X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক লেনদেনে শুল্ক দিতে হবে কেন?

শওগাত আলী সাগর
০৩ জুন ২০১৭, ২২:২১আপডেট : ০৪ জুন ২০১৭, ১৫:৩১

শওগাত আলী সাগর ‘এক্সাইজ ডিউটি’ বা ‘আবগারি শুল্ক’—এই শব্দগুলো বাংলাদেশে নতুন নয়। কিন্তু এগুলো কখনোই সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত তার জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ’ বাজেটটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার পর এই শব্দগুচ্ছটি দৈনন্দিন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বহুল অবহেলিত শব্দগুচ্ছকে মানুষের মুখে মুখে তুলে দেওয়ার কৃতিত্ব অর্থমন্ত্রীর নিঃসন্দেহে। শুধু তাই নয় ‘এক্সাইজ ডিউটি’ বা ‘আবগারি শুল্ক’-এর নতুন ও ‘ক্রিয়েটিভ’ ব্যবহার পদ্ধতি আবিষ্কারের কৃতিত্বও তার।
সদ্য জাতীয় সংসদে পেশ করা বাজেটে অর্থমন্ত্রী ‘ব্যাংক একাউন্টে’র ওপর ‘এক্সাইজ ডিউটি’ আরোপের প্রস্তাব করেছেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। আমি নিজে অবশ্য এ নিয়ে একটু সংশয়ে আছি। বাজেটে অর্থমন্ত্রী আসলে কী প্রস্তাব করেছেন, সেটি নিয়ে আমার খানিকটা ধোঁয়াশা আছে। বাজেট উত্তর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় নতুন বাজেটে বছরের যেকোনও সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ১২ হাজার টাকা ও ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেনে ১৫ হাজার টাকার বদলে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

এই বক্তব্য পড়ে মনে হতে পারে অর্থমন্ত্রী আসলে ‘লেনদেনের’ ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা বাজেট বক্তৃতার ইংরেজি ভার্সনটিতে বলা আছে, I am proposing not to impose any Excise Duty on the accounts where the balance, whether debit or credit does not exceed the limit of Taka 1 Lakh at any point of time during a year. However, I am proposing to impose Taka 800 Excise Duty instead of existing Taka 500 in cases where the balance, whether debit or credit exceeds Taka 1 Lakh but does not exceed the limit of Taka 10 Lakh. Similarly, Taka 2,500 will be imposed instead of existing Taka 1,500 in cases where the balance exceeds Taka 10 Lakh but does not exceed the limit of Taka 1 crore; Taka 12,000 will be imposed instead of existing Taka 7,500 in cases where the balance exceeds Taka 1 crore but does not exceed the limit of Taka 5 crore and Taka 25,000 will be imposed instead of existing Taka 15,000 in cases where the balance exceeds Taka 5 crore. এখানে  এক্সাইজ ডিউটি ইম্পোজ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ‘ব্যালেন্স’ এর ওপর। ‘লেনদেন’ আর ‘ব্যালেন্স’ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। অর্থমন্ত্রী আসলে কোনটাকে টার্গেট করেছেন, সেটা কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিলে খুশি হতাম।

অর্থমন্ত্রীর নিশানায় ‘ব্যালেন্স’ই থাক আর ‘লেনদেন’ই থাক- আবগারি শুল্কের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী বিষয়। ইনোভেটিভও। কেন যুগান্তকারী, সেই আলোচনায় যেতে হলে ‘এক্সাইজ ডিউটি’র ইতিহাসটা একটু ঘুরে আসতে হয়।

ইংরেজি ‘এক্সাইজ’ শব্দটা এসেছে ডাচ accijins থেকে। accijins শব্দটা আবার এসেছে ল্যাটিন accensare থেকে, যার  অর্থ হচ্ছে  to tax বা কর আরোপ করা। এই এক্সাইজ জিনিসটার প্রচলন শুরু আসলে সতেরো শতকে। ব্রিটিশ রাজের পুনরুত্থানের পর অনেক সামাজিক রীতিনীতিই বদলে ফেলা হয়। কিন্তু ‘টেনোরস অ্যাবুলিশন অ্যাক্ট ১৬৬০-এর আওতায় ‘এক্সাইজ ডিউটি’ চালু করা হয়। মোনার্কির দখলে থাকা নানা জায়গায় বসবাসরত অধিবাসীরা রাজপরিবারকে এই ‘এক্সাইজ ডিউটি’ পরিশোধ করত। পরবর্তীকালে অবশ্য এটিকে খানিকটা সামাজিকীকরণ করা হয়। যে সব বিষয়কে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হতো সেগুলোর ওপরই ‘এক্সাইজ ডিউটি’ আরোপ করা শুরু হয়। ১৭৫৫ সালে এসে স্যামুয়েল জনসন তার ডিকশনারিতে ‘এক্সসাইজ ডিউটি’র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন,  Hateful Tax’ বিভিন্ন পণ্যের ওপর আরোপ করা ‘ঘৃণার শুল্ক’। আমাদের অর্থমন্ত্রীও যে আইনের আওতায় তার এই অভিনব প্রস্তাবনা এনেছেন, সেটিও কিন্তু ১৯৪৪ সালের। ২০১৭ সালের ‘ডিজিটাল সরকারের’ শাসনামলে তো এই আইন রদ হয়ে যাওয়ার  কথা।

ডিকশনারির কথাই যখন এলো, তখন বিভিন্ন অভিধান ‘এক্সাইজ ডিউটিকে’ কিভাবে ব্যাখ্যা করেছে, সেদিকেও নজর দেওয়া যাক। ইংরেজি ভাষার নামিদামি অভিধানগুলোয় বাণিজ্য জগতের পরিভাষায় ‘এক্সাইজ ডিউটি’কে বলা হয়েছে তৈরিপণ্যের ওপর আরোপ করা শুল্ক হিসেবে। এই সব ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—পণ্য তৈরির সময় এই শুল্ক আরোপ করা হয়, বিক্রির সময় নয়। পণ্য তৈরির সময় অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং প্রোডাক্টের জন্য প্রযোজ্য এই এক্সাইজ ডিউটি। তা হলে এই ‘এক্সাইস ডিউটি’ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে এলো কিভাবে? ব্যাংক একাউন্ট কি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং প্রোডাক্ট?’ আরেকটা কথা, অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় কিন্তু ‘কর’ বলেননি, বলেছেন  ‘শুল্ক’। শুল্কটা পণ্য বা সেবার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আয়ের ওপর, মুনাফার ওপর কর হয়, শুল্ক হয় না। এগুলো তো ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাথমিক পাঠ।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাকাউন্ট কিনা, সেই বিতর্ক থাক। স্যামুয়েল জনসনের এই ‘হেইটফুল ট্যাক্স’টা অর্থমন্ত্রী কোথায় আরোপ করতে চাচ্ছেন? লেনদেনে? নাকি ব্যালেন্সে? কেউ যখন টাকা জমা দেন বা ওঠান, সেটাই তো লেনদেন। ব্যাংক একাউন্টে টাকা জমা দিলেই বা ওঠালেই ‘শুল্ক দিতে হবে কেন? কিংবা যদি ব্যালেন্সকেই বিবেচনায় নেই, তা হলে ব্যাংকে ব্যালেন্সের জন্যই বা শুল্ক দিতে হবে কেন? কারও আয় যদি করযোগ্য হয়, তিনি তো আয়করই দেবেন। ব্যাংকে লেনদেন বা ব্যালেন্সের জন্য ‘শুল্ক’ আদায়ের এই অভিনব দৃষ্টান্ত কি পৃথিবীর আর কোনও দেশে আছে? নেই। তা হলে? 

লেখক: টরন্টোর  বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’-এর প্রধান সম্পাদক 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মোংলায় নামাজ পড়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা
মোংলায় নামাজ পড়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা
শিল্পকলায় মঞ্চায়িত হলো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘হি-রোজ’
শিল্পকলায় মঞ্চায়িত হলো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘হি-রোজ’
খারকিভে আবাসিক ভবনে রুশ হামলায় আহত ৬
খারকিভে আবাসিক ভবনে রুশ হামলায় আহত ৬
গরমে সুস্থ থাকতে চাইলে মানতে হবে এই ৮ টিপস
গরমে সুস্থ থাকতে চাইলে মানতে হবে এই ৮ টিপস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ