X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘স্বামী’ শাকিব আর ‘পতিভক্ত’ অপু: অমিল-মিলে কিছু গরমিল

তপন মাহমুদ
০৬ মে ২০১৭, ১৩:০৭আপডেট : ০৬ মে ২০১৭, ১৩:১৩

তপন মাহমুদ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্বঘোষিত ‘সুপারস্টার’ শাকিব খান ও জনপ্রিয় নায়িকা অপু বিশ্বাসের প্রেম, বিয়ে ও সন্তান নিয়ে আমাদের আগ্রহ মনে হয় তিস্তাকেও হার মানিয়েছে। কী হবে শাকিব-অপুর ভবিষ্যত? আর আব্রাম, নিষ্পাপ এই শিশুটিরই বা কী হবে? কী দোষ ছিল তার?
যে অস্থিরতার শুরু হয়েছিল টিভির পর্দায়, মানে গণমাধ্যমে, সেই গণমাধ্যমই আবার শেষ পর্যন্ত বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো নায়ক-নায়িকার হাত মিলিয়ে দিলো। আর বাঙালি দর্শকও মনে হয় সুখের তালিয়া আর উচ্ছ্বাসের সিটি বাজিয়ে বলতে থাকলো ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’। অপু ফিরে পেলো তার স্বামী, শাকিব পেলো স্ত্রী, আর আব্রাম বাবা-মার পরিচয়। তার প্রথম জন্মদিনে এখন আর কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগই থাকলো না, যে ভয়টা খুব কাবু করেছিল বাংলা সিনেমার প্রতাপশালী নায়িকা অপু বিশ্বাসকে।
১০ এপ্রিল পড়ন্ত বিকেলে বাংলা টিভির দর্শকরা যেন একটু চমকেই গেলেন। দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ বড় পর্দার সফল নায়িকা অপু বিশ্বাস কিনা নিজেই হাজির ছোট পর্দায়। টেলিভিশনের পর্দায় নিজের জীবনের আট-ন’বছরের আড়াল পর্দা ফাঁস করলেন অপু বিশ্বাস। গণমাধ্যমে ভাষায় ‘বোমা ফাটালেন’। তবে তাতে ক্ষোভের আগুন যতটা না ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল অভিমান আর কষ্টের অশ্রুজল।
কাটলেও স্বামী মারলেও স্বামী

সাধারণ মানুষ থেকে স্টার-সুপারস্টার, সে যেই হোক, নিজের বিয়ের খবর চাইলে গোপন করতেই পারে। যদিও বিয়ে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। কেউ চাইলে তার বা তাদের সন্তানের খবরও আড়াল করতে পারে। কিন্তু সেটা যে খুব একটা স্বাস্থ্যকর হয় না, সেটারই প্রমাণ দিলেন নায়িকা অপু বিশ্বাস আর শাকিব খান। তাদের এই ‘আড়ালিপনা’ নিয়ে পারস্পরিক অভিযোগ আছে। শাকিবের ভাষায়, ‘অপুকেই জিজ্ঞাসা করুন’। আর অপু বললেন, শাকিবের জন্যই। বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় শাকিব-অপুর এই লুকোচুরি নিয়ে গত প্রায় এক-দেড় বছরে অনেক গল্প-গাঁথাই রচিত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা সিনেমার নায়িকা অপু বিশ্বাসের হঠাৎ আড়ালে যাওয়ার পর। তবে এই নায়িকার প্রত্যাবর্তন হলো আরও নাটকীয়তায়! যেন বাংলা সিনেমার কোনও দৃশ্য। হারিয়ে যাওয়া নায়িকা ফিরলেন তার ফুটফুটে সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু কষ্টের কথা হলো, তাকে কাঁদতে হলো স্ত্রী আর সন্তানের অধিকার চেয়ে। বড় পর্দার এই নায়িকাকে সন্তানের স্বীকৃতি চাইতে হলো ছোট পর্দায়।

আমরা এই ঘটনাকে যতভাবেই বিশ্লেষণ করি না কেন, এটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা হয়ত নেই যে, নায়িকা অপু বিশ্বাসের হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল শাকিব খান। তিনি যখন বলেন, ‘আমার সন্তানের জন্মের সময় তার বাবাকে কাছে পাইনি, নিজেই সাইন করে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছি’। তখন পুরুষতান্ত্রিক নিয়মেও একজন বাবাকে আসামীর কাঠগোরায় দাঁড় করানো যায় বটে। স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার অধিকার যেকোনও স্বামীরই আছে। কিন্তু সন্তান তো তাদের দু’জনার। দেশ জাতি বা বাংলা সিনেমার এমন কী উদ্ধার করছিলেন শাকিব খান? নিজের সন্তানের জন্মের সময় পর্যন্ত কাছে থাকতে পারেননি। পাশে থাকেননি স্ত্রীর গর্ভকালীন অতি প্রয়োজনীয় সময়েও। এমনকি জন্মের কয়েকমাস পর সন্তানের মুখ দেখেছিলেন তিনি। বাংলা সিনেমার ভিলেনরাও এত নিষ্ঠুর হয় না, যতটা হয়েছেন ‘সুপারস্টার’ নায়ক শাকিব খান। এরপরও কোন মুখে তিনি বলেন, ‘আব্রাম নায়ক শাকিব খানের ছেলে, তাকে আমি এমন করে টিভির পর্দায় দেখতে চাইনি।’

শাকিব না চাইলেও তাই হলো শেষ পর্যন্ত। কারণ এ ঘটনা না ঘটার জন্য যা করার দরকার ছিল একজন জীবনসঙ্গী হিসেবে, একজন বাবা হিসেবে বাংলা সিনেমার এই ‘সুপারস্টার’ তা করেননি। অপুর বয়ানে, ‘ নিয়মিত শাকিব বলেছে লুকিয়ে রাখো। আর লক্ষ্মী বউটির মতো অপু ‘অনেক বছর ধরে অনেক কিছু আগলে রেখেছেন’। যুগ যুগান্তের বাঙালি বধূর মতো অপু তাই বলেছেন ‘আমার ক্যারিয়ার চিন্তা করিনি, আমি ভেবেছি ও ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো’। শুধু কথায় নয় কাজেও দেখিয়েছেন। তার কারণ যাই হোক না কেন!  শাকিব খানের অনেক রিউমার শুনেও মেনে নিয়েছেন স্ত্রী হিসেবে। যদিও মা হিসেবে সে রিউমার তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই হাজির হয়েছেন টেভিভিশনের পর্দায়। কেঁদে বলেছেন, শাকিবই ভুল করেছে। তার মর্যাদা দেয়নি। সন্তানের পরিচয় প্রকাশ করতে বাঁধা দিয়েছেন। এমনকি এই সন্তানের জন্মের সময় অপুর অনুরোধেও পাশে থাকেননি শাকিব। এটা তো সত্যিই কষ্টের। অথচ এখন বড় গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, আব্রাম শাকিব খানের ছেলে! অপুও তাই ভাবছেন। তার পুরুষতান্ত্রিক মনে এছাড়া আর কী বা হবে? তিনি শাকিব খানের ছেলে পরিচয়েই বেশি গর্ববোধ করছেন। মায়ের পরিচয় কি আব্রামকে যথেষ্ট সম্মান দিতে পারবে এই সমাজে? তাই তো বাংলা সিনেমার এই নায়িকাকে শেষ পর্যন্ত সব মেনে নিয়ে অসহায় আত্মসমর্পন করতে হয় ‘নায়কের’ কাছে। এত অভাব-অভিযোগের পরও সাংবাদিকদের পুরুষতান্ত্রিক প্রশ্ন  ‘শাকিব খান আপনার দায়িত্ব নিলে কী করবেন?’ এর জবাবে অপুকে তাই বলতে শুনি, অসহায় নির্যাতিত স্ত্রীর মতো, ‘মারলেও স্বামী, কাটলেও স্বামী’।

কিন্তু অদ্ভুত! যে অপু তার জীবনসঙ্গীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, সেই অপুই কিনা উল্টে গেলেন। দেশের একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অপু বললেন, ‘একজন মানুষ সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ হয় না। কিন্তু শাকিব খান একজন পূর্ণ মানুষ।একজন মানুষের যত গুণ থাকা দরকার, তার সবই আছে শাকিবের’। কী আশ্চর্য ! এত যার গুণ তাকে নিয়ে তাহলে কেন টেলিভিশনের পর্দায় এত অভিযোগের ফিরিস্তি দিলেন তিনি? তাহলে কি পর্দার অভিনেত্রী বাস্তবে অভিনয় করলেন!

যে বাবা তার সন্তানের জন্মের সময় তার স্ত্রীর সাথে ছিল না, এমনকি প্রথম দেখেছিল অন্তত দুই মাস পর, সেই শাকিব খানকেই কিনা এই অপু বিশ্বাসই সার্টিফিকেট দিলেন ‘সে একজন সফল বাবা, সফল স্বামী ও সফল সন্তান’। আপনি হয়তো বলতে পারেন, আরে বাবা, মিয়া বিবি রাজি তো, আপনার কী সমস্যা? হ্যাঁ। সমস্যা এটাই যে, এই দ্বিচাররিতা আমাকে এটাই বুঝিয়েছে যে, অর্থনৈতিক সাবলম্বীতাও নারীকে স্বাধীনতা দিচ্ছে না। সে শেষ পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিজেও ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করছেন। অথচ এটা ভুল শিক্ষা। একুশ শতকের এই সময়ে  এসে অন্তত আমরা এটাই চাই যে, নারী পুরুষ তার স্বাধীনতা বজায় রেখেই সংসার জীবন যাপন করবে। কেউ কারো ওপর অধিকার ‘ফলানোর’ চেষ্টা করবে না, যেটা শাকিব খান করছে। কারণ অপু বিশ্বাস সমাজের কোনও সুবিধাবঞ্চিত নারী নয় যার কোনও উপায় নেই, বরং নিজের ক্যারিয়ার আছে এবং সেটাই নিজেই গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নায়িকা হতে এসেছি, ভাত রান্না করার জন্য আসিনি’। কিন্তু একটি টেলিভিশনে এই বিষয়ে শাকিব খানের বিস্ময় শুনলাম। উনি বললেন, একজন মা হিসেবে তিনি একথা কিভাবে বলত পারলেন? কেন পারবেন না? হ্যাঁ। কেন পারবেন না সেট একটু পরেই বুঝতে পারবেন। 

আমার কোনও দোষ নেই, অপুরই তো দোষ!
এবার  আসি ‘নাম্বার ওয়ান শাকিব খান’ প্রসঙ্গে। যিনি বারবারই তার ছেলেকে পরিচয় করাচ্ছেন ‘আব্রাম শাকিব খানের ছেলে’। তার এই পুরুষতান্ত্রিক অহমিকা পরে আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করছেন, ভুল অপুই করেছে। আবার এ সঙ্গে তিনি এ বলেছেন যে, অপুর এই ভুল তিনি মন থেকে মাফ করে দিয়েছেন। ‘নির্দোষ’ শাকিব খানের এই বোধ তার ভেতরের ‘পুরুষকেই’ বর্ণনা করছে। তাকেই যেন কর্তৃত্ব দিচ্ছে ভুল ধরার ও তা মাফ করে দেওয়ার। তিনি হয়তো ভাবছেন এই মাফ করা তাকে মহান করছে। কিন্তু তার পক্ষে এটা বোঝা কী সম্ভব যে, তিনিই নিজেই যেখানে ভুলের পাহাড় তৈরি করে রেখেছেন, সেখানে অপু বিশ্বাসকে মাফ করার নৈতিকতা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছেন।

নায়ক শাকিব খান তার এই ঘটনাকে বারবার ফেলতে চাইলেন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’। তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে নায়িকা অপু বিশ্বাস তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার ‘ফলানোর’ খবর তিনি বারবার দিয়েছেন। যখন তিনি বললেন, ‘আমি তো বলেছি, কোরবানির ঈদে তাকে লঞ্চ করাবো, কিন্তু হঠাৎ তার কী হলো?’ ‘কর্তৃত্ববাদী পুরুষ’ শাকিবের সাথে তাই আমি খুব বেশি অমিল খুঁজে পাইনি সেই সব বউ পেটানো স্বামীর সাথে, যারা পেটানোর জন্যও অদ্ভুত যুক্তি দেখান। আমি বুঝতে পারি না, বাংলা চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক কী করে বলেন- ‘আমি ব্যস্ত থাকি, অপুও যদি ব্যস্ত থাকে, তাহলে আমার সংসার সন্তান সবকিছু ভেস্তে যাবে। আমি নিশ্চয়ই চাইবো না নায়িকা হিসেবে সে ফিরে আসুক’। তিনি বলিউডের টুইংকেল খান্নার উদাহরণ টানলেন। কিন্তু এটা কি জানেন, টুইংকেল খান্না নিজেই ফিল্ম ছেড়ে দিয়েছেন। আমি কফি উইথ করণে এ বিষয়ে ওই নায়িকার নিজের ব্যাখ্যা শুনেছি। একটার পর একটা ছবি ফ্লপ করছিল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন সিনেমা ছেড়ে লেখালেখি করবেন। হ্যাঁ। বলিউডেও এমন উদাহরণ নাই, তা নয়। তবে সেই খারাপ উদাহরণ দেবেন কেন? আহ! একটু খেয়াল করতে হবে তো। কাজল, ঐশ্বরিয়া রায় এরা তো বাচ্চা বড় হওয়ার পরও সিনেমায় হিট। তাই সংসার, বাচ্চা এগুলো কাজ না করার অজুহাত হতে পারে কিন্তু প্রতিবন্ধকতা নয়। তাই বলে স্বামী হয়ে কেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবেন মিস্টার শাকিব খান?

আমি নিশ্চিত অনেক নারী এ খবর দেখার পরে বলেছেন, হায়রে পুরুষ! শেষ পর্যন্ত ‘তথাকথিত পুরুষ’ই থেকে গেলেন শাকিব। স্বামীর ভূমিকায়ই রয়ে গেলেন তিনি। যে স্বামীর অর্থ আসলে প্রভু, কর্তা, মনিব, মালিক ইত্যাদি। যে প্রভুত্ব তিনি খাটালেন স্ত্রী অপুর ওপর।  শাকিব খানের বক্তব্য থেকে আমার বিশ্বাস এটাই দৃঢ় করেছে যে, অপু বিশ্বাসকে আড়াল থাকার ঘটনা শাকিব খানের চাপেই হয়েছে। ব্যস্ততা তো ছাড়, শাকিব খান চানই না, অপু বিশ্বাস কাজ করুক। অপু বিশ্বাসের তো স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার আছে, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে আরও এক কাঠি সরেস হলেন শাকিব। বললেন, ‘আমি চাইবো না স্বাধীনভাবে সে কাজ করুক। টাকার জন্য তার সিনেমা করার দরকার আছে বলে তো মনে হয় না। আমি ভরণ পোষণ করতে পারবো’। বটে। আপনি পারবেন। কিন্তু টাকা দিয়ে অপু বিশ্বাসের স্বপ্ন কেনাবেচার অধিকার কি আছে আপনার, মিস্টার ‘নাম্বার ওয়ান’? কী করবেন এখন, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে অপু বিশ্বাসের উত্তর আরও অবাক করলো। বললেন, ‘আমার কিছু বলার নেই। শাকিব যা চায়, আমি সবসময় তাই করেছি’। হয়তো তার একই কথায় হতাশার সুর ছিল, কিন্তু তার মতো সাবলম্বী নারীকে যখন আপোসের পথেই হাঁটতে হয়, তখন গোটা সমাজের নারীদের কাছে সেটা ভালো কোনও বার্তা দেয় না। কারণ বোঝা যায় পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর শিকার হয়ে নারীর মনেও শেষ পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিকতা বাসা বাঁধে। নারী ভেবে নেয়, যত কথাই বলি এই সমাজটা শেষ পর্যন্ত পুরুষের। পুরুষের ক্ষমতার বাইরে তার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। তাকে পুরুষের কর্তৃত্বেই থাকতে হবে। ঘরই তার আসল ঠিকানা। সে বোধ তাই অপু বিশ্বাসকেও বুঝতে ও বলতে শেখায় ‘সম্মান খ্যাতি মর্যাদা সবই তার আছে, তার ওপর আস্থা হারানো কঠিন’।

সমাজের আয়নায় শাকি-অপু প্রহেলিকা ও আমাদের পুরুষ গণমাধ্যম

অপু আর সংসার যখন পুড়ছিল তখন কেউ কি বাঁশি বাজাচ্ছিল? হুম। শুধু তাই নয়, এই অগ্নিকাণ্ডের সূচনায় আমাদের আশপাশের মানুষের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এই লাকড়ি যুগিয়েছে। অপু বিশ্বাসের কথায় সেটা বের হয়ে এসেছে। অপু বিশ্বাসও অন্যায় করেছে শাকিব খানকে অন্য নায়িকার সাথে কাজ করতে বাধা দিয়ে। তার ভালো না লাগলে, সে অন্য উপায় খুঁজতে পারতো। তাই বুবলি বিষয়ক তার রাগ -অভিমান তার ভেতরের ইনসিকিউরড বা অনিরাপদ সত্তাকেই জাগিয়ে তুলেছে। যদিও সে নিজে যথেষ্ট সাবলম্বী ও যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে এ সমাজের মানুষের দায় আছে বটে। কেউ একজন অপুকে ফোন করে বললেন, ‘দিদি আপনি তো হেরে গেলেন। শাকিব ভাই তো রংবাজ ছবিতে আপনাকে বাদ দিয়ে বুবলিকেই নিলেন’। কী অদ্ভুত!  আর তাই কি অপু বারবার বললেন, শাকিব আমাকে ছোট করেছে। এই সমাজ, এই সমাজের অনেক মানুষ, এখনও পুরুষতান্ত্রিক ধারণারই সমর্থক। সেটাকেই তারা জিয়ে রাখতে চান। ফলে অপু বিশ্বাসের মতো দেশের একজন শীর্ষ নায়িকাকেও লড়াই না করে শেষ পর্যন্ত আপোসই করতে হয়। আমি জানি, ঠিক এখনই কেউ না কেউ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, উহুম! আইছে আমার নারীবাদী!

এই ঘটনার পর একটি দুইটি টেলিভিশনে দর্শক প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম। তাদের বেশিরভাগই এই ঘটনাকে দেখেছেন পুরুষের চোখে। একজন বলেছেন ‘স্ত্রীকে মেনে নেওয়াই শাকিবের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে’। এই লোকটি হয়তো এখন বলবেন, মেনে তো নিয়েছেন সিনেমা ছেড়ে সংসার করাই অপুর জন্য ভালো হবে। বেশিরভাগই ন্যায়-অন্যায় নৈতিক জায়গা থেকে কোনও প্রশ্ন তোলেননি, শুধু চেয়েছেন তাদের মহামিলন!

সব শেষে একটু সন্দেহের চোখে তাকাতে চাই গণমাধ্যমের দিকে। যদিও এই ঘটনায় খুব অল্প গণমাধ্যম পেশাদারী সাংবাদিকতা করতে পেরেছে।

দেশের কয়েকটি গণমাধ্যম যেভাবে শাকিব খানের জন্য উদ্ধার প্রকল্প হাতে নিলেন, তাতে মনে হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয় যে, গণমাধ্যম শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবানের পক্ষেই কাজ করে। যে গণমাধ্যমের বেশি বেশি প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী লোকের ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্যায় নিয়ে, সেখানে দেখলাম ‘অপুই ভুল করেছে’ শাকিবের এমন অভিযোগকে জাস্টিফাইড করার চেষ্টা করলেন। অপু বিশ্বাস যতই বলার চেষ্টা করছেন, আমার দায়িত্ব আমি নিতে পারবো, আমি চাই সন্তানের স্বীকৃতি, কিন্তু তবুও সাংবাদিকদের হাস্যকর প্রশ্ন ছিল, শাকিব খান দায়িত্ব নিলে কী করবেন? আরে বাবারা জোর করে শাকিব খানকেই কেন দায়িত্ব দিতে চাইছেন? সে পুরুষ বলে! তার নৈতকতা বা ন্যায় অন্যায় নিয়ে কমই প্রশ্ন করা হয়েছে।

আমিও চাই শাকিব খান অপু বিশ্বাস অবশেষে সুখে শান্তিতে ঘর করুক। কিন্তু আমি আতঙ্কিত হই যখন দেখি শাকিব অপুর ওপর অভিনয় না করার শর্ত চাপিয়ে দেন। সেই শর্তের মাঝে আমি বা আমরা একজন তথাকথিত পুরুষ শাকিব খানকেই খুঁজে পাই, যে স্ত্রীর স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার করতে চান না। নিজের ক্যারিয়ারের জন্য স্ত্রীকে ঘরে আটকে রাখতে চান। আর পতিভক্ত অপু এতটাই অসহায় যে, তাকে বলতে হয় ‘শাকিব যা চায়, আমি সবসময় তাই করেছি’। শাকিবের এই পুরুষতান্ত্রিক আচরণ ও অপুর লুকিয়ে রাখা অভিমানের মানেটা আমি এই সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিন্তা, বোধ, মতাদর্শ, ক্ষমতার অনুশীলনের মধ্যে খুঁজে বেড়াই! জানি এই অভিমানের বাস্পে একদিন ঝড় উঠবেই। রোজ উঠছেও একটু একটু করে, আমরা কজন টের পাই?  

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ