X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিন্দুক কিংবা সুইস ব্যাংক

রুমীন ফারহানা
০৩ জুন ২০১৭, ১১:৪৩আপডেট : ০৩ জুন ২০১৭, ১১:৪৫

রুমীন ফারহানা ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’ নাম দিয়ে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার যা চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেট থেকে ২৬ শতাংশ বেশি। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ’ শব্দগুচ্ছ নিয়ে দুষ্টু লোক হাসাহাসি করতে পারে কিন্তু ‘সময় এখন আমাদের’ কথাটি নিয়ে দ্বিমত করার মতো মানুষ খুব বেশি নাই। এত দীর্ঘ নজিরবিহীন সুসময় বাংলাদেশের মাটিতে এর আগে কোনও সরকার ভোগ করে নাই। যাই হোক কথা হচ্ছিল বাজেট নিয়ে। মোটা দাগে বাজেট হলো রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ের হিসাব। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, বাজেট আমাদের কাছে আতঙ্ক ছাড়া তেমন কোনও বিশেষ অর্থ বহন করে না। বাজেট আসলেই আমরা ভয়ে থাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় কী কী জিনিসের দাম বাড়লো, কতটা বাড়লো, ভ্যাট, ট্যাক্স সব মিলিয়ে কী পরিমাণ অর্থ দিতে হবে সেই চিন্তায়। রাষ্ট্রকে দেওয়া অর্থ যদি সত্যিকার অর্থেই আমাদের কল্যাণে ব্যয় হতো তাহলে হয়তো এত আতঙ্ক তৈরি হতো না।
এবার বাজেট ঘোষণার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বাতাসে একটা গুঞ্জন ভাসছিল। ব্যাংকে ১ লক্ষ টাকা আমানত রাখলে নাকি ১ হাজার টাকা দিতে হবে সরকারকে। বাজেট ঘোষণার পর পুরোপুরি স্পষ্ট হলো বিষয়টা। ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে আবগারী শুল্ক দিতে হবে ৮০০ টাকা যা আগে ছিল ৫০০ টাকা। আর ১০ লাখ থেকে শুরু করে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত আগে যেখানে দিতে হতো দেড় হাজার টাকা, এখন দিতে হবে আড়াই হাজার টাকা। ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা হিসাবে থাকলে ৭৫০০ টাকার জায়গায় ১২০০০ টাকা আর ৫ কোটির ওপরে থাকলে কেটে রাখা হবে ২৫০০০ টাকা যা আগে ছিল ১৫০০০ টাকা।
আমানতে সুদের হার এখন এমনিতেই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে। এদিকে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ। এখন ব্যাংকে এক লাখ টাকা আমানত থাকলে বছর শেষে যে ৫ হাজার টাকা পাওয়া যাবে তার মধ্যে উৎসে কর আবগারি শুল্ক ও মূল্যস্ফীতি বাবদ কেটে রাখার পর মূল মূলধনই কমে যাবে আমানতকারীর। সুতরাং ব্যাংকে টাকা আমানত রাখার সকল ইচ্ছা হারাবেন আমানতকারীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলো এখন সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ সঞ্চয় স্কিমেও সুদহার নেমে এসেছে একই পর্যায়ে। অনেক ব্যাংকের সুদহার ৫ শতাংশের কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত হিসাবের সংখ্যা প্রায় আট কোটি। এর মধ্যে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি মেয়াদি আমানত। সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে ২০ শতাংশের মতো। মোট আমানতের মধ্যে বেসরকারি খাতের অংশ ৮৩ শতাংশ। বাকিটা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের। গ্রাহকের আমানত থেকে যে মুনাফা আসে, তার ওপর ১০ শতাংশ কর নেয় সরকার। আর টিআইএন না থাকলে কাটা হয় ১৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি আমানত ও ঋণ উভয় হিসাব থেকে বছরে একবার আবগারি শুল্ক কাটা হয়। ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর কর বাড়ানোকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা বলে উল্লেখ করে একে ‘দিনদুপুরে ডাকাতি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক জনাব আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংকে সাধারণত আমানত রাখে কারা? মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি কষ্টে জমান কিছু টাকা থাকে ব্যাংকে আমানত হিসাবে। পরিবারের অতি আদরের মেয়েটির বিয়ের খরচ, পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা, সন্তানের উচ্চশিক্ষা এই সব ভেবেই তিল তিল করে জমানো টাকা আমানত হিসাবে রাখে মানুষ। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির পর মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের মানুষের বিনিয়োগের ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে। ব্যাংকলুটের হাজার কোটি, শেয়ার বাজারের দরবেশ বাবার টাকা কিংবা ইয়াবা সম্রাটের লক্ষ কোটি টাকা দেশের আমজনতার ব্যাংকে আমানত হিসাবে ঢোকে না।
ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার কমছে বহুদিন ধরে। সুদের হার কমার একটি বড় কারণ হলো সরকারি ব্যাংকগুলোতে হরির লুট। বর্তমানে দেশে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ ঋণ হিসাবে এলে খেলাপি ঋণ হতো ১ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকা। হিসাবটি আঁতকে ওঠার মতো। লুটপাটের মহোৎসবে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। জনগণের করের টাকায় মেটানোর চেষ্টা চলছে এই মূলধন ঘাটতি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ২০১১-১২ থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাডে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এমন কী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও ২ হাজার কোটি টাকা মূলধন বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। বাজেট বক্তৃতায় বুদ্ধিমান অর্থমন্ত্রী অবশ্য বিষয়টি চেপে গেছেন। সাধারণ মানুষের রক্ত পানি করা টাকা শুষে নিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বিশিষ্ট ঋণ খেলাপী, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা দরবেশ কিংবা বেসিক ব্যাংকের বাচ্চু আছে বিচারের ঊর্ধ্বে। অর্থমন্ত্রী তাদের চোখে দেখেন না। তার চোখ আটকে যায় পাতি মধ্যবিত্তের তিলতিল করে জমানো ১ লক্ষ টাকার ওপর।
বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা হয়েছে টাকা। আগে যেখানে লক্ষ টাকা চুরি শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠত এখন হাজার কোটি বা লক্ষ কোটির নিচে সবই ডাল-ভাত। টাকা এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় রফতানিযোগ্য পণ্য। আমাদের মতো কিছু পাতি মধ্যবিত্ত ছাড়া দেশে এখন আর কেউ টাকা রাখে না। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যানসিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭৫৮৫ কোটি  অর্থাৎ ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৬,০৬,৮৬৮ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের প্রায় দুই বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ। আর ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তে আমাদের রিজার্ভ ছিল ৩২.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার অর্থ দাঁড়ায় এই পাচার হওয়া টাকা আমাদের বর্তমান রিজার্ভের দুই গুণেরও বেশি। নির্বাচনের আগে আগে পাচার বাড়ে। নানা কারণেই বাড়ে। সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের লুটের টাকা রক্ষার একটা সহজ উপায় হলো বিদেশে পাচার। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনি বছরে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার বা ৭২,৮৭২ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই টাকা চলতি অর্থ বছরের পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্হ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানি সম্পদ খাতের উন্নয়ন বাজেটের সমান। এই পাচার হওয়া টাকার একটা বড় অংশ হলো অবৈধ উপায়ে অর্জিত কালো টাকা। আর পাচার হওয়ার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনীতির প্রতি আস্থার অভাব, দেশের বাইরে একটি নিরাপদ বলয় তৈরি করে রাখা যাতে সুযোগ মতো বেরিয়ে যাওয়া যায়, আমাদের ব্যাংকগুলোর করুণ অবস্থা এবং সর্বোপরি লুটের টাকার একটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি।
বর্তমানে সুদের হার অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক কম। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাশুল। এ ছাড়াও মুনাফার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। হিসাব স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমানতকারীরা ব্যাংকবিমুখ হয়ে হয়ত ছুটবেন অনিরাপদ শেয়ারবাজার বা সমবায় সমিতিগুলোতে। এতে ছায়া অর্থনীতি আরও বাড়বে। অর্থমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্ত বিশ্বে নজীরবিহীনই শুধু নয় বরং চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ। ব্যাংক লুটেরা থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচারের আওতায় না এনে বরং নানান ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে, সাধারণ মানুষের ঘামের টাকায় ব্যাংকের মূলধন জোগাড় করে এবং মানুষকে নানা সম্ভব অসম্ভব করের জালে আটকে যে বাজেট অর্থমন্ত্রী পেশ করলেন তাতে দিনের শেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সীমিত আয়ের মানুষজন।
সরকারি ব্যাংকগুলো দলীয় লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর সরকার এখন ব্যাংকগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের জন্য আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে দুই জনের স্থলে চার জন পরিচালক এবং পরপর দুই মেয়াদের পরিবর্তে তিন মেয়াদ অর্থাৎ টানা নয় বছর পরিচালক থাকা বৈধ ঘোষণা করেছে। পরিশেষে তাই বলি সুইস ব্যাংকে যাদের যাওয়ার ছিল তারা ইতিমধ্যেই চলে গেছে, আপনার আমার আপাতত সিন্দুক ছাড়া গতি নাই।

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ