X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চেতনা নড়ে ‘বাতাসা’র বাতাসে

তুষার আবদুল্লাহ
২৭ মে ২০১৭, ১২:৪৩আপডেট : ২৭ মে ২০১৭, ১২:৫৩

তুষার আবদুল্লাহ শহরের কোনও গলিতে ল্যাম্প-পোস্টের নিচের চায়ের দোকানি হতে রাজি, কিংবা গ্রামের মিঠাই ফেরিওয়ালা। তবু বুদ্ধিজীবী হওয়ার ‘অভিশাপ’ যেন কেউ না করে, সেই মানত করে বেড়াই আসমানের কাছে। আমার ভাস্কর্যটির যিনি স্থপতি, তার কাছেও নিশ্চয়ই ‘বুদ্ধি’ পেশাদারদের চেয়ে চায়ের দোকানি বা মিঠাইওয়ালার ভাস্কর্যই নান্দনিক মনে হবে। বুদ্ধিজীবীর যে গড়ন হওয়ার কথা, তার যে মেধার আলো থাকার কথা, সেই আলোর ছটা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। এখানে অতি সুলভেই বুদ্ধিজীবী পাওয়া যায়। কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত হচ্ছে সুশীল, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী। বাজার সয়লাব কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত এসব পণ্যে। কৃত্রিম এই পণ্যে অর্গানিক বুদ্ধিজীবী, সুশীল কিংবা সংস্কৃতিকর্মীর স্বাদ মিলছে না। এক বিস্বাদ নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্রযাপন করে যাওয়া।
বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই ‘তবারক’ প্রত্যাশী। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সেই প্রমাণ রয়েছে। রাষ্ট্রের সংকটে, সমাজের বিপন্নতায় তাদের অনেকেই ‘ভাত ঘুম’-এ ছিলেন। ঘুম ভেঙে ঠিক ঠিক তারা ক্ষমতার বরাদ্দ দেওয়া জলখাবারে দিয়েছেন আয়েশের ‘কামড়’। যারা ঘুম দেননি। জেগে ছিলেন, তাদের কারও কারও ঠোঁটে শব্দ ছিল না। দুই একজনের ঠোঁট নড়লেও তা ছিল কম্পমান। ক্ষমতার ‘তবারকসেবীদে’র হৈ হল্লোরে সেই উচ্চারণ হারিয়ে গেছে। নিকট অতীতে খানিকটা সেই উচ্চারণের ধূলি কানে এসে আছড়ে পড়লেও, এখন যে সময়টা অতিক্রম করছি তখন কোনও ঠোঁটই নড়ছে না। নিশ্চুপ সবাই। দীর্ঘ ভাত ঘুমে নিমগ্ন সকলে। ভুল বললাম হয়তো। ঠোঁট নড়ছে, আওয়াজ হচ্ছে, নিমগ্নতাও আছে। সেই নিমগ্নতা তবারকের লোভে জিকিরের।
সংকটে, বিপন্নতায় সাধারণ জনগণ পিপাসার্ত হয়ে অসহায় চোখ রাখে সংস্কৃতি ও বুদ্ধির পেশাদারদের ফিউশন ‘সুশীল’দের দিকে। যদি তারা আসেন, দুটি কথা বলেন সংকটে থাকা বিপন্নতায় ডুবে যাওয়া মানুষের পক্ষে। তাদের জাগ্রত করার ‘টনিক’ দিয়ে পথচিত্র দেখান সংকট, বিপন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু তারা সাধারণ জনগণের দিকে ফিরে তাকান না। তাকিয়ে থাকেন ক্ষমতার ‘বাতাসা’র দিকে। কার ভাগ্যে চিনি আর কার ভাগ্যে জুটবে গুড়ে বাতাসা তা নিয়েই হুল্লোর, কামড়া-কামড়ি। কেউ কেউ আবার এসে দাঁড়ান বিপন্ন মানুষের কাছে। উত্তপ্ত বাক্য উপহার দেন। কিন্তু সেই বাক্যের সবই ভনিতায় ভরা। এই উত্তপ্ত বাক্য দিয়ে ক্ষমতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ক্ষমতার কাছে চড়া দামে বিক্রি হওয়ার চেষ্টা মাত্র।
আমরা যদি ‘গ্রিক দেবী’র ভাস্কর্য নিয়ে চলতি বিতর্ক দেখি, সেখানেও বাতাসা লোভি বুদ্ধিবৃত্তিক দাবিদার শ্রেণির আচরণের উদাহরণ দেখতে পাবো। গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য যখন উচ্চ আদালতের সামনে স্থাপন করা হলো, তখন তার নান্দনিকতার ত্রুটি নিয়ে কেউ কোনও আপত্তি বা খুঁত ধরেনি। শিল্পবোদ্ধা বলে যাদের আমরা জানি তারাও কোনও শব্দ করেননি। যখন হেফাজত বা ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলা হলো, তখন পাল্টা আমাদের সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী থেকে এর প্রতিবাদ উঠলো না। তারা সোচ্চার হলে হয়তো ধর্মীয় সংগঠনগুলোর গলার আওয়াজ কমে আসতো। কিন্তু তাদের নির্লিপ্ততা দেখে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আওয়াজ আরও তীব্র হতে থাকে। সেই আওয়াজ প্রশ্রয় যখন পেতে থাকে শাসক গোষ্ঠীর কাছে, তখন আচমকা ঘুম ভাঙে আমাদের সংস্কৃতির তথাকথিত সেবকদের। তারা এবার ওই ভাস্কর্যকে কদর্য এবং আবর্জনা বলে সমালোচনার ঝড় তুলতে থাকেন। এটা যে ক্ষমতার ‘বাতাসা’র বাতাসে সেটি সাধারণ মানুষ জানে। তাই তাদের এই সুশীল আচরণকে তারা পাত্তা দেয়নি। ভাস্কর্যটি কতটা নান্দনিক মান উত্তীর্ণ ছিল তারচেয়ে সাধারণের দীর্ঘশ্বাসের জায়গাটি হচ্ছে- যাদের আপত্তির কাছে নতজানু হতে হলো, প্রস্থান করতে হলো তা একটি চেতনার পরাজয়।

রাতের আঁধারে ভাস্করকে দিয়েই তার শিল্প সরিয়ে নেওয়াটাও বেদনার। এই দৃশ্য দেখেও সংস্কৃতি কর্মীরা মাঠে নেমে এলেন না। কেউ কেউ সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বিবৃতি দিয়েছে, মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তাদের পাঁচজনও যদি ভাস্কর্যটির সামনে এসে দাঁড়াতেন, তাহলে রাষ্ট্র হয়তো সাহস পেতো। বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পেতো আবারও। ইতিহাসের এটিও এক নির্মম বাস্তবতা যে, কখনও কখনও রাষ্ট্র ভুলে যায় কোথায় তার শক্তি ও বীরত্ব। রাষ্ট্রকে সেই কথা মনে করিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ কি আমরা হারালাম? তবে ওই আঁধার রাত্রী থেকে পরের দিন আঁধার নামা পর্যন্ত গুটি কয়েক মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে প্রতিবাদ করেছে। জানিয়েছে আমরা সকলে এখনও ওই পরাজয় মেনে নেইনি, তাদের লাল সালাম।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ