X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার সুখ-দুঃখ

বিথী হক
০২ জুন ২০১৭, ১১:১৮আপডেট : ০২ জুন ২০১৭, ১১:১৮

বিথী হক নারীবাদ বা নারী অধিকার আন্দোলন নারীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ বা নারীকে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ বলে বিবেচনা করানোর লক্ষ্যে কাজ করে না। এখানেই নারীবাদের সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের মৌলিক বিরোধ। পুরুষতন্ত্র যেভাবে পুরুষকে মহিমান্বিত করে, দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করে একচ্ছত্র মালিকানার অধিকার প্রদান করে নারীবাদ নারীকে সে রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। নারীবাদ নারীর অধিকার চায়, অধিকারের জন্য লড়াই করার একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এবং করতে চায়। নারীকে মানুষের কাতারে দাঁড় করিয়ে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দানের কথা বলে নারীবাদ। এর সাথে কোন নারী কোথায় দু’বছরের পুরুষ শিশুকে ধর্ষণ করলো, কোনও নারী তার স্বামী ও স্বামীর বন্ধু কর্তৃক নিজের বোনকে ধর্ষণ করালো তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। যারা করেন তাদের সাধারণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর হবে না খুব একটা।

অনেককেই বলতে শুনেছি ‘নারীরা এত বোকা কেন? নিজের আরাম-আয়েশ আর সুখের জীবন ছেড়ে এসে রাস্তার ধূলোবালি-ঝড়বৃষ্টির মধ্যে নিজের শরীর আর জীবনকে সঁপে দেওয়ার মতো বোকামি কেউ করে নাকি!’ বিষয়টা খোলাসা হওয়া উচিত নারীরা সুখে থাকা নাকি আত্মমর্যাদাকে প্রধান উপজীব্য করে তুলছে! এই প্রসঙ্গে ছোটবেলার পড়া বাবুই ও চড়ুই পাখির কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। রজনীকান্তের কয়েকটি লাইনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি তুলে দিচ্ছি-

বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
“কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই;
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা ‘পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।”
বাবুই হাসিয়া কহে- “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক, তবু ভাই, পরেরও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”

এরপরেও যারা বারবার সুখে থাকার কথা বলবেন, আরাম-আয়েশের কথা বলে নিজের তথা অন্যের তথা দেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নারীদের দিকে আঙুল তুলবেন এবং বোঝাতে চাইবেন কষ্ট করে বাইরে না বের হয়ে ঘরে বসে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আন্দোলন করাই নারীদের মানায় তারা আরেকবার এবং বারবার রজনীকান্তের এই কবিতাটি পড়বেন। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই নারীরা পুরুষকে ছোট করে বা ছোট প্রমাণ করে কিছু করতে চায় না। নারীবাদীদের, নারীদের এবং পুরুষদের প্রধান শত্রু পুরুষতন্ত্র নামক একটি সিস্টেমের। এই সিস্টেম যতদিন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকবে, এই সিস্টেমের ওপর ভর করে যতদিন সমাজপতিরা সমাজের স্থায়ী-অস্থায়ী সকল কল্যাণকাজে মাথা বন্ধক রাখবেন ততদিন নারী তার প্রাপ্য সম্মান পাবে না। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হলে যে সাম্যের কথা বলামাত্র সকল পুরুষ একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন একটা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে, সে সাম্য নিজের যুক্তিতে শান দিয়ে মেনে না নিলে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ‘একটি পরিবারে নারীর ক্ষমতা, নারীর কর্তৃত্ব ও নারীকে অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা প্রদর্শিত সম্মানকে নারীর মর্যাদা বলা হয়ে থাকে।’ আমাদের কারো কি জানায় কোনও ঘাটতি রয়েছে আমাদের দেশের এবং অত্র উপমহাদেশের পরিবারে নারীর মর্যাদা এখনও অধরা! এমন একজনও কি আছেন যিনি জানেন না নারীর বস্তুগত অবস্থা যথা খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, ক্ষমতা, স্বাস্থ্যগত উন্নয়নসহ জীবন-যাত্রার মান কোন পর্যায়ে রয়েছে। একজন নারী খাদ্য-গ্রহণের আগে কর্তাব্যক্তির পাতে ও সন্তানদের পাতে খাবার না তুলে দিয়ে খেতে বসতে না পারার ঘটনাকে যতদিন বৈষম্য না বলে দায়িত্বজ্ঞান বলে বিবেচনা করা হবে, নারীর নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা ও অনুশীলনের ক্ষেত্র তৈরি না করে নারীকেই স্বয়ং অধস্তন হিসেবে রেখে দেওয়া হবে ততদিন নারীরা প্রতিমুহূর্ত মার খেয়ে যাবে। তারা উপার্জন করলেও অধস্তন ও দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচিতি ছাপিয়ে নিজের স্বতন্ত্রতা খুব একটা মাটি ফুঁড়ে আলো-আঁধারের পৃথিবীর মুখ দেখবে না।

একজন নারীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপে না দেখে তাকে অন্যের সমর্থনে অনেকটা ক্রাচহীন পঙ্গুব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলে এবং নিজের স্ত্রী-সন্তানসহ অন্যান্য সম্পর্কের নারীদেরও বাড়তি করুণা ও দয়া দেখিয়ে পুরুষ আগ বাড়িয়ে নিজেকে ভগবানের বাহন ভাবালুতার সুযোগ না দিলে নারীরা নিজের পায়ে শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস দুই-ই পাবে।

এখনও জনগণের অধিকার বলতেই সকলের চোখে ভেসে ওঠে সমাজের প্রথম লীঙ্গের অধিকার। বাসে চড়া, প্লেনে চড়া, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করাসহ চাকরি-বাকরির ক্ষেত্র পর্যন্ত এখন অবধি নারীবান্ধব হয়নি। নারীবান্ধব হয়নি নারীর ঘর থেকে কর্মস্থল ও কর্মস্থল থেকে ঘরের পথটুকুও। অধিকার খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গেলে এই এতখানিই। সেটা দুঃখ-কষ্ট, অসুবিধাজনক যাই হোক না কেন; সমাজের অনিবার্য উপাদান হিসেবে, প্রকৃতির অর্ধেক রসদ হওয়ার দরুন নারীদের এই অধিকারটুকুকে নিজের হাতে মুঠোবন্দী করে রাখার মধ্যে বিশেষ কোনও গৌরব নেই। আজ হোক বা কাল নারীরা অন্যের হাতে তুলে রাখা নিজের অধিকারকে মুক্ত করবেই। নিজের অধিকার যার যার নিজের, সে হোক নারী বা পুরুষ। এই সত্য উপলব্ধি করতে পিছিয়ে পড়া আজন্ম গৃহবন্দী নারীদের বুঝতে দেরি হওয়া মানে কোনোদিনই তারা কিছু বুঝবে না এমনটা ধরে নেওয়ার অবকাশ নেই।

সমাজে পুরুষকে যেমন স্বাভাবিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, নারীকেও তেমনি স্বীকৃতি দিতে গিয়ে যদি নারীর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তবে সেটা নারীকে আরও বেশি শৃঙ্খলিত করবে। স্বাভাবিক মানুষ যদি খুন করে শাস্তি পায়, নারীও পাবে। তাতে অন্তত নারীকে মানসিক বিকলাঙ্গ ভাবা মানুষের সংখ্যা কিছুটা কমবে। কমে আসবে নারীকে সুবিধাবাদী বলে আখ্যা দেওয়া মানুষের সংখ্যাও। নারী বলে অপকর্ম করে সহজেই কাঁটা ডিঙিয়ে ওপাশের সুবিধা নিয়ে বাঁচবে তা তো হতে পারে না। নারী যেহেতু নারী অধিকার আন্দোলন করছে নারীবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘরে বাইরে লিঙ্গ বৈষম্যহীন জীবনের স্বপ্ন দেখছে, সেহেতু ঘরে বাইরের বৈরি আবহাওয়া-পরিবেশ আর কাঁটা বিছানো পথে রক্তাক্ত পায়ের বাস্তবতাও নারীকে প্রত্যাক্ষ করতে হবে। কারণ নারীবাদ শর্টকাটে নারী-মুক্তির সংগ্রামে বিশ্বাস করে না। দীর্ঘমেয়াদী তথা আজীবন লড়াই করার ব্রত নিয়েই অন্যের হস্তগত অধিকারকে নিজের কাছে ফিরে পাবার এই আন্দোলন। নারীর অপকর্মের দোহাই দিয়ে একে প্রশ্নবিদ্ধ করার যুক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাক, বেঁচে থাকুক আশা।

লেখক: সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ