X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতিই পারেন বিতর্ক থামাতে

আনিস আলমগীর
৩০ মে ২০১৭, ১৬:০৮আপডেট : ৩০ মে ২০১৭, ১৬:২৬

আনিস আলমগীর আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এলাকাকে আমরা বলতে পারি আইন ও বিচার ব্যবস্থার ‘ভ্যাটিকান সিটি’। ভ্যাটিকান যেমন রোমের মধ্যে থেকেও স্বাধীন, আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এলাকাও রাজধানীর মধ্যে থেকেও স্বতন্ত্র। এখানে প্রশাসনের কোনও এখতিয়ার খাটে না। প্রধান বিচারপতিই ওই এলাকাটার ছত্রপতি।
গত ডিসেম্বরে প্রধান বিচারপতির সম্মতিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে শাড়ি পরা তলোয়ার হাতে এক নারী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। অনেকে মনে করেছিলেন এটা গ্রিক পুরাণের বিচারের দেবী থেমিস। এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে এর স্থপতি বললেন, না এটি গ্রিক দেবীর মূর্তি না। এটা বাঙালি নারীর মূর্তি। বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে, যদিও একটি শিশুও বুঝতে পারবে এটি গ্রিক দেবীর হুবহু নকল।
বুদ্ধিটা একেবারে অপরিপক্ক নয়। গ্রিক সভ্যতা যদি তাদের বিচারের প্রতীক হিসেবে একটা দেবী মূর্তির প্রচলন করতে পারে তবে আমাদের বাঙালিদের অপরাধ কী! তারা গ্রিক দেবীর মূর্তির পরিবর্তে নিজস্ব একটা মূর্তি বিচারের প্রতীক হিসেবে বসালো না হয়। ভাস্কর মৃণাল হক এটিকে দেবীর ভাস্কর্য হিসেবে না রেখে বাঙালি রুচিশীল নারীর শাড়িতে আবৃত করে দিয়েছেন। আবার হাতে একটা তলোয়ারও দিয়েছেন। বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও ধরিয়ে দিয়েছেন আরেক হাতে। আইনের একটি বই আর একটি কলম দিলে আরও ভালো হতো মনে হয়। অবশ্য তখন হাতের সংখ্যা বাড়িয়ে চতুর্ভূজা করতে হতো। এটা যখন গ্রিক দেবীর অনুকরণ নয় তখন চতুর্ভূজা হতে আর আপত্তি কি ছিল?

কিছু মোল্লা, মাওলানা আর অমোল্লাদের আপত্তিতে এখন সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটক থেকে তথাকথিত ভাস্কর্যটি এনেক্স বিল্ডিং এর সামনে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে। এটা সরানোর আগে প্রধান বিচারপতি নাকি সিনিয়র আইনজীবীদের (এমিকাস কিউরি) তার চেম্বারে ডেকেছিলেন। ডা. কামাল হোসেন প্রধান বিচারপতিকে বলেছেন আপনি আমাদের ডেকে ভালো করেছেন। জানি না তারা প্রধান বিচারপতিকে এনেক্স বিল্ডিং এর সম্মুখে এ মূর্তিটা স্থাপনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন কিনা? যদি সিনিয়র আইনজীবীরা অন্যত্র স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন তবে তারা পরিপূর্ণ শান্তি স্থাপনের বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না। আর প্রধান বিচারপতি যদি নিজ এখতিয়ার থেকে এটা করে থাকেন তবে তিনি সাপ মারার উদ্যোগ নিলেন সত্য কিন্তু সাপ মারলেন না। নিজের ইগোইজমে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলেন। মোল্লারা আর সিংহভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মূর্তি স্থাপনের জায়গা নিয়ে বিতর্ক তুলেনি তাদের বিতর্ক ছিল মূর্তি নিয়ে। আর প্রধানমন্ত্রীসহ যারা এর নান্দনিক দিক নিয়ে আপত্তি করেছেন সে আপত্তিতো টিকলোই না কারণ ভাস্কর্যটিতে কোনও পরিবর্তনতো আনা হয়নি।

গত ৪৫ বছরে তো বহু প্রধান বিচারপতি তার চেয়ারে বসেছেন কেউ তো মূর্তি স্থাপনের প্রয়োজন বোধ করেননি, এ জাতীয় ভাস্কর্য স্থাপনেরও প্রয়োজন বোধ করেননি। প্রধান বিচারপতি কেন প্রয়োজন বোধ করলেন- এটি অনেকের মনে প্রশ্ন! ভাস্কর্যটির স্থাপনকালে এটাও খেয়াল রাখা হয়নি এর কারণে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়ালে থাকা বাংলাদেশের মানচিত্রটি ঢেকে গিয়েছিল।

দায়িত্ব থাকাকালে কাজের জন্য ভারতের মুসলমান প্রধান বিচারপতি আহাম্মদীর কথা সর্বত্র শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেন সবার কাছে দেবতুল্য ছিলেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ তার নির্বাচনে কখনও পোস্টার দিতেন না। কখনও জনসভা করতেন না। পত্রিকা মারফরত লোকে জানতো যে মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলকাতার মেদেনিপুর কেন্দ্র থেকে অথবা দিল্লির দরিয়াগঞ্জ এলাকা থেকে নির্বাচন করছেন। তার প্রতীক হলো ‘চরকা’।

রফি আহমেদ খিদোয়াই ভারতে দীর্ঘদিন কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। তার পরিকল্পনা ও পরিশ্রমে ভারত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। বর্তমান সরকারও ভারতের মতো উপযুক্ত লোককে, যে ধর্মেরই হোক, যথাযথভাবে যথাস্থানে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলো, সেটি নানা কারণে এখন সমালোচিত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মন্ত্রী করলেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান। মন্ত্রী হয়ে তিনি ঘোষণা করলেন রেল দফতরের কালো বিড়াল সাফ করে ফেলবেন অথচ শপৎ নেওয়ার দুই মাসের মাথায় তার প্রাইভেট সেক্রেটারি তার বাসায় যাওয়ার পথে ৭০ লক্ষ টাকার বস্তা সহ হাতে নাতে আটকা পড়লেন। তখন রেলে বহুলোকের নিয়োগের কাজ চলছিলো।

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটা ইস্যু তৈরি হলো যে আগামীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদের সামনেও মূর্তি বসাবে। আগের নির্বাচনে বলেছিলো মসজিদে উলুধ্বনি হবে। শেখ হাসিনা যত বলুক মূর্তিটি কে বসিয়েছেন তা তিনি জানেন না। লোকে সহজে এ কথা বিশ্বাস করবে না। কারণ মানুষ বুঝবে তার সরকারের সময়েই মূর্তি বসানো হয়েছে। ইতিমধ্যে লোকে এই মূর্তি বসানো আর সরানো, পুনঃস্থাপন সব কাজে শেখ হাসিনার হাত আছে বিশ্বাস করছে।

বেশ কিছু সংগঠন মূর্তিটাকে অব্যাহতভাবে যথাস্থানে রাখার পক্ষে। তারা বলে থাকেন ভাস্কর্য নাকি স্বাধীনতার চেতনা। সরকার তা সরিয়ে রাষ্ট্রকে মৌলবাদী চরিত্র দিচ্ছে। মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করছে। বয়সের কারণে স্বাধীনতার মূল চেতনা কী ছিল সে সময় তা আমাদের হয়তো সরাসরি জানা হয়নি। তবে ইতিহাস থেকেতো এই চেতনা আমাদের অজানা নয়। ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলাদেশের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, প্রথমত, বাংলাদেশ হবে জনগণের দেশ এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত দেশ; অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত দেশ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ হবে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত; অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক দেশ।

অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র মানে হচ্ছে মন্দিরের মূর্তি ভাঙার অধিকার কারও নেই কারণ এই মূর্তি কারও কাছে শুধুই মূর্তি হলেও কারও কাছে ভগবান, দেবী, পূজনীয়। তেমনি সব ধর্মের লোকদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্যের নামে ভিন্ন সংস্কৃতির গ্রিক দেবীকেও বসানো অসাম্প্রদায়িকতা নয়। শোভনীয় নয়। এই দেবীকে সরালে অন্যদের গা জ্বলারও কারণ থাকার কথা নয়। থেমিসের এই ভাস্কর্য বিচার ব্যবস্থার কী উন্নয়ন ঘটাবে, নারী মুক্তির কী কাজে আসবে! এর সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিক কী সম্পর্ক! এটাতো সত্য, আমাদের কারও ধর্মে যেমন মূর্তি পূজা আছে অন্যের ধর্মে মূর্তির বিরোধিতাও আছে। তাই ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ থেকে বিরত থেকে যেটি যেখানে মানায় তাকে সেখানে রাখাই উত্তম এবং অসাম্প্রদায়িকতা। সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সহযোগিতা করা। আনপ্রোডাকটিভ ইস্যুকে কেন আমরা ইস্যু বানিয়ে জাতিকে বিভক্ত করছি। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িকতার নামে যা ইচ্ছে করার সুযোগ নেই। সুযোগ নেই বৈশাখের মতো আমাদের সার্বজনীন উৎসবগুলোকে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখা। উচিত ধর্মীয়করণ থেকেও বিরত থাকা।

মাওলানারা ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতির আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। জাতিকে বিভক্ত করার কারণে তার পদত্যাগ করা উচিত বলে মত দিয়েছেন শোলাকিয়ার ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। অন্যদিকে থেমিসের ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনে খুশী নয় অনেক কথিত প্রগতিবাদীরাও। ফলে এই নিয়ে হাঙ্গামা, বিতর্ক সহজে থামবে মনে হচ্ছে না। বরং দিনে দিনে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করব যত শিগগিরই সম্ভব তিনি নিজেই যেন এই বিতর্কের অবসান করেন।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ