণেরও চেষ্টা করে। আয়শা এই ঘটনা বাবাকে জানায়। অসহায় বাবা মেয়ের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় আর কি-ই বা করতে পারেন? আইনের প্রতি আস্থাশীল হয়ে মাত্র ৯-১০ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ-প্রচেষ্টার ঘটনার বিচার চেয়ে থানায় অভিযোগ করেছিলেন!
শ্রীপুর থানার এএসআই বাবুল তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন। হয়রত আলী স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল হোসেনের কাছেও এর বিচার দেন। কিন্তু বিচার না করে এক হাজার টাকার বিনিময়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেয় ইউপি সদস্য। বাবা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর নেমে আসে নানা নির্যাতন। তার গরু চুরি করা হয়। আয়শাকে অপহরণেরও হুমকি আসে।
পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল তদন্ত করে পেয়েছে, ‘স্থানীয় ফারুক শিশুটিকে জোর করে তার সাইকেলে তুলেছিল। এ সময় তার পা কেটে যায়। পরে ওষুধপত্র কিনে দেওয়া হয়!’ এমন কথা শুনে এবং ঘটনার যথাযথ প্রতিকার না পেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে হতাশায় হযরত আলী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন!
এই হলো আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের সমাজ, আমাদের বিচার ব্যবস্থা! এখানে আট-দশ বছরের শিশুকন্যাও পুরুষের কাম ও লালসার শিকার হয়। ‘যৌনবস্তু’ হিসেবে টার্গেটে পরিণত হয়। তাকে জোর করে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। আর এসব ঘটনার কোনও প্রতিকার হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘটনাকে গুরুত্ব দেয় না। গরিব মানুষ হলে তো আরও না। থানা-পুলিশের ভূমিকা সব সময় অপরাধীদের পক্ষে যায়। এখানে যারা জনপ্রতিনিধি, তারাও গরিব মানুষের ইস্যু, নারীর ইস্যুতে মোটে সংবেদনশীল নয়। এখানে ধর্ষক ফারুক, জনপ্রতিনিধি আবুল এবং পুলিশ বাবুল সবাই একই সমান্তরালে। সবাই মিলে ক্ষমতাবানের পক্ষে, পুরুষতন্ত্রের পক্ষে, আইন, মানবতা ও নারীর বিপক্ষে। তাদের ভূমিকার কারণে হয়রত আলী ও তার মেয়ে আয়শাকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে!
যাদের কাছে নিদান আছে, যারা প্রতিকারের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন, তারা নিজেরাই যদি ধর্ষক ফারুকের পক্ষ নেয়, তাকেই আগলে রাখে, তাহলে ধর্ষিতার পিতার ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার থাকে? এটা আসলে কোনও আত্মহত্যার ঘটনা নয়, এটা সামাজিক হত্যাকাণ্ড! এই হত্যাকাণ্ডের দায় আমাদের সবার!

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এত বড় একটা ঘটনা, অথচ রাষ্ট্রের কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তির এতটুকুও প্রতিক্রিয়া নেই! এই খবরটি কি কারও চোখে পড়েনি, কেউ শোনেননি? আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চোখেও পড়েনি? এতে কি তার কোনও প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাতে? আমাদের কোনও মন্ত্রী, কোনও রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, কারোই কি কোনও প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই খবরে? আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা কি তাদের কারও প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছেন? কোনও মন্ত্রী, কোনও রাজনীতিবিদ প্রশাসনের কোনও কর্তাব্যক্তিকে কি প্রশ্ন করেছেন, যে তারা এই ঘটনায় কেমন বোধ করছেন? কী তাদের প্রতিক্রিয়া?

রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সারাক্ষণ কথার ঢাক পেটাচ্ছেন। প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি আমরা। আর হযরত আলী ও আয়শারা ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দিয়ে, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কি এক ‘প্রহসনের উন্নয়নের’ মধ্যে বেঁচে আছি! এখানে যে কেউ ইচ্ছে করলেই একজন নাবালিকা কিশোরীকে পর্যন্ত তুলে নিয়ে যেতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে! এর কোনও বিচার নেই, প্রতিকার নেই! এমনকি এ ব্যাপারে দেশের কর্তাব্যক্তিদের কারও কোনও প্রতিক্রিয়া বা বক্তব্যও নেই!

আমাদের সমাজটা দুর্বলের জন্য নয়। গরিব মানুষের জন্য নয়, নারীর জন্যও নয়। হয়রত আলী ও তার মেয়ে আয়শার আত্মহত্যা রাষ্ট্রের প্রতি, আইনের রক্ষকদের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি একই সঙ্গে অনাস্থা ও পাদাঘাত। এর জন্য রাষ্ট্র দায়ী, প্রশাসন ও সমাজ দায়ী। আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী।

ধর্ষণ কেবল নারী নির্যাতন নয়, তা বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের একটি প্রকাশ। তাই ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তার প্রতিকার করা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আক্ষেপের বিষয় এই যে, রাষ্ট্র এ বিষয়ে তার কর্তব্য থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশ নারী নির্যাতন বা যৌন হয়রানির অভিযোগ গ্রহণ করে না, অভিযোগ গ্রহণ করলেও যথাযথ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয় না। এমনিতেই প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য উপস্থিত করা কঠিন বলে প্রমাণের অভাবে বহু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত মুক্তি পেয়ে থাকে। তার ওপর যদি তদন্ত এবং বিচারের স্তরেই অভিযোগ পৌঁছাতে না পারে, তাহলে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিভাবে? শাস্তির কঠোরতার চেয়েও শাস্তির নিশ্চয়তা অপরাধীদের নিরস্ত করে বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে সেই নিশ্চয়তাটুকুও প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে যতক্ষণ পর্যন্ত বিশেষ অপরাধ হিসেবে না দেখা হবে, প্রশাসন, আইন ও বিচার ব্যবস্থা সংবেদনশীল না হবে, ততোদিন আয়শার প্রতি যৌন হয়রানি এবং এই হয়রানির প্রতিকার না পেয়ে বাবা-মেয়ের আত্মহত্যাই ‘মুক্তির পথ’ হিসেবে বিবেচিত হবে!

আমাদের দেশে বহুল চর্চিত মত হচ্ছে, মেয়েরাই নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। মেয়েরা উস্কানি দেয়, তাদের পোশাক-আশাক পুরুষদের ‘প্রভোক’ করে। কিন্তু গাজীপুরের আয়শার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক এই ‘যুক্তি’ খাটে না। এই ছোট্ট মেয়েটির ‘পোশাক-আশাক’ আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ ছিল না। ভোগের লালসাই মেয়েটির প্রতি যৌন হয়রানির মূল কারণ। আসলে একটি মেয়ের শরীরই এ দেশে যথেষ্ট সিগনাল। মেয়ে হলেই কামকাতর নরপিশাচরা ক্ষেপে যায়। ভোগের উৎসবে শামিল হতে চায় শত-সহস্র-লক্ষ জন। মেয়েদের শরীরকে ছিঁড়ে-খুড়ে ফেলতে চায়। যৌন হয়রানির নেশায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর। নাবালিকা-সাবালিকা সব ধর্ষণই বহাল তবিয়তে চলে সে সব দেশে, যে সব দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মেয়েদের ভোগের বস্তু, দাসী-বাঁদি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন প্রাণী, নিচু জাতের জীব ইত্যাদি হিসেবে বিচার করে।

এই ‘মাইন্ডসেট’ থেকে পুরুষদের কিভাবে বের করে আনা যায়, তা নিয়ে আমাদের দেশে বড় বেশি ভাবনা-চিন্তা নেই। আমরা বড় জোর আইনশৃঙ্খলার কথা বলি। অরাজকতার কথা বলি। অরাজকতায়ও কিন্তু বাংলাদেশ বেশির ভাগ দেশকেই ছাপিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের সামাজিক-প্রশাসনিক-আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে কাম-কাতর পুরুষদের সাবধান করার, বা প্রয়োজন হলে ভয় দেখানোর বা থামানোর কোনও ব্যবস্থা করতে পারিনি। গ্রাম বা শহরগুলোকে আর একটু সুরক্ষিত করতে পারিনি, মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কলকব্জাগুলোকে আর একটু সংবেদনশীল করতে পারিনি। যে রকম সংবেদনশীলতা দেখা যায় ধনী দেশ সুইজারল্যান্ড বা জার্মানিতে, বা তুলনামূলক গরিব দেশ উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানে। আইন মানতে অভ্যস্ত সে সব দেশের মানুষ, তাই মেয়েরা রাতবিরাতেও নির্ভয়ে পথে বের হন সেখানে। কিন্তু আমাদের মেয়েরা ঘরেও নিরাপদ নয়। কেন?

আসলে আমাদের সমাজটা, সমাজের মূল্যবোধগুলো কেমন যেন পচে গেছে। শিকড়ে যদি বিষ থাকে, তাহলে গাছ যতই আকাশস্পর্শী হোক, আর তার শিখর-পুচ্ছ যতই নয়নাভিরাম হোক, ফলটা বিষাক্তই হয়। নারীর প্রতি যৌন লালসা চরিতার্থ করার বিষ, বিভেদ বা বৈষম্যের বিষ আমাদের সমাজের শিকড়ে রয়েছে। তাই আমরা কোনও সামাজিক অনাচার, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নিদান পাই না। আমরা নিজেদের শুধরে নিতে পারি না।

যে অসাধুতা শতকের পর শতক ধরে বাসা বেঁধে রয়েছে আমাদের ভাবনা চিন্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সেই অসাধুতার বিসর্জন ঘটবে কিভাবে, কোন মন্ত্র বলে? শুধু দু-চারজন মানুষের আহা-উহুতে, একজন ইউপি সদস্য আবুলকে আটক করে, দুয়েকটা প্রতিবাদ সমাবেশ করে সামাজিক ব্যাধিগুলোর নিরাময় ঘটবে না। ব্যাধিতে আক্রান্ত যারা, তাদের মধ্যেই নিরাময়ের তাগিদটা অনুভূত হতে হবে। পদক্ষেপটা সেই লক্ষ্যেই হওয়া দরকার। কিন্তু সেই তাগিদটা কবে, কিভাবে সৃষ্টি হবে? কতজন হয়রত আলী ও আয়শার আত্মদানের পর তা ঘটবে?

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ