X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশপ্রেমের অর্থনৈতিক মূল্য কত?

মাসুদা ভাট্টি
১৩ মে ২০১৭, ১৩:১৪আপডেট : ১৩ মে ২০১৭, ২১:২২

মাসুদা ভাট্টি আমরা কতটুকু দেশপ্রেমিক? এই প্রশ্ন এখন কেন তুলছি? তার কারণ ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই এ লেখার অবতারণা।
প্রথমত, বাংলাদেশ নামক দেশটিকে আমরা যে ভালোবাসিনা তার বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, বিশেষ করে এখনকার উদাহরণ। কিন্তু এই দেশটিকে যে আমরা খুব ভালোবাসি তার প্রথম ও প্রধান উদাহরণ হচ্ছে, ১৯৭১ সালে এদেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দান। প্লেটো তার বিশ্বখ্যাত রিপাবলিক গ্রন্থে বলেছেন যে, দেশপ্রেমকে উসকে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে বহু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই কোনও মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য লাখে লাখে মানুষ প্রাণ দিয়েছে, নারীরা নিগৃহীত হয়েছে- অর্থাৎ বাংলাদেশকে ভালোবাসার জন্য কোনও মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন এখনও পড়েনি। পড়েছে সেই সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যাদের সাম্রাজ্যবাদ বা লুটপাটের মতো অত্যন্ত জঘন্য অতীত রয়েছে, যেমন ব্রিটেন বা অস্ট্রেলিয়া যারা দিকে দিকে রাষ্ট্রকে দখল করে পৃথিবী থেকে অনেক জাতিগোষ্ঠীকে নিঃশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, এসব দেশকে ভালোবাসার জন্য মিথ্যাচারের মাধ্যমে তাদের অতীতকে ঢাকতে হয়েছে নাগরিকের সামনে। বাংলাদেশের তেমনটি এখনও প্রয়োজন পড়েনি কিন্তু ভবিষ্যতে যে পড়বে না তা নয়, কারণ বাংলাদেশ তার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে এদেশে টিকতে দেয়নি এবং ক্রমশ তারা বিলুপ্তির পথে। সুতরাং আরও ২০/৩০ বছর নাগরিকের সামনে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিঃসন্দেহে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে, নাহলে সে পাপ বাংলাদেশ ঢাকবে কী দিয়ে?
যাহোক, আজকের বিষয় সেটি নয়, আজকের বিষয় দেশপ্রেম। বাংলাদেশকে ভালোবাসার জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও মিথ্যার প্রয়োজন নেই এবং এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক যে ধর্মটির চর্চা করে থাকে সেই ধর্মটি স্বাক্ষ্য দেয় যে, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে, বাংলাদেশকে এদেশের নাগরিকরা ভালোবাসবে। ভালোবাসেও, কিন্তু কখনও কখনও আমাদের মনে হয় যে, এদেশকে আসলে আমরা ভালোবাসি না। যেমন এই দেশটাকে আমরা যেভাবে অনাদরে, অবহেলায় ফেলে রেখেছি, কোনও প্রকার যত্ন ছাড়াই এদেশটি ক্রমশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে যে কারোরই মনে হতে পারে যে, দেশপ্রেম থাকলে এভাবে কি দেশটাকে রসাতলে যেতে দেওয়া সম্ভব হতো? ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক, ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ বর্জ্য আমরা যত্রতত্র ফেলে রাখি তাতে এই শহরটি বসবাসের অযোগ্য ঘোষিত হওয়া উচিত ছিল আরও আগে। কোনও প্রকার পরিকল্পনা ছাড়া ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রদর্শনের ময়দানে পরিণত করেছি আমরা এই শহরটিকে। কোনও শহরের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকলে কি এরকম পরিণতি হতো ঢাকা শহরের? আমরা প্রতিনিয়ত এই শহর যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে তা নিয়ে কথা বলি, ড্রইং রুমে বা চায়ের আড্ডায় টেবিল ভাঙার উপক্রম করি কিন্তু কার্যত কি এই শহরকে রক্ষার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে যে সচেতনতা দেখানোর প্রয়োজন, সেটুকু করি? যেমন, আমরা কলাটা খেয়ে তার খোসাটা কিংবা চানাচুর খেয়ে সেই প্যাকেটটা কোনও নির্দিষ্ট ময়লার ঝুড়িতে ফেলি? না ফেলি না, আমরা রাস্তায় ছুঁড়ে মারি নির্দয়ের মতো। আমরা কিন্তু একথা ভালো করেই জানি যে, প্লাস্টিক পঁচে না কয়েক হাজার বছর তা মাটির মধ্যে থেকে যায় এবং তা আমাদের অনাগত ভবিষ্যতকে বিষাক্ত করে তুলবে, তাও কিন্তু আমাদের হুঁশ নেই, আমরা আমাদের এই নিত্য-অপকর্মটি কোনও ভাবেই বন্ধ করি না। যেহেতু ব্যক্তির কোনও মাথাব্যাথা নেই, নেই কোনও দায় ও দায়িত্ব সেহেতু সমগ্র ও কর্তৃপক্ষও নির্বিকার কারণ কর্তৃপক্ষ পরিচালিত হয় ব্যক্তির দ্বারা। ফলে ব্যক্তিই যেখানে নির্বিকার সেখানে কর্তৃপক্ষ নির্বিকার থাকতে বাধ্য। দেশে আইন নেই তা নয়, কিন্তু আইনের প্রয়োগ হয় ব্যক্তির দ্বারা, ফলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইন কেমন যেন শূন্যে ঝুলে থাকা বায়ুর মতো কোনও বিষয়, আছে টের পাওয়া যায় কিন্তু তা ধরা যায় না।

আমরা প্রত্যেকেই খবরটি দেখেছি যে, ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে। না কোনও বিদেশি এই টাকা বাংলাদেশ থেকে চুরি করে কিংবা বাংলাদেশকে ঠকিয়ে নেয়নি। এই টাকা পাচার হয়েছে বাঙালির মাধ্যমে এবং বাঙালির দ্বারা। ব্যবসায়ীমহল বিদেশ থেকে জিনিসপত্র আমদানির সময় বাড়তি টাকার অঙ্ক দেখিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকের মাধ্যমে সেই টাকা বিদেশে পাঠিয়েছেন এবং বিদেশিদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে এই অপকর্ম করতে গিয়ে তাদেরকে কিছু মুনাফা দিয়ে টাকাটা বাইরে নিয়ে গিয়েছেন। এতে বহুবিধ অন্যায় হয়েছে যেমন দেশের টাকাকে তারা বাইরে নিতে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন তাতে দুর্নীতি হয়েছে, ব্যাংকিং সিস্টেমকে তারা ধোঁকা দিয়েছেন এবং তারা যে দেশে টাকা নিয়েছেন সে দেশের আইনও কিন্তু লঙ্ঘন করেছেন, কারণ সেখানেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বেশি অর্থ নিতে হলে সরকারকে কর দিতে হয়, যা তারা দিয়েছেন বলে প্রমাণ নেই। একটি অসৎ কাজ করতে তারা অসততার লাইন লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় অন্যায়টি তারা করেছেন দেশের সঙ্গে, এবং দেশপ্রেমের অভাব থেকেই এরকম অন্যায় করতে তাদের একটুও বাধেনি। যদি সামান্য দেশপ্রেমও তাদের থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে এতো বড় অন্যায় তারা দেশের সঙ্গে করতে পারতেন না।

হ্যাঁ, দেশ থেকে এরকম বিশাল অঙ্কের অর্থ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত সরকারকেই আমরা দায়ী করবো। কারণ সরকারের কাঁধে দায় চাপানো সবচেয়ে সহজ। এটা কেবল বাংলাদেশে নয়, সর্বত্রই এটা নিরীহ জনগণের একমাত্র রক্ষাকবচ। এখানেও সেই একই প্রশ্ন, সরকারতো একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র, এবং এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয় মানুষের দ্বারা। ফলে মানুষই যদি তার নিজের ভালো, দেশের ভালো না বোঝে তাহলে সরকারকে দোষারোপ করে কী হবে? আমরা অর্থমন্ত্রীকে গাল দিতে পারি, গাল দিতে পারি বাংলাদেশ ব্যাংককে, গাল দিতে পারি প্রধানমন্ত্রীকেও, কারণ সরকার পরিচালনায় এরা রয়েছেন। দেশের ভেতর থেকে এভাবে অর্থ বেরিয়ে যাওয়াটা অর্থমন্ত্রী বা তার মন্ত্রণালয় বুঝতে পারবে না বা তার মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ ব্যাংক জানতেও না পারাটা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু আগেই বলেছি, এখানের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তির দায় বেশি, আগে ব্যক্তিকে এখানে দায় নিতে হবে এবং তারপর প্রতিষ্ঠানকে আমরা দোষারোপ করতে পারবো।

হাওরে এবার প্রবল বন্যার ফলে ফসল ভেসে গেছে। এরকম বন্যার সম্ভাবনা প্রতিবছরই থাকে। তাই হাওরে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এবার যেহেতু আগাম বন্যা হয়েছে তাই বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল ভেসে গেছে এবং মূলত বাঁধ ভেঙেই এই পানি হাওরে ঢুকেছে। প্রধানমন্ত্রী বন্যা-বিধ্বস্ত হাওর এলাকা সফরের পর জানা গেলো যে, বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে এবং এখন এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা স্বীকার করছেন যে, তারা এই বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। আসুন প্রশ্ন করি, নিজের দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এরকম একটি বিপর্যয়ের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কেউ কি স্বার্থপর হয়ে বাঁধ নির্মাণের অর্থ আত্মসাত করতে পারে? প্রশ্নের উত্তরও আমরা জানি যে, না পারে না, পারার কথা নয়। কিন্তু এদেশে হয়েছে এবং এদেশে হবেও।

কত উদাহরণ দেবো আর? অসংখ্য উদাহরণ সম্ভব কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে দু’একটি কথা বলে উদাহরণের ইতি টানবো। আপনার সন্তানকে আপনি নিজেই যদি প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে কিনে দেন কিংবা জেনে-শুনেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা যদি প্রশ্নপত্র বাজারে ছেড়ে দেন তাহলে সে দায় আমরা কতটুকু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপাতে পারি? দেখুন, দায় আমাদের শেষ পর্যন্ত সরকারের ঘাঁড়েই চাপাতে হবে, কারণ সেটি সবচেয়ে সহজ কাজ। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটি? সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। নিজেকে প্রশ্ন করা যে, আমি কি ব্যক্তি হিসেবে আমার দায়িত্বটি ভালোভাবে পালন করছি? আমার কি দেশপ্রেম আছে? দেশের প্রতি, দশের প্রতি আমার কোনও দায়বোধ আছে? যদি থাকে তাহলে এই শহরের রাস্তায় আমি কলার খোসা কিংবা চানাচুরের ঠোঙা ফেলবো না; আমি ব্যবসায়ী হলে আমদানির সময় বেশি পরিমাণ মূল্য দেখিয়ে আমি এদেশের টাকাকে বিদেশে পাচার করবো না; আমি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করবো না। একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি নিজে এসব না করলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নগর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় একেবারে বাঁশের মতো সোজা হয়ে যাবে, যদি সোজা না হয় তাহলে আমাদের হাতে থাকবে আন্দোলনের মতো বিরাট গণতান্ত্রিক অস্ত্র। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আমি দায়বদ্ধতার কোনও প্রমাণ না রেখে আমি যখন প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে গালাগাল দেই তখন আমার গালাগাল কোনও কাজে আসে না, কারণ আরেকজন তখন আমাকে দেখিয়ে হাসেন আর বলেন, ‘চালুনি হয়ে সুইয়ের বিচার কেমনে চাস?’

আশা করি এর পরে আর আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না কেন আমি আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি আর এই প্রশ্নের উত্তরটিও কি দিয়ে দিতে হবে আর? আচ্ছা তাহলে বলেই ফেলি, আসলে দেশপ্রেমের যদি কোনও অর্থনৈতিক মূল্য থাকতো বা থাকে তাহলে এদেশ সামগ্রিক ভাবে তাতে খুব বড় কোনও সাফল্য দাবি করতে পারতো না। আমি মনে করি দেশপ্রেমেরও অর্থনৈতিক মূল্য আছে, যদিও অর্থনীতিবিদরা বিষয়টি আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন, তবুও একজন সামান্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে মনে করি যে, দেশপ্রেমের অর্থনৈতিক মূল্যমান নিয়ে আমাদের গবেষণা করা দরকার, কারণ, এটা নেই বলে বা এটার অভাবে আমরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি সেই গবেষণায় সেটি অন্তত বেরিয়ে আসবে। আমি নিশ্চিত যে, বছরে পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান আমাদের জানাচ্ছে, আমাদের সামগ্রিক দেশপ্রেমের অভাবের ফলে আমরা তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।

 

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ