আমার দৈনিক পত্রিকা পড়ার সূচনা বিশ শতকের চল্লিশের দশকে। ১৯৪০ সালে আমার বাবা লালমনিরহাট রেলওয়ে জংশনের রেল হাসপাতালে ডাক্তার ছিলেন। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল, জাপানি সেনাবাহিনী ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্তে হানা দিচ্ছে। বোমাবর্ষণ করছে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে। বার্মা থেকে দলে দলে শরণার্থী আসামের ভেতর দিয়ে লালমনিরহাট এসে ঢুকছে। তাদের জন্য খোলা হচ্ছে শরণার্থী শিবির ও লঙ্গরখানা। এরই মধ্যে আমার বাবা জুলফিকার আলীর চাকরি ‘আর্মি মেডিক্যাল কোর’-এ রিফিউজিশন করা হয়। আব্বা চলে যান ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে আসামের আমিন গাঁতে অবস্থিত মিলিটারি হসপিটালে। আম্মা আমাদের নিয়ে লালমনিরহাটে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে থেকে যান। তখন যুদ্ধের খবরের জন্য আমাদের একমাত্র ভরসা ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকা। ওই পত্রিকায় যুদ্ধকালীন সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যতটা খবরাখবর পাওয়া যেত সেটুকু সম্বল করেই আমাদের দিন কাটতো। আমি তখন ক্লাস থ্রি’র ছাত্র। বানান করে করে ইংরেজি পত্রিকা পড়ে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনুমান করার চেষ্টা করতাম। এরই মধ্যে ১৯৪১ সালের মে মাসে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ এবং ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে মহাত্মা গান্ধীর ব্রিটিশবিরোধী ‘কুইট ইন্ডিয়া’ মুভমেন্ট বা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের খবরও ইংরেজি পত্রিকা থেকে পেয়েছিলাম। বস্তুত আমার পত্রিকা পড়ার ভিত্তি রচিত হয়েছিল শৈশবে ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকা পড়ার মাধ্যমে।
১৯৪৩ সালে আমার বাবা ঢাকা রেলওয়ে হসপিটালে বদলি হয়ে আসেন। আমাদের বাসস্থান হয় ফজলুল হক হলের উল্টোদিকে তখনকার রেলওয়ে কলোনিতে। এখানে স্টেটসম্যান ও আজাদ পত্রিকা রাখা হতো। রমনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তখন মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত। কলাভবন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল মিলিটারি দখলে। নবনির্মিত নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাকে সামরিক ছাউনি। ঢাকা নগরী হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লণ্ডভণ্ড। ওই সময় আবার শুরু হয় তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ। সেসব ঘটনাবলীর সংবাদ আমরা স্টেটসম্যান ও আজাদ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করতাম। ইংরেজি পত্রিকা থেকে আমরা বিশেষভাবে যুদ্ধের সংবাদ আর বাংলা পত্রিকা থেকে দেশের বিশেষত গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ ও জিন্নাহ’র পাকিস্তান আন্দোলনের খবর নিতাম।
দুর্ভিক্ষ ও হিন্দু মুসলমান হানাহানির সংবাদ বাংলা কাগজেই পাওয়া যেত। তখনও সুভাষ বসুর আজাদহিন্দ ফৌজের খবর সেন্সরশিপের বেড়াজাল পেরিয়ে ভারত ঢুকতে পারতো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়, আত্মসমর্পণ ও জাপানে আমেরিকার আণবিক বোমাবর্ষণ আর জাপানের আত্মসমর্পণের খবর স্টেটসম্যান পত্রিকায় বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সব খবর আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ব্রিটেনের নির্বাচনে লেবারপার্টির জয়, সরকার গঠন ও ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণা দানের পর ভারতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের তথা হিন্দু মুসলমানের সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৪৬-এর সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোয় বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের জয়লাভের ফলে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তখন বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে ‘আজাদ’ পত্রিকা খুবই জনপ্রিয়। আমরাও তখন নিয়মিত এই পত্রিকার পাঠক। দেশ বিভাগের পূর্বে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মিল্লাত ও দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকাও বহুল পঠিত। দেশবিভাগের পর ঢাকায় যখন পূর্ববাংলার রাজধানী স্থাপিত হলো তখন এখানে কোনও দৈনিক পত্রিকা ছিল না। কলকাতা থেকে আজাদ, ইত্তেহাদ ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা ঢাকায় আসতো। সে সময় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। আজাদ পত্রিকা ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু আগের গৌরব ধরে রাখতে পারেনি। তার কারণ পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের দ্বন্দ্বে আজাদ পূর্ববঙ্গের মানুষের পাশে ছিল না। মর্নিং নিউজ পত্রিকাও ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু এটাও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের তল্পিবাহক। দৈনিক সংবাদ ছিল নুরুল আমিনের পত্রিকা। সুতরাং বাংলার স্বার্থবিরোধী। অন্যদিকে পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশিত হলে তা অনেকদিন পর্যন্ত বাংলার মানুষের কথা বলেছে। তখন আমরা ছিলাম এই পত্রিকাটির নিয়মিত পাঠক। পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী রাজনৈতিক ডিগবাজি খাওয়ার পর ওই পত্রিকাটিও পাকিস্তানের খয়ের খাঁ-তে পরিণত হয়। তখন আমরাও পত্রিকাটি বর্জন করি।
যখন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রকাশ করেন, তখন পত্রিকাটি হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার মজলুম জনগণের মুখপত্র। মানিক মিয়ার ব্যতিক্রমধর্মী শক্তিশালী লেখনীর প্রভাবে পত্রিকাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, তার দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর ছিল অপরিহার্য। বাংলার মানুষ জনমত নির্বিশেষে ইত্তেফাক পত্রিকার পাঠক হয়ে পড়ে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ সচেতন করে তোলে। আমরাও ছিলাম ইত্তেফাক পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। ইত্তেফাক পত্রিকা মোকাবিলার জন্য সামরিক শাসক আইয়ূব খান একটি ট্রাস্ট গঠন করেন এবং তার মাধ্যমে দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার কাগজ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা ছিল আধুনিক এবং আকর্ষণীয়। এই পত্রিকায় প্রধান প্রধান খবর এবং সম্পাদকীয়তে থাকতো সামরিক শাসনের গুণগান। কিন্তু ফিচার ও সাহিত্যের পাতা ছিল আধুনিক ও আকর্ষণীয়। এই পত্রিকায় কাজ করতেন কবি আহসান হাবিব, কবি শামসুর রহমান, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ূন প্রমুখ। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। বলা বাহুল্য যে, আমরা ছিলাম এ পত্রিকার সাহিত্য পাতার নিয়মিত পাঠক। ইতোমধ্যে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার মালিকানা পরিবর্তন এবং জহুর আহমেদ চৌধুরীর সম্পাদনার ফলে পত্রিকাটির চরিত্র বদলে যায়। ষাটের দশকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মানিক মিয়ার মুসাফির ছদ্মনামে লিখিত ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ এবং সংবাদের জহুর আহমেদ চৌধুরীর ‘দরবারে জহুর’ কলামের নিয়মিত পাঠক ছিল দেশের অধিকাংশ মানুষ। ষাটের দশকের শেষ দিকে প্রকাশিত দি পিপলস পত্রিকাটিও অল্প সময়ের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। স্মরণীয় যে ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাতে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইত্তেফাক, সংবাদ ও দি পিপলস পত্রিকার অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর যে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, পূর্বদেশ, বাংলাদেশ অবজারভার ও বাংলাদেশ টাইমস। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এই পত্রিকাগুলোর ভূমিকা ছিল মূল্যবান। তবে কিছুকাল পরে যখন আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ ও ভোরের কাগজ প্রকাশিত হলো তখন আধুনিকতা ও নতুনত্বের ছোঁয়া পাওয়া গেল। আমরাও প্রথমে আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ ও পরে ভোরের কাগজের নিয়মিত পাঠক হয়ে পড়লাম। বলা যেতে পারে যে, এই তিনটি দৈনিক পত্রিকা বেশ কিছুকাল স্বাধীন বাংলাদেশের উপযুক্ত মুখপাত্ররূপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তবে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পঁচাত্তরের মর্মান্তিক রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির পর সামরিক স্বৈরাচার শাসিত বাংলাদেশে কোনও পত্রিকাই যথার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুর কথা পরিপূর্ণভাবে বলতে পারেনি। এই শূন্যতা ও অভাব পূরণ করেছিল কাজী শাহেদ আহমেদ সম্পাদিত দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকা। এই পত্রিকাটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মুখপাত্র। যখন স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নীরবতা পালন বা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র কৌশল অবলম্বন করতো তখন আজকের কাগজ পত্রিকা বলিষ্ঠভাবে বাঙালির অন্তরের কথা বলেছে। স্বাভাবিকভাবেই আজকের কাগজ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পেরেছিল। দুই-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘তুই রাজাকার’ কার্টুন সিরিজটির কথা স্মরণীয়। ওই কার্টুন সিরিজটির ফলে স্বৈরাচার শাসনামলের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাজাকারদের নাম বিস্মৃতির অতল থেকে পুনরায় ভেসে ওঠে। পরবর্তীকালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত যাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া হয়, তাদের প্রায় সবাই ‘তুই রাজাকার’ কার্টুন সিরিজে প্রদর্শিত হয়েছিল। আরেকটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন ‘ঘাতক দালাল নির্মূল’ কমিটির উদ্যোগে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দোসর গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের প্রতিবেদন, শিরোনাম এবং সম্পাদকীয় কোন পত্রিকায় কতটা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল তা তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ওই বিষয়ে আজকের কাগজ নির্ভীক ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে স্বাধীন বাংলাদেশে দৈনিক আজকের কাগজ পঁচাত্তর পরবর্তী দুই দশকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক ছিল। এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল একটি দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। আজকের কাগজের অগণিত পাঠকদের একজন হিসেবে আজও আমি এই পত্রিকাটির অভাব মর্মে মর্মে অনুভব করি।
আজকের কাগজের একুশ শতকের উত্তরসূরি হচ্ছে ‘বাংলা ট্রিবিউন’ পত্রিকা। একুশ শতকে তথ্য প্রযুক্তির যুগে কোনও আধুনিক পত্রিকাই কেবল প্রিন্ট মিডিয়াতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেনি। বর্তমানে পৃথিবীর সমস্ত উল্লেখযোগ্য পত্রিকার অনলাইন এডিশন রয়েছে। সর্বোপরি বিভিন্ন ভাষায় নতুন নতুন অনলাইন পত্রিকা বের হচ্ছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা কত আমার জানা নেই। তবে আমি এটুকু বলতে পারি যে আমাদের দেশের অনলাইন পত্রিকাগুলোর মধ্যে সবগুলোই পূর্ণাঙ্গ সংবাদপত্রিকা নয়। সেদিক থেকে বাংলা ট্রিবিউন একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। বাংলা ট্রিবিউন একটি পূর্ণাঙ্গ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ অনলাইন পত্রিকা যা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করেছে। অনলাইন পত্রিকার একটি বাড়তি সুবিধা রয়েছে। সেটা হলো এই যে, তার প্রকাশনার সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকার সংবাদ, সম্পাদকীয়, কলাম প্রভৃতি জুড়ে থাকে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব খবর, ঘটনাপঞ্জি ও সেগুলোর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষা ও প্রকাশরীতি অত্যন্ত আধুনিক।
আমি এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে, বাংলা ট্রিবিউন একুশ শতকের বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক, বস্তুনিষ্ঠ ও প্রগতিশীল মুখপত্র। আমি এ পত্রিকার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক