X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যে সব দুর্গতির মূল ৬৭ সালের যুদ্ধ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৮ জুন ২০১৭, ১৫:০০আপডেট : ০৮ জুন ২০১৭, ১৬:২৩

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ৬ দিনব্যাপী আরব-ইসরায়েলের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এ যুদ্ধ থেকে আরবের দুর্গতির সূচনা যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষা হলো কোনও জাতির আত্মগ্লানির পরিবর্তে আত্মবিস্মৃতির প্রাদুর্ভাব হলে সে জাতির ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতির অবস্থা হয়েছে তাই।
১৯৬৭ সালে যখন আরব ইসরায়েল যুদ্ধ হয় তখন ইসরায়েলের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ২১ লাখ। অথচ মিসর, সিরিয়া আর জর্ডানের লোক সংখ্যা ছিল বহুগণ বেশি। তাদের সামরিক বাহিনীও ছিল অনেক বড়। সামরিক সরঞ্জামও নেহায়েত কম ছিল না। আমেরিকা ইসরায়েলকে যেমন অকাতরে অস্ত্র দিয়েছে সোভিয়েত রাশিয়াও মিসরকে এবং সিরিয়াকে অঢেল অস্ত্র সরবরাহ করেছে। জর্ডান অস্ত্র পেয়েছে আমেরিকা থেকে। তখন ইসরায়েলের আয়তন হচ্ছে ২১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আর মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের আয়তন হলো লক্ষ বর্গ মাইলের ওপরে। এ ব্যাপক ব্যবধানের মাঝে যুদ্ধ হলো অথচ আরবরা হেরে গেলো।
যুদ্ধ হয়েছিলো মাত্র ছয়দিন অর্থাৎ ৫ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত। ইসরায়েল মিসরের গাজা ও সিনাই উপত্যকা দখল করে সুয়েজের পূর্ব তীরে অবস্থান নেয় সিরিয়ার গোলান হাইট দখল করে আর জর্ডানের নদীর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এলাকার পরিমাপ দেখে বুঝা যায় যে আরবিরা কোনও প্রতিরোধই সৃষ্টি করতে পারেনি। মিসরীয়রা ৮ জুন জাতিসংঘের অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়।

যদি ইসরায়েল আর কয়েকদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেত পারতো তবে তারা সুয়েজের পশ্চিম তীরে পৌঁছে সম্পূর্ণ সুয়েজ খালই তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারত। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিসরীয় বাহিনী সুয়েজ খাল অতিক্রম করে পূর্ব তীরে পৌঁছেছিল সত্য কিন্তু কখনও সুয়েজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পরবর্তীতে মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আনেয়ার সাদত ইসরায়েলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করে সিনাই উপত্যকা আর সুয়েজখাল পরিপূর্ণভাবে অবমুক্ত করেছিলেন। আর চুক্তির শর্তানুসারে গাজা ফিলিস্তিনিদের বসতির জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন গাজায় শতাংশে ফিলিস্তিনীরা বসবাস করে।

গাজা অবশ্য কখনও মিসরের অংশ ছিল না। গাজা ছিল ফিলিস্তিনের ৬ জেলার এক জেলা। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় গাজা জেলা মিসর দখল করে নেয়। জেরুজালেমকে জর্দানের সঙ্গে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন সময় থেকে গাজা আর জেরুজালেম বরাবর ফিলিস্তিনেরই অংশ ছিল।

রোমানেরা ইহুদি জনগোষ্ঠীকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছিলো। রোমানেরা ইহুদিদেরকে কখনও পছন্দ করেনি। তারা ইহুদিদেরকে নাস্তিক মনে করতো কারণ রোমানেরা বহুদেব দেবীর পূজা করতো কিন্তু ইহুদিদের কোনও দেব-দেবী ছিল না আর ইহুদিরা কখনও রোমানদের শাসন মানতে চাইতো না। কলহ বিবাদ এমনকি বিদ্রোহ লেগে থাকতো। ইহুদিরা এক হাজার আটশত বিশ বছর রাজ্য হারা অবস্থায় পৃথিবীর বহু জায়গায় বসবাস করেছে সত্য কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে কোথাও রাষ্ট্র গড়ে তোলার কোনও সিদ্ধান্ত ইহুদিদের ছিল না। বরঞ্চ তারা সব সময় জাইনবাদ আন্দোলন করেছেন ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়।

ফিলিস্তিনকে বাইবেলে বলা হয়েছে কেনান। কেনান প্রাচীন জনপদ। হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে টাইগ্রিস নদীর তীরে তার জন্মভূমি থেকে হিজরত করে কেনান এসেছিলেন। এখন ফিলিস্তিনীরা কলহ বিবাদে লিপ্ত হয়েছে সত্য কিন্তু হযরত ইব্রাহীমের আগমনের পূর্বে তো কেনানীরা সবাই এক ও অভিন্ন ছিলো। ইব্রাহীমের সময় থেকে ধর্মের বৃত্তিতে কেনানীদের মাঝে বিভক্তি আসে। আনুধিক যুগে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা আর সর্বশেষ রক্ত পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে ওই অঞ্চলের ইহুদি খ্রিস্টান আর মুসলমান এক রক্ত প্রবাহের মানুষ।

ধর্মের বিভাজনই এখন মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইহুদি জাতি উন্নত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এসিটোনের অভাবে বিস্ফোরক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এসিটোন তৈরি করতে তিমি মাছের চর্বি প্রধান উপাদান। জার্মানির সাব-মেরিনের অত্যাচারের সমুদ্র থেকে তিমি শিকার করা কোনও রকমেই সম্ভব হচ্ছিল না। তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জজ বৈজ্ঞানিকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন বিকল্প কোনও উপায় উদ্ভাবনের জন্য। ইহুদি বৈজ্ঞানিক ওয়্যাইজম্যান বিকল্প ব্যবস্থায় ৩০ টন এসিটোন তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারকে সরবরাহ করেছিলেন।

এই কারণে প্রধানমন্ত্রী লয়েড জজ তাকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন এবং যুদ্ধের পরে ইহুদিদের বসতির জন্য ফিলিস্তিনে একখণ্ড ভূমির প্রার্থনা পেশ করেছিলেন। ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার অনুমোদন নিয়ে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফোর জিওনবাদী আন্দোলনের ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। ইহাই ঐতিহাসিক বালফোর ডিক্লারেশান।

জিওনবাদী আন্দোলনের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ইউরোপের কোনও বড় শক্তির অনুগ্রহ ভিন্ন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তখনও ফিলিস্তিন তুর্কি খেলাফতের অধীন ছিল। ১৯১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর জেনারেল এলেনবীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ১৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইহুদিরা রোমানদের দ্বারা ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো ১৯১৮ সাল থেকে ধীরে ধীরে চোরা পথে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। অর্থাৎ এক হাজার সাত শত চৌরাশি বছর পর তারা পুনরায় ফিলিস্তিনে ফিলে আসা আর বসতি স্থাপনের কাজ আরম্ভ করেছিলো।

১৭৮৪ বছরের মাঝে যখনই ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসেছে তখন তারা জিহুবার মন্দিরের ভগ্ন দেয়াল ধরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা পেশ করেছে ‘হে ঈশ্বর আমাদের জন্মভূমি ফিরিয়ে দাও।’ ইতিহাসের এক অদ্ভূত জাতি। ইহুদিরা বলে ইহুদি বাইবেলে নাকি ঈশ্বর তাদেরকে কেনানের এ ভূমির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মানুষ নিজের অস্তিত্বের জন্য, নিজের আবাসের জন্য, নিজের উন্নতি অবনতির জন্য নিজেই নিজের কাছে দায়ী। ইহুদি জাতি এ বিষয়ে ইতিহাসের এক মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এখন কারও পক্ষে তার অস্তিত্ববিপন্ন করা খুবই কঠিন।

বিশ্বের ইতিহাস যতটুকু পড়েছি তাতে কোনও জাতিকে এত লাঞ্ছনা সহ্য করতেও দেখিনি, কোনও জাতিকে এত পরীক্ষার সম্মুখীন হতেও হয়নি। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হিটলার হত্যা করেছে। রাণী ইছাবেলা ৮০ হাজার ইহুদিকে তার দেশ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বের করে দিয়েছেন। এত অত্যাচারের পর একটা জাতি যখন বসতির জন্য তার কাঙ্ক্ষিত জায়গাটা পেয়েছে তখন তাকে বিপন্ন করার কারও শক্তি আছে বলে মনে হয় না। কারণ তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় তার দেশ।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধটার পরিকল্পনা করেছিলো যৌথভাবে মিসরের প্রেসিডেন্ট কর্নেল নাসের, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ আর জর্ডানের বাদশা হোসেন। জর্ডানের বাদশা ছিল সিআইএ-এর এজেন্ট। এটা প্রগতিবাদীদের মুখরোচক অভিযোগ নয়। সিআইএ- এর অবমুক্ত দলিলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এজন্য সিআইএ তাকে বিরাট অঙ্কের মাসহরা দিতো। কর্নেল নাসের ছিলেন একজন সামরিক অফিসার এবং দীর্ঘ সময়ব্যাপী মিসরের প্রেসিডেন্ট। হাফেজ আল আসাদের অবস্থাও তাই। তারা ইসরায়েলের শক্তির পরিমাপ না করে এ যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এটা ছিল তাদের হটকারী সিদ্ধান্ত। আরব জাতীয়তাবাদের একটা বায়বীয় শক্তি দিয়ে তো যুদ্ধ চলে না। তারা এ যুদ্ধ লাগিয়ে আরবের যে ক্ষতি করেছিলেন গত ৫০ বছরেও তার মাশুল শোধ করে আরব জাতি তার থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না।

আরবিরা এখন ইসরায়েলের সঙ্গে একটা সমঝোতা করেছে। পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। সন্ধির পতাকা যারা বহন করে তারা কিন্তু পবিত্র লোক। তবে পৃথিবীতে তাদেরই বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে যাদের হাতে রক্তলোলুপ তরবারি রয়েছে। এটাই হচ্ছে প্রত্যেক জাতির জীবনের শেষ রক্ষাকবচ।

 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ