X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের ডাক্তার

রুমীন ফারহানা
২৭ মে ২০১৭, ১১:৫৯আপডেট : ২৭ মে ২০১৭, ১৩:২৯

রুমীন ফারহানা কিছুদিন আগেই ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হলো এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। মামলাও দায়ের হলো স্বনামধন্য কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। রোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে মামলা করলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা, লেখালেখি হলো বিস্তর। এ ফাঁকে বলে রাখি রোগীর মৃত্যুতে হাসপাতাল ভাঙা কিংবা ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া কিন্তু নতুন কিছু নয়। এ ধরনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ হলো জীবনের একটি লম্বা সময় শয্যাশায়ী রোগী নিয়ে একা চলতে হয়েছে আমাকে। একা বলতে একদম একা, শুধু কিছু বেতনভুক্ত সাহায্যকারী ছাড়া।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হাসপাতালে রোগী নিয়ে একা কাটিয়েছি আমি। হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে খুবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। দীর্ঘদিন একসাথে কাটানোর ফলে অনেকটা যেন আত্মীয়ের মতই তারা। হয়তো বা আত্মীয়ের চেয়ে বেশি, কারণ বিপদে আত্মীয় পাশে পাওয়ার মতো সৌভাগ্য আমার খুব বেশি হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি চিকিৎসার স্বার্থে কখনও বিদেশ যাইনি আমি, তাই তুলনামূলক বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখে ছুটি কাটায় সব শ্রেণি পেশার মানুষ। শুধু বন্ধ থাকে না হাসপাতালের ICU, ওয়ার্ড কিংবা কেবিন গুলো। রাত দুটা বা তিনটায় বুকে কাঁপুনি ধরানো ফোন বাজে কেবল ডাক্তারের। আমি নিজেই কয়েকবার বাধ্য হয়েছি এই উদ্ভট, অসভ্য সময় ফোন করতে। ভীষণ অস্বস্তি, দ্বিধা আর লজ্জা মুহূর্তে দূর হয়ে গেছে যখন রাত আড়াইটায় ডাক্তার নিজে এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে ICU তে বলে রেখে ভর্তি করে নিয়েছিলেন রোগীকে। না, আমার কোনও আত্মীয়ের ঘুম ভাঙানোর সাহস হয়নি আমার, ফোন করেছিলাম শমরিতা হাসপাতালের ড. মোসলেউদ্দিনকে। ওনার নামটি বললাম কারণ দুপুর দুটা বা রাত তিনটা কখনোই ফোন বন্ধ পাইনি ওনার। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন আরও অনেকে, নাম লিখতে বসলে তালিকা শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হবে। অনেকে বলবেন এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব যে কতটা ভারি এবং পালন করা কতটা কঠিন তা কাছে থেকে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। ডাক্তার তার পরিবারের যতটা নয় তার চেয়ে অনেক বেশি তার রোগীদের। পরিবারের কোনও উৎসব, জন্মদিন কিংবা বিয়েতে সবচেয়ে দেরিতে, সবচেয়ে ক্লান্ত শরীরে যে মানুষটি উপস্থিত হন তিনি হলেন ডাক্তার।

কিন্তু তাই বলে কি ভুল হয় না ডাক্তারদের? নিশ্চয় হয়, মানুষতো, ফেরেশতা তো আর নয়। আমার রোগীর ক্ষেত্রেও ভুল হয়েছে কয়েকবার। যার জন্য মূল্যও চুকাতে হয়েছে আমাকে, এমনকি এখনও হচ্ছে। কিন্তু সে ভুল তো ভুলই, পূর্ণ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মানুষ ভুল করে, ভুল হয়ে যায়। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সেই ভুল ত্রুটি প্রমাণ করবে কে? এর বিচারের ভার কাদের ওপর ন্যস্ত? একজন ডাক্তারের চিকিৎসা ভুল ছিল নাকি সঠিক তা একমাত্র নির্ধারণের যোগ্যতা রাখে আর একটি neutral board of competent doctors. বিলেতের আইন বলে ভুল বা অসাবধানতার (negligence) মাপকাঠি হলো রোগীর ওই শারীরিক অবস্থায়, রোগের বর্ণনায়, টেস্টের রিপোর্ট দেখে অন্য একটি competent board of doctors কি চিকিৎসা দিত। তারাই একমাত্র এখতিয়ার রাখেন ডাক্তারের ভুল বা শুদ্ধতার বিচারের। গুগল দেখে আজকাল আমরা সবাই সব জানি বলে মনে করি। এ এক বিপদজনক অবস্থা।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হাসপাতালে কাটিয়ে বুঝেছি চিকিৎসা শুধু ডাক্তারের হাতে নেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট কতটা সঠিক আসে তার ওপরও চিকিৎসা অনেক খানি নির্ভর করে। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলো খরচ কমানোর জন্য ট্রেইন্ড নার্সের বদলে স্বল্প প্রশিক্ষিত, অদক্ষ নার্স নিয়োগ দেয়। ভুল তাদেরও হয়, মাশুল দেয় রোগী, তার স্বজন আর ক্ষেত্রবিশেষে ডাক্তাররা।

কিছুদিন আগে পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছিল মেডিক্যাল শিক্ষায় জোড়াতালি। মূল সমস্যা শিক্ষক সংকট। সব মিলিয়ে ১০৫ টি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক সংখ্যা ৯৪০৩, দরকার অন্তত ২৫ হাজার ৩০০ অর্থাৎ ৬৩% শিক্ষক কম। স্বাধীনতার পর ২০ বছর মেডিক্যাল কলেজ ছিল ৯ টি এখন হয়েছে ৪৭টি। অথচ অধিকাংশ কলেজে ভৌত অবকাঠামো ও শিক্ষার সরঞ্জাম নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা মানছে না। কোনও কোনও কলেজে পরীক্ষা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট কক্ষ নেই, কোনোটায় মিলনায়তন নেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিউটোরিয়াল আছে মাত্র একটি কলেজে। অধিকাংশ গ্রন্থাগার খুবই ছোট, বই পত্রও কম। ভালো ডাক্তার তৈরিতে নজর দেব না কিন্তু আশা করবো নির্ভুল চিকিৎসা তাতো হওয়ার নয়।

অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অসততা আমাদের ভেতর তো রয়েছেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উল্টো পথে হাঁটি আমরা। যে মামলা ৬ মাসে নিষ্পত্তি সম্ভব সেটি দুই পক্ষের উকিল, আদালত, পেশকার, বেঞ্চ অফিসার সবার চক্করে পড়ে কয়েক বছরেও শেষ হয় না। ঠিকাদার, প্রকৌশলী, রড সিমেন্ট বালুর ব্যবসায়ী মিলে নির্মাণ করি ভঙ্গুর অবকাঠামো। কোচিং, প্রশ্ন ফাঁস, নকল, খাতায় নম্বর বাড়িয়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা বাণিজ্যে ব্যস্ত এক শ্রেণির শিক্ষক। তাদের গায়ে আমরা হাত তুলি না কারণ তাদের করা ক্ষতি অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদী, চট করে চোখে পড়ে না। ডাক্তারের ক্ষেত্রে দ্রুত ধৈর্য্য হারাই আমরা, মানুষের সেন্টিমেন্টও পক্ষে পাওয়া যায় সহজেই।

আমি কখনোই অস্বীকার করি না যে ডাক্তারেরও ভুল হয়, তাদেরও কেউ কেউ ডায়াগনেস্টিক সেন্টার বা ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন নেয় তবে দিনের শেষে আমাদের সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তে তারাই আমাদের ভরসা জোগান, শেষ সময়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালান রোগীটিকে বাঁচানোর, ঈদের ছুটি বা পূজার আনন্দ ফেলে হাসপাতাল ডিউটি করতে ছুটে আসেন, অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাই বলে। ডাক্তাররা এই সমাজেরই অংশ। চারপাশের ভেঙে পড়া ব্যবস্থায় শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকে সকল সততা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব আশা করা নিতান্তই ভুল হবে। আগে দক্ষ ডাক্তার তৈরিতে মনোযোগ দেই, ডায়াগনেস্টিক সেন্টার থেকে নির্ভুল রিপোর্ট নিশ্চিত করি, দক্ষ ও পেশাদার নার্স নিয়োগে হাসপাতালগুলোকে বাধ্য করি, ওষুধের মান ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করি, সর্বোপরি নিজেরা আগে সচেতন হই তারপর না হয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে ডাক্তারের বিরুদ্ধে। 

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ