X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

অবিকৃত কণ্ঠ প্রচারের দায় কে নেবে?

হারুন উর রশীদ
১০ মে ২০১৭, ১৫:৪৪আপডেট : ১০ মে ২০১৭, ১৬:৪১

হারুন উর রশীদ বনানীতে ধর্ষণের শিকার তরুণীদের অডিও সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে বাংলাদেশের দু’একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। এরমধ্যে একটি টেলিভিশন চ্যানেল মঙ্গলবার (০৯.০৫.১৭) তাদের একটি অনুষ্ঠানে ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর টেলিফোনে লাইভ সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে।
ধর্ষণের শিকার কারোর সাক্ষাৎকার প্রচারে কোনও বাধা আছে বলে আমার জানা নাই। বাধা আছে তাদের পরিচয় প্রকাশে। আর এই পরিচয় প্রকাশ হতে পারে ছবি, ভিডিও, অডিও, নাম- ঠিকানাসহ আরও অনেকভাবে। ধর্ষণের শিকার যারা হন তাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ বা প্রচার, সাক্ষাৎকার প্রচার বা প্রকাশে এটাই খেয়াল রাখতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় যাতে কোনোভাবে সংবাদমাধ্যম তাদের পরিচয় প্রকাশ করে না দেয়। তারা যেন নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে না পড়েন। ন্যায় বিচারের কাজ কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রতি যেন আরও বড় কোনও অবিচার না করা হয়।
আমার মনে হয় বাংলাদেশের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল বনানীতে ধর্ষণের শিকার তরুণীদের বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন তাদের অবিকৃত কণ্ঠ সংবাদে, এমন কী লাইভ অনুষ্ঠানে প্রচার করে। একটি টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানের বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং আইনের অধ্যাপকও ছিলেন। তারা যখন সেই অনুষ্ঠানেই তরুণীর লাইভ টেলিফোন ইন্টারভিউ শুনছিলেন তাদের মনেও প্রশ্ন জাগলো না! হায়!
তরুণীর অবিকৃত টেলিফোন ভয়েসের মাধ্যমে হয়তো অপরিচিতরা তাকে চিনতে পারবেন না। কিন্তু তার বন্ধুরা, ক্লাসমেটরা, পরিচিত জনরা, পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন, প্রতিবেশি যারা তার কণ্ঠ চেনেন তারা সবাই তাকে চিনতে পারবেন বা পারছেন। তাহলে তাদের পরিচয় আর গোপন থাকলো কই? ছবি প্রকাশ করা, নাম ঠিকানা প্রকাশ করা আর অবিকৃত কণ্ঠ প্রচার করা একই জিনিস। কারণ এর প্রতিটির মাধ্যমেই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায়। যারা অবিকৃত কণ্ঠ প্রচার করেছেন তারা যে ওই তরুণীর কত বড় ক্ষতি করেছেন তা কী তারা বুঝতে পারছেন না? আমি যেসব দু-একটি টেলিভিশনের কথা বলছি সেখানে কাজ করছেন দেশ সেরা সাংবাদিকরা। তারা কী জবাব দেবেন?

আমি একটি টেলিভিশনের সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে তারা অবিকল এবং অবিকৃত কণ্ঠ প্রচার করেছেন। আর তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন তাতে তরুণীর কোনও আপত্তি ছিল না। আমার কথা হলো তরুণী হয়তো সচেতন ছিলেন না যে তা কণ্ঠের মাধ্যমেই তাকে পরিচিতরা চিনে ফেলবেন। আর ধর্ষণের শিকার কোনও তরুণী যদি স্বেচ্ছায় তার ছবি, কণ্ঠ ও নাম পরিচয় সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করতে চায় তাহলেও সংবাদমাধ্যম সেটা করবে কিনা? এর জবাব বিবিসি বাংলা সার্ভিসের কাছেই আছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বিবিসি বাংলা বিভাগ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা ধর্ষণের শিকার এক রোহিঙ্গা নারীর ছবি প্রকাশ করে তার লিখিত অনুমতি নিয়েই। পরে তারা তা প্রতিবাদ এবং নৈতিকতা বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেয়।

এখানে কারণটি অনেক স্পষ্ট । আর তা হলো স্বেচ্ছায় পরিচিতি, ছবি, ভিডিও অডিও বা কণ্ঠ প্রকাশ ও প্রচারের অনুমতি দিলেও তা তার জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তা হয়তো সে নিজেও বুঝতে পারেন না। তাই সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হয়। আর কেউ অনুমতি দিলেই তা আমরা প্রচার করবো? আমাদের নীতিমালা কী বলে। বিবেক কী বলে?

টেলিভিশনে ওই তরুণীর অবিকৃত কণ্ঠ প্রচারের সঙ্গে জড়িত একজন আমার কাছে দাবি করেন, ‘তাদের ছবি, পরিচিতি তো ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে অবিকৃত কণ্ঠ প্রচারে আর কী ক্ষতি হবে?’ আমি অবাক হয়েছি তার এই জ্ঞানের বহর দেখে। দুর্বৃত্তদের অপকর্মকে নিজের কাজের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার এই মানসিকতা দেখে। এদের হাতে সাংবাদিকতার দায়িত্ব কিভাবে দেয় একটি টেলিভিশন স্টেশন?

ছবি, বা ভিডিও যেমন ব্লার করে দেওয়া যায় তেমনি কণ্ঠও পরিবর্তন করে দেওয়া যায় যাতে প্রকৃত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা না যায়। যে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল তরুণীর অবিকৃত কণ্ঠ প্রচার করেছে তারা চাইলে কণ্ঠ যান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারত। তা তারা করেনি। ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলাপচারিতায় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আরেকজন আমাকে জানিয়েছেন, ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীকে শেষ মুহূর্তে টেলিফোন লাইনে পাওয়া যাওয়ায় তার টেলিফোন ভয়েস আর যান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করা যায়নি। তবে তিনি স্বীকার করেন তরুণীর অনুমতি থাকলেও ভয়েস যান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করে দেওয়া উচিৎ ছিল। 

আর তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় যে, তার ভয়েস-এর মাধ্যমে যে তার পরিচিতি প্রকাশ হয়ে যেতে পারে তা তিনি তখন ভাবতে পারেননি। আর এর ফলাফল যে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না।

আর এখানেই হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম স্পষ্টই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। ধর্ষণের শিকার তরুণীদের উপকার(!) করতে গিয়ে উল্টো আরও বড় ক্ষতি করছেন। তার কণ্ঠ বা পরিচিতি প্রকাশ করে কোনও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা?

তরুণীদের বাসার সামনে সাংবাদিকতা নয়:

এরইমধ্যে এমন খবরও পাওয়া গেছে যে কোনও সংবাদকর্মী যন্ত্রসহ ধর্ষণের শিকার তরুণীদের বাসা বা আবাস স্থলের সামনে তাদের খোঁজে গিয়েছেন সাংবাদিক পরিচয়ে। এমনকি বাসার নিরাপত্তার রক্ষীদের কাছে জানতেও চাইছেন তাদের বাসা ওটা কিনা। এটা কোনও সংবাদিকতা হতে পারে না। এর মাধ্যমও কিন্তু তাদের ব্যাপারে অন্যান্যরা জানতে পারছেন। তাদের পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে। যারা যাচ্ছেন তারা যে বড় ক্ষতি করছেন তা বুঝতে পারছেন?

কেউ আবার ধর্ষণ মামলার আসামি সফাতের সাবেক স্ত্রীর ছবিও প্রকাশ করছেন। আমি বুঝতে পারছিনা, কী হচ্ছে? দয়া করে সাংবাদিকতায় মেধা খাটান। নীতিমালা মাথায় রাখেন। মানবিক হোন। তাহলে দেখতে পাবেন ওই দুই তরুণীর কোনোভাবে পরিচয় প্রকাশ না করেও তাদের বিচার পাওয়ায় সহায়তা করা যায়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা যায়। আমাদের সেটা করতে হবে। ওদের খুঁজছেন কেন? যারা ধর্ষণ মামলার আসামি তাদের খুঁজুন প্লিজ। 

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল:[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
গাজায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
গাজায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা
থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা
জেল থেকে বেরিয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশুসাহিত্যিক টিপু!
জেল থেকে বেরিয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশুসাহিত্যিক টিপু!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ