X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাদের জন্য বাজেট?

ড. খুরশিদ আলম
০৪ জুন ২০১৭, ১২:১১আপডেট : ০৪ জুন ২০১৭, ১২:১৮

খুরশিদ আলম দু’তিন মাস আগে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সাথে কোনও একটি অনুষ্ঠানে দেখা হলে তাকে চাহিদাভিত্তিক বাজেট (নিডস বেইসড বাজেট) তৈরির জন্য অনুরোধ করি। এও বলি যে, এটি আমরা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছিলাম। দীর্ঘ প্রায় এক বছর কঠোর পরিশ্রম করে আমি একজন বিদেশিকে নিয়ে এটি তৈরির একটি ছক তৈরি করি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তখনকার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিই এবং তারা তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন বিভাগে অনুশীলন করে। এটির অনেক সুফলও পাওয়া যায়; যেমন, এতে কোন বিভাগে আসলে কত টাকা প্রয়োজন, কোথায় কত টাকা খরচ লাগবে এবং অর্থ বরাদ্দ কম থাকলে কোন খরচ করতে হবে আর কোনটি বাদ দিতে হবে তার একটি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। কোনোভাবে একজনের ইচ্ছানুযায়ী সরকারের টাকা যে কোনও কাজে খরচ করা যায় না বরং অগ্রাধিকারভিত্তিক তা খরচ করতে হয়। এতে অপচয় শূন্যের কোটায় নেমে আসে, ফলে দুর্নীতি করার সুযোগ অনেক কমে যায়। প্রস্তাবটি শুনে কয়েক সেকেন্ড ভেবে তিনি বললেন, ‘এই সব নিডস বেইসড বাজেট বা জিরো বাজেট, এগুলো সব ভোগাস, আমি যে বাজেট করি সেটি বেস্ট বাজেট’।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী ১ জুন ২০১৭ তার সেই ‘বেস্ট বাজেট’ জাতিকে উপহার দিয়েছেন। এখন সেই ‘বেস্ট বাজেট’ নিয়ে জনগণের মধ্যে তেমন কোনও ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ জনগণের মতামত যতটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা গেছে তাতে তারা তেমন ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেননি। প্রতি বছর ব্যবসায়ীরা যেটিকে মোটামুটি স্বাগত জানান এ বছর তাও তেমন দেখা যাচ্ছে না বরং ব্যবসায়ীরা বাজেট ঘোষণার আগে বারবার বৈঠক করে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ভ্যাট এবং ট্যাক্স - এ দুটোতে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন আনার অনুরোধ জানান। কিন্তু সে বিষয়ে তিনি সন্তোষজনক কিছু করেননি বরং তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।

প্রথমত, প্রায় সকল ব্যবসায়ী ১৫% ভ্যাটের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হলো এটি অনেক বেশি এবং আশেপাশের দেশগুলোতে এর চেয়ে অনেক কম ভ্যাট আদায় করা হয়। মাননীয় মন্ত্রীর দাবি হচ্ছে ৮.৫ লক্ষ ব্যবসায়ী যারা ভ্যাটের রেজিট্রেশন নিয়েছেন তাদের মাত্র ৩২ হাজার এ ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে থাকেন। যদি তাই হয় তাহলে যারা ভ্যাট দিচ্ছে না তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় না করে যারা দিচ্ছে তাদের কাছ থেকে বেশি হারে ভ্যাট আদায় করে তাদের ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ডকে পঙ্গু করে দেওয়ার যুক্তি বোধগম্য নয়, নীতিগত প্রশ্নেতো নয়ই। যারা ভ্যাট দিচ্ছেন ধরে নিচ্ছি- যারা দিচ্ছে না তাদের থেকে নিশ্চয়ই সৎ, তাহলে তাদেরকে অন্যের অপরাধের জন্য শাস্তি প্রদানের কোনও যুক্তি আছে কি? আর যাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, ১% ভ্যাট কমিয়ে দিলে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কমে যাবে। আগে আমরা দেখতাম যে, সরকারের বাজেটে কোনও একটি কর যুক্ত হলে বা কমালে সরকারের রাজস্ব কম বৃদ্ধির একটি হিসাব পাওয়া যেত, এখন তা আর দেখা যায় না। ফলে দেশের মানুষ বুঝতে পারে না যে, কোনটি কী কারণে করা হয়েছে বা হয়নি। এখন যদি ৩২ হাজারের কাছ থেকে সে অর্থ পাওয়া যায় তাহলে বাকি সকলের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করলে অনেক অর্থই পাওয়া যেত এবং কোনও সন্দেহ নেই ভ্যাটের হার অনেক গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেত। সৎ ব্যবসায়ীরা আরও অনেক উপকৃত হতো, জাতি একটি সৃজনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি পেতো।

দ্বিতীয়ত, বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য এ বাজেটে কোনও বক্তব্য নেই বা এটি যে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা সে সম্পর্কে কোনও বক্তব্য নেই। সম্প্রতি বিবিএস ও বিএমইটি-এর তথ্যে দেখা যায় যে, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে এবং বিদেশে কর্মসংস্থান কমেছে। বেকার সমস্যা সমাধান বা কর্মসংস্থান কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তা কেউ জানে না।  

তৃতীয়ত, গ্রামীণ এলাকার ৮০% এবং শহরের ২০% শিক্ষার্থীর পরিবারে শিশুদের পড়াবার মতো কোনও শিক্ষিত লোক নেই। তাদের বাসায় শিক্ষা কে দেবে এবং কিভাবে একটি শিক্ষিত জাতি তৈরি হবে তার কোনও কৌশল কিন্তু এ বাজেটে উল্লেখ নেই। তাদের পাঠ তৈরিতে সহায়তার জন্য কোনও বরাদ্দ যদি রাখা হতো এবং বেকারদের সে কাজে পার্ট-টাইম নিয়োগ করার বিধান করা হতো তাহলে লক্ষ লক্ষ বেকারের অস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে ‘গুণগত বনাম সংখ্যাগত পদ্ধতি’ বলে যে বিতর্ক চলছে তার কোনও প্রয়োজন হতো বলে মনে হয় না।

চতুর্থত, সঞ্চয়ের ওপর অতিরিক্ত করারোপের চেষ্টা আরেকটি নেতিবাচক দিক। এর ফলে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে যাবে। আবার ব্যাংকে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার এমনকি মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও কম। তার অর্থ হচ্ছে, কেউ যদি সঞ্চয় করে তার টাকার পরিমাণ দিন দিন আরো কমে যাবে। এখানে অন্তত ব্যাংকের সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হবে না বা তার চেয়ে ০.৫-১% বেশি রাখা দরকার ছিল যে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। 

পঞ্চমত, বাজেটে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা নেই সেটি হলো সরকারি ব্যাংকগুলোতে যে লুটতরাজ হয়েছে এবং হচ্ছে জনমনে সে সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছে তার প্রতিবিধান করার জন্য কী করা হবে নাকি বরাবরের মতো আগামী দিনেও জনগণের করের টাকা দিয়ে তাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে সে সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনার কথা নেই। এটি যারা কর দেয় তাদেরকে বড়ই কষ্ট দেয় এবং সরকারের আগামী নির্বাচনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। এ বিষয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জাতির সামনে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রদান করতে হবে। তা ছাড়া সরকারি খাতে এতগুলো ব্যাংক রাখার প্রয়োজন কী এবং তার জন্য বছর বছর এভাবে পূর্ণভরণ বা লুটপাঠ সহায়তা তববিল রাখার দরকার আছে কিনা তার ব্যাখা থাকা দরকার।  

ষষ্ঠত, সরকার আয় করে না কারণ ব্যয় করতে পারে না যাকে বলা যায় আয়ের চাহিদার ঘাটতি সংকট (রেভিনিউ ডিমান্ড ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রম)। এতে দেশের একটি উপকার হচ্ছে অর্থাৎ যারা আয়কর দিচ্ছে না তারা অন্তত সে টাকা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে। তা কর্মসংস্থানসহ জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যোগ হচ্ছে। তাহলে মনে হতে পারে যে, সরকারের ব্যর্থতায় দেশের উপকার হচ্ছে। বিষয়টি কিন্তু এত সরল নয়। সরকার যদি বেশি করে রাজস্ব আদায় করতে পারতো, তাহলে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে পারতো এবং তা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রাখতে পারতো। যেমন, পদ্মা সেতু হলে যদি জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১-১.৫% বেড়ে যায় তাহলে তা আরো আগে করতে পারলে দেশের দ্রুত অগ্রগতি হতো। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পথ যেমন, ঢাকা-চট্রগ্রাম রেলওয়ে, হাইওয়ে, বন্দর উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার যা দেশের প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখতে পারে।   

সপ্তমত, কৃষিতে অশনী সংকেত দেখা যাচ্ছে। মুহুরী প্রকল্পসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ বছর বোরো ধানের চাষ একেবারে কমে গেছে। বর্গাচাষীরা আর আগের মতো জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধান চাষ করছে না কারণ শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য খরচ অনেক বেশি। ফলে বিশেষ করে মওসুমের সময় চালের দাম কম থাকাতে তারা আর ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছে না। এ বিষয়ে কিভাবে সমাধান করা যায় তা আলোচনায় আসা দরকার ছিল। 

অষ্টমত, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার এবং কিভাবে এই বিশাল অলস টাকার বিনিয়োগ সম্ভব সে বিষয়ে তিনি কোনও কর্মকৌশল প্রদান করেননি। 

নবমত, সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের ব্যাপারে দক্ষতা সম্পর্কে মানুষের সন্দেহ এবং সংশয় রয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ না হলেও তিনিও এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের মধ্যে অপচয়ের হার ২০%-এর কম নয়। বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আদায় যত বাড়ছে অপচয়ও তত বাড়ছে। কারণ প্রকল্পগুলোর ব্যয় বরাদ্দের কোনও সূক্ষ বিশ্লেষণ করা হয় না বা কোনও সঠিক প্রাক-বিনিয়োগ মূল্যায়ন বা এপ্রাইজাল নেই।  

সরকারের উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে রাজস্ব বাজেট অনেক বড়। সরকার ১৬ হাজার কোটি টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করলেন, তাতে তাদের কর্মতৎপরতা কত শতাংশ বেড়েছে এবং দুর্নীতি কত শতাংশ কমেছে তার কোনও হিসাব তিনি উল্লেখ করেননি। এ ব্যয়ের কোনও অর্থনৈতিক যুক্তি তিনি তুলে ধরলে হয়তো করদাতারা অনেক বেশি খুশি হতেন।

পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বাজেট আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা কিছুটা বাড়িয়ে দেবে। সঞ্চয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিনিয়োগের পাশাপাশি অর্থপাচারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। কিভাবে সে সঞ্চয়কে পাচারে নয় বিনিয়োগে আনা যাবে তার কোনও দিক নির্দেশনা এই বাজেটে নেই।  

বাজেটের শ্রেণিগত বিশ্লেষণ দিয়ে বলা যায় যে, হঠাৎ চালের দাম বৃদ্ধি গরিব মানুষদের এমনিতে অসন্তুষ্টি বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিম্নআয়ের মানুষকেও ক্ষুব্ধ করেছে। বেকারদের জন্য বাজেটে খুশী হওয়ার মতো কিছু নেই। এর সাথে বর্তমান বাজেট মধ্যবিত্ত এবং ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অসন্তুষ্ট করেছে। তাহলে প্রশ্ন- কোন শ্রেণিকে সন্তুষ্ট করার জন্য এটি করা হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীই সেটি ভালো জানেন। সকলের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য বাজেট তৈরি করা কি এতটাই অসম্ভব ছিল?  

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ