X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘটনাকেন্দ্রিক নয়, প্রয়োজন মতাদর্শিক আন্দোলন

জোবাইদা নাসরীন
২১ মে ২০১৭, ১৩:২৬আপডেট : ২১ মে ২০১৭, ১৩:৩৩

জোবাইদা নাসরীন বনানীর এক হোটেল দুই নারী ধর্ষণের ঘটনায় জেগে ওঠেছে বাংলাদেশ। এখন সামাজিক মাধ্যম অনেক বেশি শক্তিশালী, মানুষ খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারছে সব কিছু্। যার কারণে জানার সাথে সাথে তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সচলতা অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রেও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মানুষের এই ধরনের সচেতনতা এবং জেগে ওঠা এই প্রথম নয়। কিন্তু এই জেগে ওঠাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনাকেন্দ্রিক। কারণ অপরাধের মতাদর্শিক প্রতিরোধ আমাদের মাঝে নেই, আমরা এটিকে জীবন যাপনের রাজনীতির সাথে যুক্ত করে দেখি না, খুবই বিচ্ছিন্নভাবে মানবাধিকার লংঘন বা নির্যাতন হিসেবে দেখি, তাই শুধু ঘটনা ঘটলেই আমরা আওয়াজ দেই। আর এভাবেই আমাদের প্রতিনিয়ত জিইয়ে রাখা এই অরাজনৈতিক চর্চা অপরাধপ্রবণতাকে উস্কে দেয় এবং অপরাধকে সংস্কৃতিতে পরিণত করতে কিভাবে খানাখন্দ দিয়ে যাচ্ছে তা একবারের জন্য ভেবে দেখি না।
যদি পরিবার থেকেই শুরু করি, তাহলে কী দেখবো- নারী পুরুষের সম সম্পর্কের যে রাজনৈতিক চর্চা পরিবার থেকে চর্চিত হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে মতাদর্শিক রাজনৈতিক পরিসরের বদল না হওয়াতে বারবারই একই ধরনরে ঘটনা বার বার ঘটছে। যে কারণে একজন নারীর নিরাপত্তা নিয়ে পরিবার যেরকম চিন্তিত থাকেন, তাকে ঘরে রাখেতই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাকে ছোটবেলা থেকেই নিরাপত্তা বলয়ে রাখা হয়। তাকে প্রতিদিন বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে নিরাপদ নয়। কিন্তু তার পাশাপাশি যে কারণে তার এই অনিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়, তাকে কোনও ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয় না। বরং  ছেলে সন্তানটিকে লিঙ্গীয় রাজনীতি কিংবা তার পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের কারণে কী কী নির্যাতনের পরিসর তৈরি হতে পারে সেই বিষয়ে কোনও ধরনের সচেতনতা তৈরি করা হয় না। পরিবারের ছেলেটি কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরবে, কোথায় কী করছে সেই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবারের উদাসীনতা সমাজে আদৃত। এর পাশাপাশি 'বরই গাছ থাকলে সবাই ঢিল দিবে' জাতীয় প্রবাদের মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিদিনই পুরষতান্ত্রিক রাজনীতিকে উৎসাহ দিয়ে চলছি। এর পাশাপাশি রাস্তাঘাটে নারীর প্রতি যৌন হয়রানী মূলক বাক্য ছুঁড়ে দেওয়াকেও এই সংস্কৃতির অংশ মনে করা হয়। গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, প্রায় ৯২% পুরুষই নারীকে দেখে শিষ বাজানো, নারীর শরীর কেন্দ্রিক মন্তব্য এবং পাবলিক পরিসরে নারীর প্রতি যৌন হয়রানীকে অপরাধ মনে করেন না। যার মধ্য দিয়ে এই ধরনের চর্চাকে, পুরুষতান্ত্রিকতাকে সংস্কৃতি হিসেবে ধরে নিয়ে এর ক্ষমতাজনিত অপরাধকে বৈধতা দেওয়া হয়। যে কারণে বনানীর ধর্ষকদের একজন খুবই দাম্ভিকভাবে বলেন যে, তিনি ধর্ষণকে অপরাধ মনে করে না সেই। তারও একধাপ ওপরে ছিলে সেই ধর্ষকের বাবার বক্তব্য। এসবই জানা।

‘মেয়েরা স্বভাবতই শান্ত হয় এবং ছেলেরা একটু দুষ্টু প্রকৃতির হয়’ এই মতাদর্শিয় সামাজিক লাল পক্ষান্তরে ছোটবেলা থেকেই ছেলেটির পৌরুষদীপ্ততাকে সমর্থন জোগায়। ছোটবেলার দুষ্টুমির বাহবা বা মারধরের পারদর্শিতাকে আমরা সাহস হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা তাকে নিয়ে কোনও টেনশন করি না। আমাদের পরিবারেই আমাদের সাথে বড় হওয়া আমাদের আদরের ভাইটি ঘরের বাইরে অন্য নারীর প্রতি কী আচরণ করছে আমরা তা জানি না, কিংবা জানলেও 'আমার ভাই এটা করতে পারে না' জাতীয় মনোভাব ব্যক্ত করি। কিন্তু আমরা কখনও মনে করতে পারি না যে সে ভাইয়ের সাথে তার আচরণ সংক্রান্ত বিষয়ে ছোটবেলা থেকে কোনও কথা বলেছি কিনা। পরিবারের ছেলেটিকে মতাদর্শিক আচরণ শেখানোর আমাদের এই অনভ্যস্ততাই নারীর প্রতি অসম্মান এবং ধর্ষণের ঝোঁক তৈরি করে।

সেই পরিণতি হিসেবেই আমাদের মনোজগতে এখনও ধর্ষণ নারী ইস্যু। তাই আমরা আশা করি নারী এবং নারী সংগঠনগুলোই এর প্রতিবাদ করবে। নারীকেই তার নিরাপত্তা নিয়ে নারীকেই ভাবতে হবে - এই জাতীয় মনস্কতার প্রাধান্যশীলতাই বেশি। আর এই ইস্যু অতি জরুরি বিষয়ে পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে চলমান অন্যমনস্কতা ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অতি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধকে আমরা 'ঘটনা' কেন্দ্রিক অবস্থায় নিয়ে যাই। আর তখনই পুরষতান্ত্রিকতায় বড় হওয়া নারীরাও প্রশ্ন তোলেন , মেয়েগুলো অতো রাতে কেন হোটেলে গেলো? পুলিশকে কেন সাথে সাথে জানানো হলো না, কেন কিছুদিন পর জানানো হলো? এই বয়সে ছেলেরা একটু আধটু এই রকম করেই!

আমরা লিঙ্গীয় নির্যাতনের কারখানাগুলোকে মতাদর্শিকভাবে না নেওয়া এবং এর চর্চার ঘাটতি দেখা যায় প্রতিরোধের সংস্কৃতির ওপরও। এক একটি ঘটনা ঘটে আমরা ফেসবুক, মানববন্ধন কিংবা মিছিল করি। এটির স্থায়িত্ব বড় জোর ১০/১২ দিন। তারপর আমরা এটে ভুলে যাই, কারণ এটা একটা ঘটনা কেন্দ্রিক নির্যাতনের প্রতিবাদ। তা সেই নির্যাতনের ক্ষত মন থেকে মুছে গেলেই আমরাও সরে যাই। কেননা এটা আমাদের প্রতিদিনকার যাপিত জীবনের এজেন্ডা না। আমরা পারিবারিকভাবে সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিই, ইংরেজি, বাংলা শিক্ষা দিই, কিন্তু খুব বেশি নারী পুরুষের সম্পর্ক, পারস্পরিক আচরণ সম্পর্কে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ্যবোদ করি না। যে কারণে পরিবার থেকেই এই বিষয়ে কোনও ধরনের মতাদর্শিক পাটাতন তৈরি না হয়েও আমরা বড় হই। 'শান্ত-দুষ্ট' খেতাব নিয়ে বড় হয় ছেলে মেয়েরা আর এই 'একদা খেতাব পাওয়া 'দুষ্ট' ছেলেটিই কখন যে ধীরে ধীরে ধর্ষক হয়ে ওঠছে বাবা মা জানতে পারেন না কিংবা বুঝলেও বয়সের 'দুষ্টামি' হিসেবে বৈধতা দিয়ে দেন।

ছেলে সন্তানের বাবা মায়েদের দায়িত্ব বেশি। সমাজের এবং পরিবারের কাছে অতি কাঙ্ক্ষিতভাবে জন্ম নেওয়া আপনার ছেলে সন্তানটি কোনও নারীকে আক্রান্ত করছে কিনা সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে আপনাদেরই। তাই ছোটবেলা থেকেই তাকে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ, নারীকে নির্যাতন বিষয়ে তাকে পরিবারিকভাবে ট্রেনিং দিন। মেয়েটির নিরাপত্তার চেয়ে জরুরি দরকার ছেলেটির মনস্কতার পরিবর্তন।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের সভায় সভাপতিত্ব করা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা: স্পিকার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ