বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার সাফাত আহমেদের বাবা, আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, অভিযোগ আছে যে, আপনারা টাকা-পয়সা দিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চাচ্ছেন। জবাবে দিলদার আহমেদ কিছুটা হতাশার সুরেই বলেন, ‘ভাই এটা এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় ব্যাপার ধামাচাপা দেওয়া যায় না। ’ এমনকি তিনি এও বলেছেন, বিষয়টা নিয়ে এত ঝামেলা হবে জানলে তিনি নিজেই ছেলেকে পুলিশে দিতেন। প্রসঙ্গত, ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে দিলদার আহমেদ প্রথমে ছেলের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছিলেন, ‘ওই রাতে যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটি সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়েছে। ’
প্রশ্ন এখানে বেশ কয়েকটি।
১. যেই বাবা ধর্ষক ছেলের বিরুদ্ধে সাফাই গান, তারও বিচার হওয়া উচিত কী না এবং তাকেও গ্রেফতার করা উচিত কি না?
২. অভিভাবক হিসেবে তিনি তার সন্তানকে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শেখাতে যে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে কি না?
৩. বিপুল বিত্ত-বৈভব আর প্রাচুর্যের ভেতরে বেড়ে ওঠা সাফাত আহমেদের মতো আরও কত শত, কত হাজার তরুণ এভাবে পরিবারের প্রশ্রয়ে ধর্ষক হয়ে উঠেছে বা উঠছে, তা খতিয়ে দেখা বা অনুসন্ধানের কোনও উদ্যোগ রাষ্ট্র কি নেবে?
৪. যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাফাতরা পড়ালেখা করেছে, সেখানে শিক্ষকরা তাকে কী শিখিয়েছেন; যে ছেলে পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে এ কথা অকপটে স্বীকার করে যে, সম্মতি এমনকি অসম্মতিতেও কোনও নারীর সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন যে অপরাধ, সেটি তার জানা ছিল না?
৫. সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, কী করে-সেই খবরটুকু যে অভিভাবক বা পরিবার রাখে না, এরকম কত হাজার পরিবার দেশে বিদ্যমান-তার একটি তালিকা কি করা হবে?
৬. আমরা জঙ্গিবাদ নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, এই বখে যাওয়া তারুণ্যকে নিয়ে কি সে পরিমাণ উদ্বিগ্ন?
আমরা আবারও দিলদার আহমেদের কথাতেই ফিরি। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাপার বলে এখন আর তারা এটাকে ধামাচাপা দিতে পারছেন না। তার মানে তারা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুলিশকে যে মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন, তা প্রথমে মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসিতেই সন্দেহ আসতেই পারে। বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে খোদ ঢাকা মহানগর পুলিশ। আর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা এমনভাবে বনানীর পুরো ঘটনাটির তদন্ত করছেন যে, এটি দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রতিদিন বা প্রতিনিয়ত এরকম ধর্ষণ, খুনসহ নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হয়। সব খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে না। মূলধারার গণমাধ্যমেও আসে না। অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়া হয় পয়সায়। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে যারা থাকেন, তাদের পক্ষে যেকোনও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া বা সমঝোতা করা সহজ। যেমন বনানীতে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীকেও সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে, ফলে এখন আর এটি ধামাচাপা দেওয়া বা সমঝোতার সুযোগ নেই। অর্থাৎ দিলদার আহমেদের ভাষায় এটি এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার।
বনানীর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আপন জুয়েলার্সের বিভিন্ন শাখায় অভিযান চালিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। একাধিক শাখা সিলগালাও করে দেওয়া হয়েছে। সাফাত ও ও তার বাবার ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে তাদের অবৈধ সম্পদ। এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনও কারণ নেই যে, আপন জুয়েলার্সের মালিকের সব সম্পদই বৈধ। বরং যিনি ধর্ষক ছেলের পক্ষে সাফাই গান এবং যার প্রশ্রয়ে সন্তান ধর্ষক হয়ে ওঠে, তিনি যে বৈধ সম্পদের মালিক নন, এটা বুঝতে কোনও অনুসন্ধান বা গবেষণার প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন-
৭. এবার কি সব অবৈধ সম্পদের মালিকদের একটা তালিকা রাষ্ট্র তৈরি করবে?
৮. শুধু আপন জুয়েলার্স কেন, অন্য সব জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণব্যবসার অন্ধকার দিকটি কি উন্মোচিত করা হবে? নাকি রাষ্ট্রীয় ব্যাপার বলে শুধু আপন জুয়েলার্সই ফাঁসবে, এবং অন্যরা ধোয়া তুলসিপাতা হয়েই থাকবে?
৯. বিমানবন্দরে প্রায়ই শুল্ক গোয়েন্দারা স্বর্ণের চালান আটক করেন। বড় বড় চালান। কেজি কেজি স্বর্ণ। প্রশ্ন হলো, অবৈধ পথে আসা সব স্বর্ণই কি ধরা পড়ে নাকি যেসব চালানে দেন-দরবার বা সমঝোতা কিংবা বনিবনা হয় না, কেবল সেগুলোই ধরা পড়ে? ধরা পড়া এসব স্বর্ণের পুরোটাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয় কি?
১০. বনানীর ঘটনায় দায়ের করা মামলার ৫ আসামিই এরইমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। মামলা নিতে বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ থাকলেও মামলার পরে আসামি গ্রেফতারে পুলিশের তৎপরতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। প্রশ্ন হলো, যদি বিষয়টা নিয়ে গণমাধ্যম ও ফেসবুকে তোলপাড় না হতো, তাহলে পুলিশের এই তৎপরতা কি আমরা দেখতে পেতাম? প্রতিদিন আরও অসংখ্য অপরাধ ঘটে, সব অপরাধের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি স্বপণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নেয়?
১১. সবশেষ প্রশ্ন হযরত আলী। মেয়ের শ্লীলতাহানীর বিচার না পেয়ে যিনি মেয়েকেসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন সম্প্রতি। অত্যন্ত বেদনাদায়ক, মর্মস্পর্শী এবং আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো এই নির্মম ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেবল একজনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ। পলাতকদের গ্রেফতারে উদ্যোগ নেই। বাংলা ট্রিবিউনকে তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, ‘তারা (আসামি) কেউ বাড়িতে নেই। ’ আসামিরা বাড়িতে বসে থাকবে আর পুলিশ গিয়ে তাদের ধরে নিয়ে আসবে, এমন কথা অবশ্য আমরা আগে শুনিনি। তবে হযরত আলীকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ কম। কারণ এটা দিলদার আহমেদের ভাষায় এখনও ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাপার’ হয়ে ওঠেনি।
লেখক: সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।