X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

সুখী সমকামী যুগল নাকি অসুখী দম্পতি?

ফারজানা হুসাইন
২২ মে ২০১৭, ১৩:৪৭আপডেট : ২২ মে ২০১৭, ১৩:৪৯

ফারজানা হুসাইন বছর পনের আগের কথা। আমাদের মহল্লার এক ছটফটে তরুণীর বিয়ে হলো খুব ঘটা করে। মেয়ে দেখার দিনে ছেলে অনুপস্থিত কিন্তু ছেলেপক্ষ ডায়মন্ডের আংটি নিয়ে এসেছিল সাথে করে, মেয়ের আঙুলের মাপ না জেনেই। ‘ঢ্যাঙা গোছের’ শ্যামলা মেয়ের হাতের চা খেয়ে দামি গাড়িতে চড়ে আসা ছেলের মা এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে নিজের হাতের বেশ চওড়া বালাগুলো তৎক্ষণাৎ খুলে মেয়েটির হাতে পরিয়ে দিতেও এক মুহূর্ত দেরি করেননি। শুকনো দু’হাতে ঢলঢলে বালাদুটো পরে মেয়েটা যখন বিকেলে পাড়ার আর সব মহিলা আর সমবয়সী মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতে আসত, আমার কেন যেন হাতে বেড়ি পরা জেলখানার কয়েদি মনে হতো ওকে। টানাপোড়েনের সংসারে বেড়ে ওঠা মেয়েটি কিন্তু খুব সুখের হাসি হাসত তখন। মাস খানেকের মধ্যেই তড়িঘড়ি করে বিয়ে হয়ে গেলো।
তারপর একদিন হঠাৎ মেয়েটা একা একাই বাবার বাড়ি ফিরলো। দুদিন যায়, পাঁচদিন যায় কিন্তু মেয়ে আর শ্বশুরবাড়ি যায় না, পাড়ার মেয়েদের আড্ডায়ও পাওয়া যায় না তাকে। স্বেচ্ছা বন্দী জীবন যেন তার। কানাকানির মাঝে হঠাৎ জানা গেলো, মেয়েটির স্বামী পুরুষাসক্ত! পাড়ার মহিলাদের চক্ষু চড়কগাছ! সে কী-রে বাবা? পুরুষ মানুষের একটু আধটু বদ অভ্যাস মেনে নেওয়াই যায় কিন্তু তাই বলে অন্য পুরুষে আসক্তি?
একটু একটু করে পুরো গল্প বেরিয়ে এলো এবার। বিয়ের পর থেকেই স্বামী সবসময় উদাসীন থাকে, মেয়েটির প্রতি কোনও অনুভূতি যেন নেই তার। কথা বলে না, মার-ধোর করে না, কিন্তু পারতপক্ষে মেয়েটির কাছেও ঘেষে না। অনুনয়-বিনয়- কান্নাকাটির পর ছেলেটি নিজেই জানিয়ে দিয়েছিল, সে সমকামী, পরিবারের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করেছে। কিন্তু মেয়েটিকে ভালোবাসা কিংবা স্বাভাবিক দাম্পত্য তার পক্ষে সম্ভব নয়। ছেলের সমকামিতার কথা জানতে পেরেই ছেলের বাড়ি থেকে অস্বচ্ছল পরিবারের মেয়েটিকে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে সোনা-গহনায় মুড়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

মেয়েটি চাইলে সব কিছু গোপন করে শ্বশুরবাড়ির আরাম-আয়েশে চিরকাল থাকতে পারে, অথবা স্বামীর ঘর করতে না পারার অপমান মাথায় নিয়ে বাপের বাড়ি চলেও যেতে পারে। আঠারো বছরের সদ্য তরুণীর কাছে ভালোবাসা সবচেয়ে দামি মনে হয়েছিল, তাই চলে এসেছে বাপের বাড়ি। কিন্তু বাবা-মা মুখ কালো করে বলে দিল, বিয়ের পর স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঠিকানা। ওই এক সমকামিতার দোষ ছাড়া এমন হীরের টুকরো ছেলে আর কোথায় পাবে? অগত্যা দিন পনেরো পর সেই দামি সোনার হাতবেড়ি পরে মেয়েটা আবারও বাপের বাড়ির পাট তুলল।
সম্প্রতি সমকামী সন্দেহে কেরানীগঞ্জে সাতাশজনকে র‌্যাব আটক করেছে- সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরে বহু বছর আগের সেই ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ‘বিবেক-বিবর্জিত’, ‘ধর্মভ্রষ্ঠ’  ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের কোনও সহানুভূতি জাগে না কখনও। এই মানুষগুলোর বাকি সকল পরিচয় ছাপিয়ে সমাজের চোখে এদের একটাই পরিচয় এরা সমপ্রেমের অপরাধে অপরাধী। সমকামী বা সমপ্রেমীদের নিয়ে লেখালেখি করি বলে অনেকেই বেশ টিপ্পনি কাটে, বাজে কথা শুনতে হয় আমাকে প্রায়ই। বহু বছর বিলেতে বসবাস করার কারণে সমকামী মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে, কাজ করেছি একসাথে, বেশ গভীরভাবে জেনেছে তাদেরকে। বিশ্বাস করুন এই মানুষগুলো আপনার আমার মতো; সুখে হাসে, দুঃখ পেলে কাঁদে, প্রিয়জন হারিয়ে হৃদয় ভাঙে ওদেরও।
প্রিয় সন্তানটি সমকামী জানার পর পরিবার তাকে যখন ছুড়ে ফেলে দেয়, বাবা-মা-পরিবার হারিয়ে মানুষগুলোর কী যে করুণ দশা হয় তা আমি নিজ চোখে দেখেছি। না পারে পরিবার ছাড়তে, না পারে নিজেকে বদলাতে- এমন অবস্থায় ‘আমি এমন কেন?’- নিজেকে দোষারোপ করতে করতে ভয়ঙ্কর ডিপ্রেশন, সেল্ফ হামরিং এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করতে দেখেছি আমি।
বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, শুধুমাত্র আর দশজনের চেয়ে ভিন্ন হওয়ার অপরাধে বাবা-মা কেমন করে সন্তানকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে? প্রশ্ন করেছি, সমকামিতা নামের ‘মানসিক বৈকল্য’ দূর করতে আমরা বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে জোর করে তাদের বিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত এই সমকামী আর ওই বিষমকামী মানুষগুলোর জীবন বিষিয়ে তুলেছি- তা কি কোনও অপরাধ নয়?
সমকামী আচরণকে স্বীকার করা মানে সমাজ রসাতলে চলে যাওয়া নয়, অজাচার আর অনাচারকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়। সমকামিতা প্রকৃতি-সিদ্ধ স্বীকার করলে আমরা একজন মানুষকে স্বীকার করে নেই, তার ভালোবাসার অধিকারকে স্বীকার করে নেই, সেক্সচুয়ালিটিকে স্বীকার করে সেই মানুষটিকে একটি সুস্থ-স্বাভাবিক-নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দেই।
আমরা গায়ের জোরে অস্বীকার করতেই পারি সমকামিতাকে, আইন করে এর গায়ে লাগিয়ে দিতে পারি ঘৃণ্য অপরাধের তকমা। কিন্তু এই অস্বীকারের ফলাফল কি আদৌ কোনও সুফল বয়ে আনবে? শুরুর গল্পের মেয়েটির মতো অন্য কোনও মেয়ে, অন্য কোনও ছেলে সমাজের চোখে ঠুলি পরিয়ে অসুখী দাম্পত্য জীবন কাটাবে।

আজ আপনি জোর গলায় আইন করে কোমরে দড়ি বেঁধে ওদের জেলে পুরছেন, ডাক্তার-কবিরাজ ডেকে সমকামিতা নামক অসুখের নিরাময় করছেন। সমকামিতাকে অস্বীকার করা মানে প্রকৃতি থেকে, সমাজ থেকে সমকামী মানুষ বা প্রাণিকে নির্মূল করে ফেলা নয় একেবারেই। সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয়, বরং ভীষণরকম স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করার অর্থ হলো আমাদের মাঝেই অস্বাভাবিক সম্পর্কের সৃষ্টি করা।

বিজ্ঞান বলে, একটি দেশ বা সংস্কৃতিতে প্রায় ১% থেকে ৫%  সমকামী মানুষ থাকতে পারে। সমকামিতাকে যখন আমি-আপনি অস্বীকার করবো, তখন এই সমকামী মানুষগুলো কোথায় যাবে? সমাজের ১% থেকে ৫% সমকামী মানুষগুলো তখন মুখরক্ষার জন্য সম শতাংশ বিষমকামী মানুষের সাথে বৈবাহিক বা যুগল সম্পর্কে জড়াবে। কিন্তু জোর-জবরদস্তিতে এই সম্পর্ক সমাজের চোখে টিকে গেলেও আদতে আমরা সর্বোচ্চ প্রায় ১০% মানুষকে অসুখী দাম্পত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
নিদারুণ যন্ত্রণায় কাটানো ভালোবাসাহীন এক অসুখী দম্পতির চেয়ে কী দুটো আলাদা সুখী যুগল আপনার-আমার সবার কাম্য নয়? হোক না তারা বিষমকামী কিংবা সমকামী? কী এসে যায় তাতে?
লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী।
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জরিমানার ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বন্ড জোগাড় করতে পারেননি ট্রাম্প
নিউইয়র্ক জালিয়াতি মামলাজরিমানার ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বন্ড জোগাড় করতে পারেননি ট্রাম্প
বাড়তি ভাড়া নিলে সেই গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে
পরিবহন মালিক সমিতির হুঁশিয়ারিবাড়তি ভাড়া নিলে সেই গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে
দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত
দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত
দেশে দেশে রমজানের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও রকমারি উৎসব
দেশে দেশে রমজানের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও রকমারি উৎসব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ