X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমি আমার মায়ের কথা বলছি

আবদুল মান্নান
২৩ মে ২০১৭, ১৩:১২আপডেট : ২৩ মে ২০১৭, ১৩:২৫

আবদুল মান্নান মায়ের কাছে তাঁর বয়স কত জানতে চাইলে তিনি একটু চিন্তা করে বলেন- ষাট বা সত্তর হতে পারে। আমার ছোট ভাই নানা রকম গবেষণা করে বের করেছে মায়ের বয়স কমপক্ষে ৯৫। বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়া আল্লাহ‘র রহমতে মা ভালো আছেন। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিদের নাম বলতে পারেন। মায়ের বয়স যখন আশি, তখন তাঁকে হজে নিয়ে গিয়েছিলাম। কেউ বিশ্বাস করেননি আমার মা হজ করতে পারবেন। তিনি হজের সব করণীয় কোনোরকম সমস্যা ছাড়া শেষ করেছেন। সকলের মায়ের মতো আমার মাও জগতের শ্রেষ্ঠ মা। বাবাতো ছিলেনই। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য দু’জনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন; যদিও তাদের কেউই স্কুলের গণ্ডি পার হননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করলে আমার বাবা এক কাপড়ে রেঙ্গুন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ বার্মিজরা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের কখনও ভালো চোখে দেখত না। দেশে ফেরার পর ছোটখাট ব্যবসা শুরু করে বাবা বিয়ে করেন। আমাদের পরিবারকে সব সময় আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত বলে মনে করি। বাঙালিদের মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যা তখন হাতে গোনা। সংসারে অনেক টানাপোড়েন সত্ত্বেও বাবা আমাদের পড়ালেখাকে সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। শহরের সেরা স্কুলের একটিতে ১৯৫৩ সালে ভর্তি হয়েছিলাম। সে সময় ওই স্কুলের বেতন ছিল মাসে বাইশ টাকা। ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির বাংলার শিক্ষক ছাড়া সব শিক্ষকই ছিলেন বিদেশি। কারণ স্কুলটি মিশনারি ছিল। একটি বনেদি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলেও কখনও স্কুলে আমাদের সাহেব বানানোর চেষ্টা করা হয়নি। যেমন আজকালের নব্য ধনীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে করা হয়। স্কুলে গানের মাস্টার ছিল। ভালো স্কাউট আর ব্যান্ডদল ছিল। বড় দুটি মাঠে নিয়মিত খেলা হতো। বিকেলে স্কুল হতে ফিরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মাঠে খেলার আসর। মা বলে দিয়েছেন সূর্য ডোবার আগেই ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে নামাজ পড়তে হবে, তারপর স্কুলের পড়া নিয়ে বসতে হবে। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটা সম্ভব ছিল না। সে দিন রাত পৌনে একটায় হাতিরঝিল হয়ে একটি টিভি অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। ঝিলের এক জায়গায় দেখি দু’জন ছেলে আর একজন মেয়ে ওই মাঝ রাতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমার মা দেখলে নিশ্চয় মূর্ছা যেতেন। কেউ এমন ঘটনার সমালোচনা করলে অনেকে বলবেন রাত বিরাতে মেয়েরা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবে তাতে আপনার কী? বাংলাদেশে এখন স্বঘোষিত পরিবেশবাদী আর নারীবাদীরা বেশ সক্রিয়। নারীবাদীরা অনেকেই জানেন না যে বিশ্বের সব চাইতে উদার দেশ বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে রাত্রিকালিন কারফিউ বলে একটি আইন চালু আছে। শহর ভেদে এই আইনের অধীনে ১৬ হতে ১৮ বছরের নিচে কোনও তরুণ বা তরুণী নির্ধারিত সময়ের পর অভিভাবক ছাড়া রাস্তায় একলা চলতে পারে না।

আমার মায়ের শখের অর্ধডজন দুধেলা গরু ছিল। সেই গরুর দুধের বেশ কদর কারণ মা’র চিন্তায় কখনও আসেনি দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করা যায়। অন্যরা এক টাকায় দেড় সের দুধ বিক্রি করলেও আমার মায়ের কাছ হতে সেই দুধ পাড়ার লোকজন টাকায় পাঁচ পোয়া করে কিনত। দু’এক বাড়িতে আমি নিজে কখনও কখনও দুধ পৌঁছে দিতাম। মুরগি ছিল কয়েকটি। পাড়ার কেউ কেউ এক টাকায় বারো হতে পনেরটা ডিম নিয়ে যেত। আমাদের জন্যও বরাদ্দ থাকতো। হঠাৎ করে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যু হলে আমাদের পরিবারটি আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। আমি চারশত পঞ্চাশ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক পদে চাকরি করছি। আমার ওই যৎসামান্য আয় আর মায়ের দুধ ডিম বিক্রির আয় দিয়ে সংসারের সব কাজ আগের মতো চালু রাখতে মা সব সময় তৎপর ছিলেন। শুধু একটা ডিমকে ওমলেট করে মা চার ভাইকে ভাগ করে দিতেন। মাঝে মধ্যে মাছ মাংস রান্না হতো। ছোট তিন ভাইয়ের মধ্যে দু’ভাই স্কুলে পড়াশোনা করছে। এক ভাই কলেজে সদ্য ভর্তি হয়েছে। বাবা যে’দিন মারা যান সবচেয়ে ছোট ভাইটার সেদিন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা ছিল। তাকে পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছি। না ফেরা পর্যন্ত বাবার জানাজার জন্য অপেক্ষা করেছি। তার বড়টা ক্যাডেট কলেজে পড়ে। আগের দিন কলেজ অধ্যক্ষকে বলে কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি এসেছে। বাবার জানাজা শেষে ফিরে যাবে। সে ভাই যখন সেনা বাহিনীতে কমিশন্ড প্রাপ্ত হলো তখন আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে সে দেশে অবস্থান করছি। ছোট ভাই মিলিটারি একাডেমিতে যেতে একগাদা কাপড় চোপড় বানাতে হবে। মা নিজের হাতের বালা বিক্রি করে সেই ব্যবস্থা করলেন। সে ভাই গত বছর সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ পর্যায়ের অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আর সবার ছোটটি সরকারি কলেজের অর্থনীতির একজন অধ্যাপক। তাদের বড়টি ব্যবসা করে আর সে আর তার স্ত্রী সার্বক্ষণিক মায়ের দেখাশোনা করে। আমার একজন বন্ধুর মায়ের কথা বলি। অসম্ভব ভালো মানুষ ছিলেন। বন্ধুর বাবা একজন সৎ সরকারি অফিসার হিসেবে অবসর নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নয় ছেলে মেয়ে। সকলে উচ্চশিক্ষিত। তাদের একজন সরকারের বড় কর্মকর্তা হয়েছিল। মাকে ঢাকা রেখে ছোটটা ছাড়া সকলে বিদেশে। ছোটটা বিয়ে করলো। বউ বিয়ের পর সাফ জানিয়ে দিল তার পক্ষে ‘বুড়ি’র সাথে এক বাসায় থাকা সম্ভব নয়। কাছেই তারা পৃথক বাসা নিল। ঢাকার একটা হাসপাতালে সেই মায়ের মৃত্যু হয়। পাশে তখন নয় ছেলে মেয়ের কেউ ছিল না।

দুর্ভাগ্য আজকালের সব মা আমার মায়ের মতো হতে পারেন না বা হতে চান না। বিশেষ করে শহুরে মায়েদের তা হওয়াও সম্ভব না বাস্তব কারণেই। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা উভয়ে চাকরি করেন। ছেলে মেয়েদের সাথে সময় কাটানোর সময় তাদের নেই। রাত বিরাতে সন্তান পার্টিতে যাবে তাতে তাদের তেমন কোনও আপত্তি নেই। ক’দিন পর রমজান মাস শুরু হবে। দেখা যাবে এই ঢাকা শহরে ভোর রাতে সেহরি পার্টি হচ্ছে বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরায়। সেখানে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ের উপস্থিতি চোখে পরার মতো। অনেকেই আসবে মা বাবার অনুমতি নিয়ে। ফ্রেন্ডের পার্টি বলে কথা। বাঙালির হাতে এখন কাঁচা পয়সা। বেশিরভাগই অবৈধ পথের আয়। চোরাকারবারি, টাউট, বাটপার, হুন্ডির কারবারি, সোনা চোরাচালানি, ভূমি দস্যু, বিদ্যা ব্যবসায়ী সকলের কাছে এখন অঢেল টাকা। কথায় বলে টাকা থাকলে কুত্তা (কুকুর) কিনতে মন চায়। এরা একটু শর্দি কাশি হলে সিঙ্গাপুর ব্যাংকক দৌঁড়ায়। একজনকে জানি যার কন্যার বিয়ের কার্ড কিনতে সপরিবারে কলকাতা ছুটেছিলেন। কার্ড সকলের পছন্দ হতে হবে তো।

এই যে সমাজে এত অনাচার তার অনেকটাই কমানো সম্ভব ছিল বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে একটু সতর্ক হলে। বলছি না আমার মায়ের মতো ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য তাদের এত কষ্ট করতে হবে। এই যুগে সেটা আশা করাটাও অন্যায় হবে। তবে এই সময়ের বাবা-মায়েরাতো সন্তানদের কল্যাণে কিছু অনুশাসনতো বলবৎ করতে পারেন। রেইনট্রি হোটেলের ঘটনা নিয়ে দেশে এখন বেশ তোলপাড় চলছে। সেই ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের অপরাধ অমার্জনীয় এবং প্রত্যেকেরই এই ঘটনার জন্য প্রযোজ্য সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া উচিৎ। তবে তাদের অভিভাবকরাও এই সাজার বাইরে থাকা উচিৎ নয়। কেমন বাবা যে তার ছেলেকে দিনে হাত খরচ হিসেবে দুই লাখ টাকা দেয়? একজনের জন্য একজন সশস্ত্র বডিগার্ডও আছে। আমি গত দু’বছর ধরে সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি। রেওয়াজ ছিল আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য একজন গানম্যান দেওয়ার। সেই গানম্যান আমার পাওয়া উচিৎ এই কথাটা এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্বরত কাউকে আমার দফতর বুঝাতে পারেনি, আমিও না। তাদের ধারণা রাস্তাঘাটে কত মানুষই তো সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা পড়ছে। তার সাথে আর একটি নাম যোগ হতে অসুবিধা কোথায়! রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার সাথে যে মেয়েগুলো জড়িত ছিল তাদের দু’জনেরই বাবা-মা আছেন। তারা তাদের সন্তানদের কেমন শিক্ষা দিলেন যে রাত বিরাতে বন্ধুদের জন্মদিনের পার্টিতে হাজির থাকতে হবে। আমি এই সব ব্যাপারে একটু সেকেলে। অনেকে আমাকে আমার মন্তব্যের জন্য মুণ্ডুপাত করবেন। কিন্তু যখন ছেলেমেয়ে মানুষ করার প্রশ্ন আসে আমার চিন্তা ধারা আমার মায়ের চিন্তা ধারায় এসে ঠেকে। রেইনট্রির দুর্ঘটনার শিকার দু’জন মেয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ব্যতিক্রমী কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলে বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্মার্ট হওয়ার কিছু অলিখিত ফর্মুলা জারি করেছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোও পিছিয়ে নেই। বাংলার ক্লাসের বাইরে বাংলা বললে বহিষ্কার নিশ্চিত। এতে নাকি ইংরেজি ভালো শেখা যায়। ইংরেজি শেখার এমন সহজ পদ্ধতি আগে জানা ছিল না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ব্যতিক্রম ছাড়া) ছাত্রছাত্রীদের স্মার্ট হতে হলে রাত বিরাতে পার্টি করতে হবে। মাদক সেবন স্মার্টনেসকে একটু এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। কথায় কথায় বলতে হবে - I hate politics. এই সব সমস্যা যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই তা কিন্তু নয় তবে তার সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম।

সব বাবা-মায়েদের কাছে একটা আবেদন, বাস্তব কারণেই আপনারা অর্ধ শতাব্দী বা তারও বেশি আগের বাবা মায়েদের মতো হয়তো হতে পারবেন না, সমাজও হতে দেবে না। তারা সেকেলে ছিলেন কারণ কালটাও সেকাল ছিল। সেকালের অনেক কিছুই এখন অচল। কিন্তু নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতি একটু নজর রাখলে সমাজের অনেক সমস্যার জন্মই হতো না। তা যদি করতে পারেন তাতে আপনাদেরই লাভ। তা না হলে আপনাদের সন্তানরা কোনও ঘটনা দুর্ঘটনার জন্ম দিলে তখন মানুষ বলতে পারবে বাপতো সোনার চোরাকারবারি সন্তান কিভাবে ভালো হবে? সকলে ভালো থাকবেন। আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন যেন তাঁর কথা সব সময় বলে যেতে পারি । 

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ