X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘উত্তপ্ত লোহা শীতলকরণ’ সিনড্রোম....

শুভ কিবরিয়া
০৪ মে ২০১৭, ১৩:১৪আপডেট : ০৪ মে ২০১৭, ১৩:২৪

শুভ কিবরিয়া আমাদের ছোটবেলায় কামার পাড়ায় দেখতাম উত্তপ্তলোহা পিটিয়ে ছুরি, চাকু, বটি, লাঙ্গলের ফলা বানাতে কঠিনতম পরিশ্রম করছেন একদল শ্রমিক মানুষ। আগুনে উত্তপ্ত লোহার সেই চেহারা আর তাকে পিটিয়ে জাতে আনার কসরৎ ছিল খুবই  শৈল্পিক অনুশীলন। খুব আগ্রহ ভরে এটা দেখা ছিল আমাদের শৈশবের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আজ হঠাৎ করে সেই উত্তপ্ত, আগুনরঙ্গা লোহার কথা মনে পড়ে গেলো। সেই শিল্পমণ্ডিত সুষমাভরা নির্মাণ কাজের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে এলো সংবাদপত্রে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের এক বক্তব্য পড়ে। নজিবুর রহমান উত্তপ্ত লোহা শীতল করার উপমা দিয়েছেন একদল ক্ষুব্ধ, তপ্ত ব্যবসায়ীদের ঠাণ্ডা করার সময় তার বক্তব্য দিতে গিয়ে।
এনবিআর বা রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের এই কথার আগেই অবশ্য উত্তপ্ত লৌহদণ্ড হয়ে গরম ঝরিয়েছেন আমাদের খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত নিজেই। মূল্য সংযোজন কর বা মুসক (ভ্যাট) আইন নিয়ে মিটিং চলছিল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোদ অর্থমন্ত্রীর। আগামী বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের যৌথ পরামর্শক সভায় ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করেন নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে এনবিআর এবং এফবিসিসিআই ১৮ টি বৈঠক করলেও তার ফলাফল ছিল শূন্য। তার দাবি, মূসক নিয়ে ব্যবসায়ীদের চাওয়া না মিটলে ছাত্রদের ভ্যাট বাতিল আন্দোলনের মতো তাদেরও মাঠে নামতে হবে। আন্দোলন করেই দাবি আদায় করবেন তারা। তার এই বক্তব্যে খুবই রিঅ্যাক্ট করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেই বসেন,  ‘আন্দোলন করেন , কিছুই হবে না। যদি আপনারা আন্দোলন করেন, আমরা আন্দোলন দমন করবো’। 
২.
স্বভাবতই অর্থমন্ত্রীর কথায় ক্ষুব্ধ হন উপস্থিত ব্যবসায়ীদের একটা অংশ। ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নেতারা অধিকাংশই এখন সরকার দলের সমর্থক। ব্যবসায়ী সংগঠনে এখন আর আগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয় না। অন্যসব পেশাজীবী সংগঠনের মতো ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা নির্বাচিত হন প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের বদলে সমঝোতার ভিত্তিতে। সরকারি পছন্দের ভিত্তিতে, সরকারি নানান সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের মদদে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ‘ইলেকশনের বদলে সিলেকশন’ এই মডেল বাংলাদেশে সর্বত্র খুবই প্রসারিত হয়েছে।
‘ইলেকশনের বদলে সিলেকশন’ ধারায় সরকারি ইচ্ছা ও পছন্দে এইসব নেতা নির্বাচিত হন বলে এরা নিজেদের পেশার স্বার্থে সরকারের সঙ্গে ন্যায্য দরকষাকষী করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের সন্তুষ্টি অর্জনই থাকে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সে কারণে এইসব ব্যবসায়ী নেতারাও সরকারি দলের নেতাদের মতো আচরণ করতে পছন্দ করেন।
বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ৩০ এপ্রিল ২০১৭ তারিখের এই যৌথ পরামর্শক সভাতেও সেই সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে। ফলে ব্যবসায়ীরা মিটিং ফেলে হৈ চৈ শুরু করলে সভায় দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। নজিরবিহীন হুমকি ও পাল্টা হুমকির মধ্যে ফ্লোর নিয়ে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্যবসায়ীদের উদ্দ্যেশে বলেন-

এক. সবধরনের উস্কানি -বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্থির আছি। আমি যদি চেয়ারম্যান থাকি, ভবিষ্যতে এই ধরনের সভায় কিভাবে কথা বলতে হয়, সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।

দুই. উত্তপ্ত লোহাকে কিভাবে শীতল করতে হয়, সেই প্রশিক্ষণ আমার জানা আছে।

তিন. এখানে কে কী করেন সবার নাড়ি-নক্ষত্র আমার হাতে আছে। সবার ডাটাবেজও আছে। এজন্সি আমাকে ডে টু ডে ভিত্তিতে রিপোর্ট করে কোথায় কী হচ্ছে। আমি তো চুপ করে থাকি। যত বেশি তথ্য পাই, তত বেশি ধীর স্থির থাকি।  

০৩.

নতুন মূসক বা ভ্যাট আইন নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতবিরোধ চলছে প্রায় দুই বছর ধরেই। এখন সরকার কিছুটা অনমনীয় এই ভ্যাট আইন চালু করতে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা রয়েছে। নতুন মুসক আইনে আমদানি কিংবা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পর্যায়ে অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা চান এই হার কমিয়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে করা হোক। এছাড়া বিদ্যমান প্যাকেজ মূসক ব্যবস্থা বাতিল, টার্নওভার করসীমা বৃদ্ধি, মূসক নিবন্ধন পদ্ধতি- এসব নিয়েও মতবিরোধ আছে। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন মোটেই ব্যবসাবান্ধব নয়। তাই আগামী বাজেটের আগে এটি সংশোধন করা হোক। সেই দাবি মানা না হলে তারা আন্দোলনে যাবে।

অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন, ‘৮ লাখ প্রতিষ্ঠানের মূসক নিবন্ধন আছে, মাত্র ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান মূসক দেয়’। কাজেই সরকার এই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করে তার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বাড়াতে মরিয়া। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হচ্ছে দ্রুত এই নতুন আইন চালু হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা বলছেন নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে ১ হাজার ৫২০টি পণ্য ও সেবার মধ্যে ১ হাজার ৩৫০ টি পণ্য ও সেবা থেকে সম্পুরক শুল্ক ওঠে যাবে। এতে দেশীয় বাজারে নিয়ন্ত্রণ করবে বিদেশি পণ্য। স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

০৪.

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দেশীয় শিল্প টিকিয়ে রাখতে উচিত যে কোনও সরকারেরই প্রণোদনা দেওয়া। আবার এটাও ঠিক, এখন বিশ্বায়নের দৌলতে চলছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। তাই চাইলেই সবসময় সরকার স্থানীয় সব শিল্পকে প্রটেকশন দিতে পারবে না। এই ক্ষেত্রে সরকার ও দেশীয় ব্যবসায়ীদের যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা খুব জরুরি। উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা হওয়া উচিত যুক্তির ওপর ভর করে। এবং অবশ্যই দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে।

কিন্তু আমরা কী দেখলাম। একটি জনস্বার্থ মূলক আলোচনায় চললো হুমকি ও পাল্টা হুমকি। ব্যবসায়ীরা আলোচনার টেবিলে বসে দিচ্ছেন আন্দোলনের হুমকি। আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পাল্টা হুমকি টেনে বলছেন সেই আন্দোলন দমনের কথা। শুধু তাই নয়, সরকারের দায়িত্বশীল আমলার কথা শুনেও চটে ওঠছেন ব্যবসায়ীরা। দু’পক্ষের আচরণের মধ্যে রাষ্ট্রানুগ ন্যায্যতা নেই। নেই দায়িত্বশীলতা।

কিন্তু এর কারণ কী?

আমরা এরকম দায়িত্বহীন, উগ্রবাদী হয়ে পড়ছি কেন?

ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বা এই উগ্রতা কেন?

আর সরকারের মন্ত্রী আমলাদের এতো ধৈর্যচ্যুতিই বা ঘটছে কেন?

এই কেন’র উত্তর খোঁজার জন্য চোখ রাখতে হবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাম্প্রতিক চলাচলের ওপর। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের যে নতুন ধারা চালু করেছে, সেখানে জনগণের ভোট ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়েছে। সরকার অনেক বেশি নির্ভর করছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর। ফলে জনগণ কী ভাবছে, কী দেখছে, জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হবে তার মূল্য রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে আর ততটা নেই। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার অংশটা এখন তাই অনেকটাই উহ্য থাকছে। ক্ষমতাবানরা যা বলছে সেটাই ন্যায্যতা বলে প্রতিষ্ঠার জন্য তারা শক্তি প্রদর্শন করতেও পিছপা হচ্ছে না। আইনের শাসন বা সুশাসন তাই রাষ্ট্রজীবনে অধরাই থাকছে।

এই রোগ আমাদের নানানভাবে সুখী করছে বটে কিন্তু আমাদের জীবনে এই প্রবণতা এক গভীর সংকটের বীজ বুনে চলেছে। আমরা মাঝে মাঝে তার অঙ্কুরউদগম দেখছি কেবল।

সময়ে এই মূল রোগ নিরাময়ে হাত দিতে না পারলে অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে গোটা রাষ্ট্রজীবনকেই।

এনবিআর চেয়ারম্যান তাই যতই উত্তপ্ত লোহা শীতলকরণের মন্ত্র পাঠ করুন না কেন, তাতে সুশাসনের সুবাতাস নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

পুনশ্চ: এই লেখায় ব্যবহৃত তথ্য ১মে ২০১৭ তারিখের দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক যুগান্তর সংবাদপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ