X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মায়ের কাছে চিঠি

তসলিমা নাসরিন
১৫ মে ২০১৭, ১২:০০আপডেট : ১৫ মে ২০১৭, ১২:০২

তসলিমা নাসরিন তোমাকে ভালোবাসার কোনও চল আমাদের বাড়িতে কখনও ছিল না। বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম। বাবা ছিল আমাদের শিক্ষক। আমাদের নীতি আদর্শ বোঝাতো। সকাল সন্ধ্যে কেবল জ্ঞান দিত। বড় হওয়ার, ভালো হওয়ার, সৎ হওয়ার, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। বাবার টাকায় আমাদের খাওয়া হত। বাবা কিনে দিলে কাপড় জামা পেতাম।  বাবা ইস্কুলে ভর্তি করাতো, বই খাতা কিনে দিত, মাস্টার রেখে দিত। বাবা কলেজে পড়াতো, কলেজে যাওয়ার রিক্সা ভাড়া দিত। বাবার বাড়ি। বাবার টাকা। বাবার সব। বাবা ভালোবেসে কাছে টানতো। রাগ হলে পেটাতো। জন্মের পর বাবাকেই দেখেছি পরিবারের সবচেয়ে বড় একজন মানুষ। যে সবচেয়ে বেশি বিদ্বান। যার আদেশে যার উপদেশে সংসার, সন্তান চলে। তুমি ক্রীতদাসী, পড়ে থাকতে রান্নাঘরে, দৌড়ে দৌড়ে বাবার আদেশ মতো কাজ করতে। বাবার ধমক খেতে। বাবাকে খুশি করার জন্য তোমার পরিশ্রমের শেষ ছিল না। সেই ছোটবেলায় বাবার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তোমার প্রতি হবো কেন বলো তো!
যমের মতো ভয় পেতাম, আবার মানুষটিকে ভালোওবাসতাম। তার অপকর্মের জন্য যত ক্ষমা তাকে করেছি, তার সামান্যও  তোমাকে করিনি। অপকর্ম না করলেও তোমার পান থেকে চুন খসলেই গর্জে উঠেছি, বাবা যেমন গর্জে উঠতো। বাবা যেমন তোমাকে মানুষ বলে মনে করতো না, আমরাও মনে করতাম না মা। বাবা ছিল আমার, আমাদের শিক্ষক।  তুমি চাইতে বাবার কথা শুনি, বাবার উপদেশ মানি, আবার তোমাকেও একেবারে হেলা না করি। শিক্ষক তোমাকে হেলা করতো, তাই হেলা করতে শিখেছি। শিক্ষক যা বলে, তাই কি শুধু শুনেছিলাম, শিখেছিলাম; শিক্ষক যা করে, তাও করেছিলাম! পুরোটা শৈশব, কৈশোর, যৌবন জুড়ে শিখেছি। তোমাকে হেলা করতেই শিখেছি। আসলে মানসিকতা ওই শৈশব-কৈশোরেই গড়ে ওঠে। সেটি নিয়েই আমরা বাকি জীবন কাটাই। খুব বড় কোনও পরিবর্তন পরবর্তী জীবনে আসে বলে মনে হয় না। তা না হলে তোমার একাকীত্বের দিকে কখনও আমি তাকাইনি কেন? আমি তো কত কারও কষ্টে কেঁদেছি, তোমার কষ্ট আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি কেন? তোমাকে ক্ৰীতদাসী ভেবেছিলাম, ভাবতে শিখিয়েছিল, বাবা, তোমার স্বামী, তোমার প্রভু। আমি জানি না বাবার দোষ দিয়ে আমি একরকম পার পেতে চাই হয়তো। নিজের দায়িত্ব বলে কিছু কি ছিল না আমার, যখন বড় হলাম? তোমার প্রতি কোনও দায়িত্ব আমি বোধ করিনি। তুমি মা। তাতে কী? যখন আঘাত পেতে, বারবার বলতে, “আমি তো মা, আমি তো মা।” তুমি যে মা সে কথা ভুলে থাকি বলে অভিযোগ করতে। হয়তো অভিযোগও করতে না, একা একা কষ্ট পেতে পেতে স্বগতোক্তি করতে। তোমার সঙ্গে অত জঘন্য আচরণ করি কেন, তুমি তো মা।  মা বলে তুমি ভালোবাসা আশা করতে না, না পেতে পেতে তোমার অভ্যাস ছিল না পাওয়ার, শুধু চাইতে তোমাকে অত বিচ্ছিরিভাবে অপমান যেন না করি।  যেন অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে বাবার মতো না হই।  বাবার মতো হওয়ার স্বপ্নই তো ছিল আমার জীবনভর। বাবার মতো আদর্শবান, পর্বতের মতো উঁচু, ভেঙে না পড়া, মচকে না যাওয়া, পরোয়া না করা, দৃঢ়, ঋজু। বাবার মতো বস্তুবাদী, বিজ্ঞান মনস্ক, কুসংস্কার-না-মানা, ধর্ম-না-মানা, কর্মঠ নিষ্ঠ। এই গুণগুলোকে না ভালোবাসার কোনও কারণ ছিল না। বাবার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে মতবিরোধ হওয়ার পরও বাবা হতে চাওয়া থেকে আমি বিরত থাকিনি। বাবার মতো সবল, সাহসী, সত্যবদ্ধ আর সুশৃঙ্খল আমরাও যেন হই, চাইতে। কিন্তু বাবার চেয়েও মানুষ হিসেবে বড় হই, সহিষ্ণু হই, বিনম্র হই, নিরহংকার হই, উদার হই, এও চাইতে। তুমি কি তোমার নিজের জন্য অপমানিত না হওয়া চাইতে! নিজেকে ভালো লাগা দিতে! আসলে আমাদের জন্যই চাইতে। যেন আমরা কাউকে ঘৃণা না করে, কাউকে অশ্রদ্ধা না করে মানুষ হই, বড় মানুষ। বাবাও চাইতে আমরা যেন মানুষ হই। তোমাদের চাওয়ায় কোনও কার্পণ্য ছিলো না। শুধু মানুষ বলতে দুজনে দুরকম বুঝতে। 

ছোটবেলায় তুমি আমার মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে। উকুন হলে উকুন বেছে দিতে, জামা কাপড় নিজে সেলাই মেশিনে তৈরি করে দিতে, নোংরা হলে কেচে দিতে। আমার বিছানা, আলনা, আলমারি, কাপড়াচোপড়, বইপত্র গুছিয়ে রাখতে। দিন রাত পড়ছি, মাথাটা যেন ভালো কাজ করে, মাথাটা যেন পড়া মনে রাখে, সে কারণে আমার যে একটু ডিম দুধ খাওয়া দরকার, মাছ মাংস খাওয়া দরকার, একটু যে ফল দরকার – এগুলো বাবার কাছে কতভাবে যে বলতে। আমরা তো সবাই বাবার ওপরই নির্ভর ছিলাম, এরকম তো নয় যে তোমার সাধ্য ছিল কিছু কেনার। সাধ্য থাকলে কী না করতে তুমি! তোমার হাতে যখনই কিছু টাকা এসেছে, তখনই তুমি কারও না কারও জন্য কিছু কিনেছো। নিজের জন্য কিছুই কোনওদিন কেনোনি। যখন নানিবাড়ি বা তোমার বোনের বাড়ি যেতে, সেই যাওয়ার রিক্সা ভাড়াটাও, দু টাকা কী তিন টাকা, তোমাকে চেয়ে চেয়ে নিতে হতো বাবার কাছ থেকে। বেশিরভাগ সময়ই বাবা দিত না। তুমি তোমার ভাই বোনের কাছ থেকে চাইতে। সংকোচ হতো তোমার। কিন্তু উপায়ই বা কী ছিল। তোমার ভাইবোনকে, তোমার বাবামাকে তুমি অনেক কিছু, সামান্য কিছু হলেও উপহার দিতে চাইতে। কাউকে কিছু দিতে পারার ক্ষমতা ছিল না তোমার। তোমার মতো নিঃস্ব কী জগতে দ্বিতীয় কেউ ছিল। চাকরি করাকালীন আমি জানি না কখনও তোমার হাতে কোনও টাকা দিয়েছি কিনা। যদি দিয়েও থাকি কোনওদিন, টাকাটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সামান্য কটা টাকা নিয়েই চলে যেতে আমার জন্য আমার ভালো লাগে এমন কিছু কিনে আনতে।  মা, আমার আজ মনে হয়, তুমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসতে না। স্বামী সস্তানকে ভালোবাসলে যে নিজেকে ভালোবাসতে হয় না, কে তোমাকে শিখিয়েছিলো!

আমাকে হয়তো অনেকে সান্ত্বনা দেবে এই বলে যে, আমার মানসিকতাও আর সব মেয়ের মত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকে থেকে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে গড়ে উঠেছিলো, এ দোষ তাই আমার নয়। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার অভ্যেস নেই আমার। দোষ আমারই। এ কথা সম্পূর্ণই ঠিক যে, আমি আসলেই ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করতাম মেয়েদের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই, তাদের জন্মই হয়েছে স্বামীসেবার জন্য, জন্মই হয়েছে পুরুষের দাসত্ব করার জন্য। পুরুষের অধিকার আছে স্ত্রীর বাইরে যে কারও সঙ্গে মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক করার, কোনও মেয়ের সে অধিকার নেই। ভালো মেয়ে হতে চাইলে একনিষ্ঠ হতে হয়, পতিব্রতা হতে হয়। আমার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তোমাকে একা পেয়ে, নিরীহ পেয়ে, শক্তিহীন পেয়ে চরম আঘাত করেছে।

আমি খুব ভালো করেই জানি যে তোমাকে যত অবজ্ঞা করেছি, তত অবজ্ঞা আমি কাউকে করিনি। তত অসম্মান পৃথিবীর কাউকে আমি করিনি। যত ঘৃণা করেছি সত্যি বলতে কী, তত আর কাউকে করিনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অনুশোচনা আমি কেন করি এখন? তুমি নেই বলেই তো! তুমি যদি থাকতে, এই অনুশোচনাটা করতাম বলে মনে হয় না। যেমন তোমাকে ভুলে ছিলাম, তেমনই থাকতাম। কারও বোধদয় হওয়ার জন্য যদি অন্য কারও মৃত্যুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই বোধদয়ের মূল্য কি সত্যিই কিছু? আমার এই বোধের জন্য, বিশ্বাস করো না না করো, আমারই লজ্জা হয়।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ