X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো …

চিররঞ্জন সরকার
২৬ মে ২০১৭, ১২:৩২আপডেট : ২৬ মে ২০১৭, ১২:৩৪

চিররঞ্জন সরকার শীতকালে আমরা একটু গরমের জন্য কতো না হা-হুতাশ করি। আর গরমে ঠিক উল্টো। একটু ঠাণ্ডার জন্য সবার মধ্যে হাহাকার। ঠিক যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কিছু লোক বিএনপির জন্য হা-হুতাশ করেন। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেন!


গরমের ব্যাপারটা অবশ্য একটু ভিন্ন। গরম চা, গরম কফি, হটকেক, হটডগ এবং শীতকালে গরম ভাত, গরম পানি, গরম গরম ইলিশ ভাজা, গরম কাপড়—হাতে গোনা এমন কয়েকটি আইটেম ছাড়া আমাদের জীবনে গরমের বড় বেশি কদর নেই। বর্তমানে আমরা প্রাকৃতিক গরমে ভীষণ রকম নাজেহাল। না, রাজনৈতিক উত্তাপ নয়, দেশ আপাতত খরায় পুড়ছে। দেশজুড়ে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই খরতাপ মানুষসহ প্রাণীকুলের জন্য এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এই আবহাওয়ায় গরমও চরম গরম হয়ে উঠেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আকাশে নেই কোনও মেঘের বলয়। এতে সূর্যের তাপ বায়ুমণ্ডলে কোনও বাধা না পেয়ে সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠে চলে আসায় বেড়ে যাচ্ছে গরমের তীব্রতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে জলীয় বাষ্প যত বেশি থাকবে, তত বেশি পরিমাণে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হবে। গরমকালে বঙ্গোপসাগরের ওপরে তৈরি হওয়া উচ্চচাপ বলয় থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে জলীয় বাষ্প প্রবেশ করে। সেই জলীয় বাষ্পের প্রভাবেই গ্রীষ্মে কালবৈশাখি বা ঝড়-বৃষ্টি হয়। কিন্তু চলতি বছরে সেই উচ্চ চাপগুলো বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের মতো এতই দুর্বল যে ঝড়-বৃষ্টি ঘটাতে পারছে না। উচ্চ চাপের দুর্বলতার সুযোগে শুষ্ক-গরম হাওয়া ঢুকে পড়ছে। ফলে দেশজুড়ে শুষ্ক গরম অনুভূত হচ্ছে। সবাই চাতকের মতো বৃষ্টির আশা করছে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই।
তীব্র গরমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। প্রচণ্ড গরমে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা যাচ্ছে। খাল-বিল-নদী-নালা শুকিয়ে গেছে। কুয়া কিংবা নলকূপের পানিও তলানিতে চলে গেছে। যারা সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার সরবরাহ করা পানি পান করেন, তাদের বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছেন না। এছাড়া খোলা ও বাসি খাবারের কারণেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেশের সাধারণ মানুষের এ এক নিদানহীন নিদারুণ অবস্থা। চিকিত্সকেরা অবাস্তব সব পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, সবারই এ সময় গরম পরিহার করা উচিত। যথাসম্ভব ছায়াময় স্থানে থাকা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের কয়জন মানুষের ছায়ায় বসে কাজ করার সুযোগ আছে? বাঁচার জন্য মানুষকে খেতে হয়। আর খাওয়ার জন্য তাকে কাজ করতেই হয়। কাজ না করলে মানুষ খাবে কী? আর কাজ করতে গেলে রোদ বা গরম পরিহার করবে কিভাবে? চিকিত্সকেরা আরও বলছেন, মাঠে যারা কাজ করেন কিংবা শ্রমিকদের দেহ থেকে এ সময় ঘামের সঙ্গে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। এর অভাব পূরণ করতে প্রচুর নিরাপদ পানি পান করতে হবে। পানিতে একটু লবণ মেশাতে হবে।
দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে লবণ কিংবা চিনি হয়তো সংগ্রহ সম্ভব, কিন্তু নিরাপদ পানি সে কোথায় পাবে? বিশুদ্ধ খাবার পানি আমরা কোথায় পাব? দেশে বর্তমানে শ্যাওলা-ময়লা-দুর্গন্ধ-জীবাণু-পোকা-মাকড় ছাড়া পানি সৎ মানুষের মতোই দুর্লভ! চিকিৎসকেরা এ সময় ফুটপাতের খাবার না খাওয়ারও পরামর্শ দিচ্ছেন। শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এই উপদেশ মানাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ শ্রমজীবীদের বেশিরভাগেরই ভরসা ওই ফুটপাতের দোকানের খাবার। তাদের পক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিচ্ছন্ন হোটেলের খাবার খাওয়ার সামর্থ্য নেই। সেই সময়ও নেই। স্বল্প মূল্যে হাতের কাছে তারা যা পায়, তাই খায়। এটা তাদের অভ্যাসও বটে। আর অভ্যাস তো আর এত সহজে পালটানো যায় না! এই গরমে কোনও কিছুই সস্তা বা সুলভ নয়। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাসায় এসে একটু লেবুর সরবত পান করে প্রাণ জুড়াবেন? লেবু পাবেন না। বাজারে লেবুর নামে যা ২৫ থেকে ৪০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে, তাতে এক ফোঁটা রস নেই। চিপতে চিপতে আঙুলে ফোসকা পড়ে যাবে, কিন্তু রস বেরুবে না। এই গরমে শখ করে একটু গ্রীষ্মকালীন ফল তরমুজ খাবেন? না, পারবেন না। একটা তরমুজের দাম জোগাতে আপনাকে প্রায় ভিটে-মাটি বন্ধক দিতে হবে। তারপরও বিশ্বাস নেই। তরমুজের ভেতর কী বিষ আছে কে জানে!
বেশি তাপে যে কোনও কঠিন পদার্থই নাকি প্রসারিত হয়। আকার-আকৃতির পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দেশে যা তাপ তাতে অন্যসব কঠিন পদার্থ তো বটেই, মানুষের মগজও কেমন যেন ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। মাথার গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, জঙ্গি আস্তানার সন্ধান, সবই বেড়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে, মানুষজন তুচ্ছ কারণে খেঁকিয়ে উঠছেন। কাউকে ভাই বললেও প্রত্ত্যুত্তরে শালা সম্বোধন শুনতে হচ্ছে। কুশল জিজ্ঞেস করলে এমন সব জবাব শোনা যাচ্ছে, যেন আপনি তার সম্পত্তি লিখে নেওয়ার প্রস্তাব করছেন! সবার মধ্যে তাপ, চাপ, মেজাজ। বস তার কলিগদের সহ্য করতে পারছেন না। অকারণে গালাগাল করছেন। গণপরিবহনে যাত্রীর সঙ্গে যাত্রীর, যাত্রীর সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের কথা কাটাকাটি মারামারি-ঝগড়া বেড়ে গেছে। পরিবারগুলোতেও আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের মতো আত্মঘাতী সংঘাত বেড়ে গেছে। গরমে অতিষ্ঠ গিন্নিরাও টি-টুয়েন্টির ব্যাটসম্যানদের মতো মারমুখী হয়ে উঠেছেন। পান থেকে চুন খসলেই পুরুষ সদস্যরা যেমন খেঁকিয়ে উঠছেন, নারীরাও পাল্টা আঘাত হানছেন। এতে করে ঘরে ঘরে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে। সবাই এখন সব কিছুর দায় চাপাচ্ছেন গরমের ওপর।
সেদিন এক দোকানদার এবং ক্রেতার মধ্যে বাদানুবাদের দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে শুনলাম, ক্রেতা ক্রুদ্ধ হয়ে বলছেন, আমি এক ডজন লেবু কিনে নিয়ে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি তুমি ১০টা লেবু দিছো। এই জোচ্চুরির মানে কী? তুমি কী মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি, যে এক ডজন লেবুতে ২টা কম দিবা? লেবু বিক্রেতা কাচুমাচু হয়ে বলছেন, স্যার, যা গরম পড়ছে, তাতে মাথামুথা ঠিক নাই, বারোডার জায়গায় দশটা দিয়া দিছি। ক্রেতা ভদ্রলোক রাগত কণ্ঠেই বললেন, কিন্তু বারোটার জায়গায় তের কিংবা চৌদ্দটা তো দিলা না! এবার দোকানি ভদ্রলোক বেশ একটা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, স্যার, গরম পড়ছে ঠিকই, কিন্তু অত গরম কী আর পড়ছে যে বারোটার জায়গায় চৌদ্দটা দিমু! লেবু বিক্রেতার কথা শুনে তো আমার আক্কেলগুড়ুম! গরমের প্রভাবে অনেকেরই মাথা ঠিকঠাক মতো কাজ করছে না। আমাদের গোয়েন্দাদেরও করছে না! সর্বশেষ ‘গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে’ বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে তল্লাসী চালানো হলো। কিন্তু তারা ঘোড়ার আণ্ডাও পেল না। তাহলে কেন একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে পুলিশি অভিযান চালানো হলো? হয়তো সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলবেন, যা গরম পড়েছে, মাথা কী ঠিক আছে?
পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই আবহাওয়া দফতরকে! আবহাওয়া বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা ঠাণ্ডা ঘরে বসে, অন্তত সত্য কথাটা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, আপাতত গরম কমার কোনও সম্ভাবনা নেই! গরম কমবে কিভাবে? মৌসুমী বায়ু তো আর কারও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী চলে না। উৎপন্নও হয় না। পুকুর নেই, ডোবা নেই, আছে শুধু মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং, শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স, ফুললি এয়ার কন্ডিশানড ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ভেড়ার পালের মতো বাড়ছে মানুষ, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি, বাড়ছে এ-সি, বাড়ছে জেনারেটার, বাড়ছে রেফ্রিজারেটার। বিদুৎ উত্পাদন সীমিত কিন্তু চাহিদা প্রচুর। বিদুৎ নেই? জেনারেটার চালাও। আরে বাবা সেও তো চলবে ডিজেলে। এদিকে পেট্রোলে, ডিজেলে ভর্তুকি দিতে দিতে সরকার ফতুর। সুখে থাকতে মানুষকে ভূতে কিলায়। মানুষ বোঝে না এঁড়ে গরু টেনে দুধ দোয়ানো যায় না। এরা ভুলে যায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেয়। পৃথিবীতে সম্পদ সীমিত। গাছ কাটো, পুকুর বোজাও, নদী ভরাট কর, ফ্ল্যাট তোলো, এসি বসাও, জেনারেটার চালাও, ঘরে বসে বসে টিভিতে আইপিএল-এর খেলা দেখো, বাহুবলি দেখো, দীপিকা পাড়ুকুনের নাচ দেখো, আর হাইব্রিড চিকেন ফ্রাই কিংবা চিপস্ চিবোও, নয়তো ঠাণ্ডা পানীয় গেলো। কিন্তু দুনিয়াটা তো আর মামাবাড়ির আবদার নয়! তাই তো মা-বসুধা (mother earth) ক্ষেপে ব্যোম্ আমাদের ওপর। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বিরূপ হয়েছে, ভাগ্যদেবতা ওপরে বসে বসে হাসছেন। বুদ্ধিজীবীরা বলেন না— গ্লোবাল ওয়ারমিং-এর কথা। গ্রিনহাউজ গ্যাসের কথা। এগুলোর সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য নিহিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই তাপমাত্রা কমবে না। সময়ের বৃষ্টি সময়ে হবে না।
তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? আপাতত করণীয় একটাই, আমরা সমবেত কণ্ঠে সৈয়দ আব্দুল হাদীর গাওয়া সেই হারিয়ে যাওয়া গানটি আবার গাইতে পারি: ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো আর কতদিন বল সইবো….!’
লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
চীনে ৯ বছরে প্রথমবারের মতো বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে
চীনে ৯ বছরে প্রথমবারের মতো বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ