X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপর্যস্ত হাওরের বিচিত্র কষ্টগুলো

মঞ্জুরুল আলম পান্না
০৫ মে ২০১৭, ১২:৫১আপডেট : ০৫ মে ২০১৭, ১৩:০০

মঞ্জুরুল আলম পান্না ‘দাদা... ও দাদারা হুইন্য রাখো, আমি কিন্তু কিছু হাইসি না। দাদা, ও দাদারা...’। শব্দগুলো বুকের ভেতরটা খামচে ধরছে ক্ষণে ক্ষণে এখনও। এক মুঠো চাল আর আলু না পেয়ে ৯/১০ বছরের একটি মেয়ের আর্তনাদ কানে বেজে চলেছে অনবরত। ত্রাণ থেকে বঞ্চিত ছোট্ট মেয়েটি যখন কথাগুলো চিৎকার করে বলছিলো, খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো নিজেকে, অনেকটা অপরাধী মনে হচ্ছে এখনও।
আমরা কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী মিলে উদ্যোগ নিই হাওরের ফসল হারানো নিঃস্ব মানুষগুলোর জন্য ত্রাণ কার্যক্রমের। অনেকেই বলছেন, এটা সরকারের দায়িত্ব। বলি, সব সময় সব কিছু সরকারের কাঁধে দায় চাপিয়ে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। আমরা দিনকে দিন কেমন যেন খুব বেশি আত্মকেন্দ্রীক হয়ে উঠছি। অনুভূতি শক্তিগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে উঠছে যেন। হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যায় টেলিভিশনে কোনও বিভৎস ছবি বা কোনও লাশ না দেখে অনেকে মনে করছেন, তেমন কিছুতো ঘটেনি। কিন্তু হাওরের ওই মানুষগুলোর সামনে এখন সমূহ বিপদ। আগামী একটা বছর তাদের অনিশ্চিত। অভাব তাদের দীর্ঘস্থায়ী, অন্তত নতুন ফসল না ওঠা পর্যন্ত।
থেমে থাকিনি আমরা। নিজেদের সামান্য কিছু অর্থে তহবিল গঠনের পর ফেসবুকে বন্ধুদের আহ্বান জানায় এই মানবিক কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য। বিকাশে টাকা পাঠানোর মাধ্যমে অনেকেই সম্পৃক্ত হন অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। দেশের বাইরে থেকেও অনেকে সাহায্য পাঠান। অশেষ ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা রইলো তাদের প্রতি। মানুষের দেওয়া টাকায় আমরা কিছু চাল, আলু, শিশুদের জন্য বিস্কুট আর ওরস্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সামগ্রী নিয়ে গত বুধবার যাই নেত্রকোনার বিপর্যস্ত হাওরাঞ্চলে। খালিয়াজুরি উপজেলার নুরালীপুর গ্রামে নামতেই দেখি শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই ছুটে আসছেন ঊর্ধ্বশ্বাসে, এক মুঠো খাবারের জন্য। শিশুদেরকে এক সারিতে বসিয়ে প্রথমেই ওদের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম বিস্কুট। আহা, কী অদ্ভুত সেই নিষ্পাপ মুখগুলোর ভুবনজোড়া হাসি মাত্র এক প্যাকেট করে সামান্য বিস্কুটে! খুব কাছে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সকালে কী খেয়েছো মা? বললো, ‘কাঁচা মরিচ ভাইঙ্গা ভাত খাইছি’। জানলাম কারোর কপালে জুটেছে শুধু লবণ দিয়ে পান্তা, কারোর জুটেছে নদী থেকে পাওয়া গুইন্যা মাছ দিয়ে ভাত। ওদিকে যখন মহিলাদের হাতে চাল আর আলু তুলে দেওয়া প্রায় শেষ, তখনও খবর শুনে দৌড়ে আসছিলেন অনেকে। আমাদের সঙ্গে থাকা ত্রাণতো অপ্রতুল। কেউ কেউ হয়তো একবার নিয়ে তা লুকিয়ে আরেকবারের জন্য হাত পেতে দিয়েছেন। ফেরাতে গিয়ে আবার দমে যাই। কী করবে, পেটে ক্ষুধা যে! নিজের মাথা নিচু হয়ে আসে। ক'জনের মুখেই বা এক মুঠো খাবার তুলে দিতে পারবো! 

সেখান থেকে লিপসা শিবির হয়ে আসাদপুর শিবিরে, যেখানে সবাই ঘর ঘর বেঁধে আছেন সরকারের খাস জমিতে। সেই একই দৃশ্য। নিঃস্ব মানুষের হুড়োহুড়ি। কেউ পেতে দিচ্ছেন খালি হাত, কেউ শাড়ির আঁচল, অধিকাংশই এসেছেন বড় বড় চটের ব্যাগ হাতে নিয়ে। আবারও লজ্জা পাই। অতো বড় ব্যাগতো ভরে দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। কয়েকদিন আগে বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসল কেটে আনতে গিয়ে ডুবে মরলো ২৫ বছরের যে যুবক কৃষক বিক্কু মিয়া, তার স্ত্রী সাজোনা’কে দেখলাম কথা বলারও শক্তি নেই তার। তবু এসেছেন পেটের যন্ত্রণায় একটু সাহায্যের আশায়। পেলাম বিক্কুর ষাটোর্ধ্ব মা’কে। সন্তান হারানো শোকে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে বারবার, তারপরও দাঁড়িয়েছেন কিছু একটা পাওয়ার আশায়। পেটের ক্ষুধা ভুলে থাকা কী এতো সহজ! এক সময় দেখলাম ত্রাণ গ্রহণের সারির বাইরে আমাকে ঘিরে ধরেছেন অনেকে। চান বানু, শাবানা, লিজা, আয়শা, জিলবানু, মোস্তফা, জাহানারা একে একে অনেক নাম আমার কানে ঢুকছে তাদের নামে যেন সরকারি ত্রাণ আসে, ভিজিএফ কার্ড পায়। শান্ত গলায় বলি, ‘আমার কোনও ক্ষমতা নেই যে!’ বলে, ‘তারপরও লেখেন স্যার’। আসাদপুর শিবিরে ১২৮টি পরিবারের মধ্যে তারা কার্ড পেয়েছেন মাত্র ৬৭টি।

সেখান থেকে আসাদপুর গ্রামে। একটা বাঁধে ট্রলার থামতেই হুমড়ে খেয়ে পড়া অভাবি মানুষের অসংখ্য হাত আমাদের সামনে। নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয়। ছোট্ট এক ছেলে বিস্কুট হাতে নিয়েই আনন্দে দৌড়াতে গিয়ে কংক্রিটের বাঁধের ঢালুতে পড়ে গেলে হাঁটুর বেশ খানিটা কেটে যায় তার। সে শক্ত করে ধরে রাখা বিস্কুটের প্যাকেটের দিকে একবার তাকায়, আরেকবার তাকায় রক্তাক্ত জায়গাটির দিকে। খারাপ লাগছিলো, এক প্যাকেট বিস্কুটের জন্য এতোখানি রক্ত! ছেলেটাকে ডেকে আরও দুই প্যাকেট বিস্কুট দিলাম। নাম লেখানোর জন্য এখানেও একই অবস্থা। কেউ কেউ ছুটে এসে বলছেন, ‘আমার নামনি নিবাইন না?’

কথা হয় ৭২ বছরের অশীতিপর বৃদ্ধ হেকমত আলীর সঙ্গে। পরম যত্নে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন অন্য এলাকা থেকে পানির নিচে ডুব দিয়ে দিয়ে কেটে আনা জমিয়ে রাখা কিছু ধানের ওপর। জানতে পারলাম, পাঁচ জন মানুষ মিলে আট দিন ধরে মণ দেড়েক ধান তারা সংগ্রহ করেছেন। শেষমেষ এর চার আনাও হয়তো টিকবে না। হেকমত আলী দুই বিঘা (স্থানীয় হিসেবে ৫২০ শতকে এক বিঘা) জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন হাজারে ৫০ টাকা সূদে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করে। কিন্তু উদ্ধার করা যায়নি এক ছটাক ফসলও। কৃষক সাজু রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অহনতো আমার জমিন নিয়া গেছেগা জলে। ছাগল গরু বেইচা আর কয় দিন খাওয়া যাইবো?’ সাজু রহমানের মতো অনেকে জানালেন, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে যারা ফসল বুনেছিলেন অনেক শ্রম আর স্বপ্নে; দেড়শো থেকে তিনশো মন করে ধান পেতেন এক একজন। ডুবে গেছে সব। এমন ভয়াবহ দুর্যোগের পরও কোনও কোনও এনজিও নাকি নিয়মিত তাদের কাছে আসছেন কিস্তির টাকা নিতে। তবে চাপ আগের মতো না। আর ত্রাণের বিষয়ে সবার অভিযোগ, চেয়ারম্যান-মাতবররা তাদের পছন্দের লোকদেরকে কিছু দিলেও বাকিরা বঞ্চিত সব জায়গা থেকে। সামান্য ৩ কেজি চাল আর আলুর প্যাকেট হাতে পাওয়া এক বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলাম, কয় বেলা চলবে এইটুকু খাবারে? হেসে দিয়ে বললেন, ‘যয় বেলা চলবে, তাই বেশি’। এই প্রথম নাকি ত্রাণের ছিটেফোঁটা পেলেন তারা।

সবশেষ গেলাম মোহনগঞ্জ থানার বানিহারি গ্রামে। সেখানেও একটা বাঁধে থামানো হলো আমাদের ট্রলার। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! মানুষ দৌড়ে আসছেন একজন আরেকজনকে পেছনে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে, দিকে দিকে নৌকা নিয়ে ছুটে আসছেন কোনও রকমে খেয়ে না খেয়ে থাকা শত শত মানুষ। এখানেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। সামান্য চাল, আলু। তবুও সবাই আগে পেতে চান। স্যালাইন আর ওষুধ নিতেও কাড়াকাড়ি। এক কৃষককে বললাম, ভাই আমরাতো সামান্য কিছু এনেছি। এতে কী হবে আপনাদের? হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে সোজা উত্তর তার, ‘ইডি দ্যায় ক্যাডা? ইডিই অনেক।’ একজন বললেন, দুই মাস হয়ে গেলেও কোনও সাহায্য এখনও জোটেনি তাদের কপালে। আওয়ামী লীগ যারা করেন সবই নাকি তারাই পান। এক কিশোর ছেলে হতাশার সঙ্গে বললো, ‘আমাদের ঘরে আওয়ামী লীগের কার্ড আছে। তারপরও কিছু পাইনি’।

মানুষ ছুটে আসছেন, ছুটে আসছে শিশু-কিশোর-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আর আমরা শুধু তাকাচ্ছি ট্রলারে মজুদ খাবার সামগ্রীর দিকে। কী হবে? দিতে পারবোতো সবাইকে? আশঙ্কা-ই সত্য হলো। ভীড়ের পেছনে দিকে আমাদের কথায় আস্থা রেখে শান্ত হয়ে বসেছিলেন যারা, তাদেরকে দেওয়া হলো না কিছু। এদিকে এরই মধ্যে অনেকে নৌকায় করে, কেউ আবার সাঁতরে এসে ট্রলার থেকে চাল আর আলুর প্যাকেট জোর করে নিতে শুরু করেছেন। একসময় ভীড়ের মানুষগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে থাকেন। বুঝতে পারলাম, তাড়াতাড়ি সরতে না পারলে বিপদের মধ্যে পড়তে হবে। ট্রলার ছাড়তে বলা হলো দ্রুত। তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, যে দুর্নীতিবাজদের কারণে সর্বশান্ত হলেন নিজেদের ওপর নির্ভরশীল এই মানুষগুলো, সেই অমানুষগুলোই বোধ হয় বহাল তবিয়তেই থাকবেন।

ট্রলার চলছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে গাঢ় হতে থাকে অন্ধকার। সবহারা মানুষের শূন্য হাতগুলোর ছায়া অস্পষ্ট হতে থাকে। ট্রলারের ঘ্যাট ঘ্যাট শব্দের মধ্যে কানে ভেসে আসে- ‘দাদা... ও দাদারা হুইন্য রাখো, আমি কিন্তু কিছু হাইসি না’।

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ