X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব রাজনীতি বদলে দেবে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৮ মে ২০১৭, ১৩:০৩আপডেট : ১৮ মে ২০১৭, ১৩:১০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নেপোলিয়ন বলতেন চীন জেগে উঠলে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেবে। বহু প্রাচীন সভ্যতার দেশ। কাঠের অক্ষর বানিয়ে ছাপাখানার প্রচলন করেছিলো চীন। সর্বপ্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলনও হয়েছিলো চীনে। হোয়াং হোর তীরে চীন রাজবংশ তাদের রাষ্ট্র কায়েম করেছিলো আর তাদের নাম অনুসারে রাষ্ট্রের নামও রেখেছিলো চীন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে চীনের হাতে এত বেশি অর্থবিত্ত জমা হয়েছে যে এই অর্থ চীনে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। তাই চীন এখন এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পনার নাম দিয়েছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’।
বিশ্বকে স্থল ও জলপথে অবাধ করে তোলা। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট প্রথম এই পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। মাও দেশটাকে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। মাও এর মৃত্যুর পর দেং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ পরিহার করে বাজার অর্থনীতির পথ ধরেছিলেন। আর বাজার অর্থনীতির পথে চীন এখন এত সমৃদ্ধির পথে গিয়ে পৌঁছেছে যে অর্থবিত্তে চীন এখন বিশ্বের শীর্ষে। তার রিজার্ভ এখন সাড়ে তিন লক্ষ বিলিয়ন ডলার।
গত ১৪ ও ১৫ মে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ এর সম্মেলন হয়েছে বেইজিং-এ। সর্বমোট ২৯টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ ১০০টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ভারত ছাড়া চীনের আশপাশের সব দেশই সম্মেলনে যোগ দিয়েছে, বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, মিয়ানমার ও পাকিস্তান। এই আন্তঃসংযোগের উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করবে। নৌ-বাণিজ্যের যে রোড নির্ধারিত হয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে বিশ্বের ৬৫টি দেশের সংযোগ স্থাপিত হবে। সেখানে বিশ্বের ষাট শতাংশ মানুষের বসবাস আর বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন হয় এই অঞ্চলে।

এই পরিকাঠামো সংস্থাপনের কাজ সম্পন্ন হলে বিশ্বায়ন দ্বিতীয় পর্বে উন্নীত হবে। আর চীনের সম্পর্ক সম্প্রসারিত হবে কার্যকরভাবে এবং চীনের মর্যাদাও সংহত হবে। বিশ্বায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্ত ভিত্তির ওপর নেই। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যুদ্ধ, সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ এবং শরণার্থী ও অভিবাসীদের দ্বারা। এই সব বাধা ব্যাপকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করছে। এককভাবে কোনও দেশ এইসব বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। যদিও বা চীন এই ইনিশিয়েটিভে একাই সিংহভাগ অর্থ বিনিয়োগ করবে তবুও ৬৫টি দেশকে এই ইনেশিয়েটিভ একটা সমন্বয় প্রক্রিয়ার মাঝে নিয়ে আসবে।

চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন রাজহংস ঝড় মোকাবিলা করে ঐক্যবদ্ধভাবে। তাই তারা ঝামেলা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় না। কারণ ঝড়ের সময় তারা ঐক্যবদ্ধ থেকে টিম হিসেবে কাজ করে। এটা ছোটবড় ৬৫টি দেশকে নিয়ে টিম গঠন করে বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চীনের একক প্রয়াস। ছোট পরিসরে আমেরিকা মার্শাল পরিকল্পনা করে বিশ্বযুদ্ধের পরে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোকে এমনিভাবে সহায়তা প্রদান করেছিলো। চীনের ইনিশিয়েটিভটা ব্যাপক। কারণ অনেকগুলো দেশকে মূল রুটে সংযোগ স্থাপন করতে তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করতে হচ্ছে। চীন তাতেও অর্থায়ন করতে দ্বিধা করছে না। সম্ভবতো এই সুযোগ চীনা মুদ্রা ইউয়ান আন্তর্জাতিক লেনদেনের মিডিয়া কারেন্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশেরও সুবিধা পাবে।

ভারত ছাড়া অন্য কোনও বড় দেশ এই সম্মেলনকে উপেক্ষা করেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শক্তিশালী প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে এই সম্মেলনে। জাপান লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির উচ্চপদস্থ এক নেতা ও একজন ভাইস মিনিস্টার জাপানের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি ডিরেকটর ম্যাট পাটওঞ্জার এর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। চীন থেকে পাকিস্তানের গোয়াদরে নির্মিয়মাণ ইকোনমিক করিডোর পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে নির্মাণ করায় ভারত সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত রয়েছে। কারণ ভারত দাবি করে যে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর তারই অংশ। অথচ বিগত ৭০ বছরব্যাপী কাশ্মীরের ওই অংশটি পাকিস্তানের দখলে রয়েছে। এইরূপ একটি তামাদি হওয়া বিষয় নিয়ে ভারত নিজেকে ঘরের মাঝে আবদ্ধ রাখাটা উত্তম সিদ্ধান্ত বলে কেউই মনে করেনি। অথচ ভারত, চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথ উদ্যোগে ব্রিকস ব্যাংক গঠন করেছে। এই ব্যাংকটা প্রকৃত পক্ষে বিশ্বব্যাংকেরই প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংক।

চীনের সঙ্গে এতো বড় যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের পর শতাব্দী প্রাচীন একটা সমস্যাকে উপজীব্য করে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ থেকে বিরত থাকার ভারতের যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না। অথচ ভারতের দাবি অনুসারে ভারতের লাদাখের ওপর দিয়ে চীন সড়ক নির্মাণ করেছে। এখনও ভারতের ১৪ হাজার বর্গমাইল পাহাড়ি এলাকা চীন দখলে থাকার পরও ভারত চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্রিকস ব্যাংক করতে দ্বিধা রোধ করেনি। যে সমস্ত বিরোধ ভারত আর চীনের মাঝে বিদ্যমান তা ব্রিটিশের সময়েও ছিল কারণ ম্যাকমোহন লাইনকে চীন কখনও সীমান্ত লাইন হিসেবে মেনে নেয়নি। এইসব বিরোধ সহজে মেটার নয়। মনে হয় ভারতের উচিৎ হবে অনুরূপ অভিমানী সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসা।

নেহরু দেশভাগের পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারতে সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বার্থক হয়েছিলেন ধনতন্ত্রের বিকৃত উৎকর্ষ সাধনে। নরসীমা রাত্ত এর অর্থমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং নেহরু-ইন্দ্রিরার পথ পরিত্যাগ করে বাজার অর্থনীতির বলয়ে প্রবেশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সফলতার মুখও দেখেছিলেন। চন্দ্র শেখর যে ৫৪ টন রিজার্ভের স্বর্ণ বিক্রি করে দিয়েছিলেন মনমোহন তা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে এনে পুনরায় রিজার্ভে রেখেছিলেন। এই সময়ে চীনে দেং পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। দেং রেজিমেন্টেশন ভেঙে চীনকে তখন বাজার অর্থনীতির পথে নিয়ে আসেন এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাইওয়ানের শিল্পপতিরা পর্যন্ত নির্ভয়ে চীনে শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছিলো।

চীন এবং ভারত বিশ্বের দুই বৃহৎ রাষ্ট্র। দুই রাষ্ট্রের অবস্থান পাশাপাশি। উভয় রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ছেড়ে বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে একই সময়ে। তখন উভয়ের মাঝে একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। কিন্তু চীন প্রতিযোগিতায় ভারতকে হারিয়ে ঊর্ধ্ব মর্গে আরোহন করেছে। আমি লক্ষ্য করেছি ভারতের সর্বত্র এই নিয়ে একটা মনোবেদনা রয়েছে। ভারতীয়দের এই মনোবেদনা শাসক কূলের জন্য হীনমন্যতার জন্ম দিলো কিনা কী জানি! এজন্য আমি সম্মেলনে ভারতের যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘অভিমানী সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছি’।

মধ্য এশিয়ার প্রাচীন সিল্ক রোডটাকে মূলত পুনঃজীবিত ও পুনর্বিন্যাস করছে চীন। চীনের এই স্থলবাণিজ্য রুটটা মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বহু দেশকে রেল, সড়ক দিয়ে বন্দর সমূহের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ধীরে ধীরে এই রুটের দেশগুলোর মধ্যে স্থলপথে বাণিজ্যিক লেনদেন সম্প্রসারিত হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হলে দেশগুলোর উন্নয়ন ও তরান্বিত হবে। জনপথে ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ বা মুক্তার মালা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চীনের অবস্থান শীর্ষে গিয়ে পৌঁছবে। চীনের অপ্রতিরুদ্ধ উন্নয়ন দেখে আমেরিকা প্রশান্ত মহা-সাগরে তার নৌশক্তির ষাট শতাংশ স্থানান্তরিত করেছে, এখন চীন আমেরিকার এই হুমকি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তার নৌশক্তির সম্প্রসারণের কাজ খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছে। বিমানবাহী জাহাজ আছে আমেরিকার ১২ খানা চীনের বিমানবাহী অত জাহাজ না থাকলেও তারা সমুদ্রে নৌযান আক্রমণে সক্ষম মিসাইল তৈরি করে ফেলেছে অবশ্য চীনও বিমানবাহী নৌযান তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান চীনের নৌ-বাণিজ্য প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর ভিত্তিক তাতে আমেরিকার আধিপত্য মূলত অধিক আমেকিার সঙ্গে ভারতও হাত মিলিয়েছে সুতরাং নৌ-বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত রাখতে চীনকে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। যেন কোনোভাবে নৌপথে চীন প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়।

ভারতকে হাতে ধরে চীন ব্রিকস্ ব্যাংকে নিয়ে এসেছিলো। এই উদ্যোগে উভয়ে যৌথ প্রয়াস চালাতে দ্বিধায় ভোগেনি। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ভারত যোগদান করলে উদ্যোগটা আরো সহজ হতো দ্রুত হতো এবং আগামী শতাব্দীগুলো এশিয়ারই শতাব্দী হতো। শ্রীলংকায় নিজেদের লোক ক্ষমতায় বসিয়ে নেপালকে অবরোধ করে বাংলাদেশে ধমক দিয়ে কখনও নিজের পক্ষে রাখার প্রয়াস সফল হবে না কারণ চীন প্রত্যেকের উন্নয়নে স্রোতের মতো টাকা ছড়াচ্ছে আর এই রাষ্ট্রগুলোরও সাহায্যের প্রয়োজন। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে ভারতের উচিৎ হবে এই ইনিশিয়েটিভ এর প্রতিকূলে না গিয়ে অনুকূলে অবস্থান নেওয়া।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ