X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্তৃত্ববাদ বনাম সহনশীলতা

জাহানারা নুরী
০৯ জুন ২০১৭, ১৬:৪১আপডেট : ১০ জুন ২০১৭, ১৯:৪৪

জাহানারা নুরী বাঙালি তার ‘নিরীহ’ উপাধি বাতিল করে অসহিষ্ণুতাকে গুণরূপে গ্রহণ করেছে।  সহিষ্ণু নারী ও পুরুষকে এ সমাজে ধিক্কার ও অবমাননা ভোগ করতে হয়।  অসহিষ্ণুতা অধিকার করে নিচ্ছে- সমাজ, পরিবার, মানুষ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, ছেলে এবং মেয়েকে।  রাগ, লোভ ও অন্যায়ের সঙ্গে কর্তৃত্বের সখ্য হয়েছে।
দেখি অনেকেই বুঝে পান না কিভাবে এত সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব আগাছার মতো গজিয়ে উঠলো।  শুভ মূল্যবোধই চর্চায় বাঁচে, আগাছার চর্চার দরকার হয় না।  শুভ মূল্যবোধের চর্চা পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে, শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিতের বোধ থেকে অপসৃত হতে থাকলে, বিপরীত চরম মূল্যবোধগুলো দ্রুত তার স্থান নিয়ে নেবেই।  যে সব প্রতিষ্ঠান বহুত্ববাদী, বৈচিত্র্য-ধারণকারী সামাজিক মূল্যবোধগুলো লালন করে, সেগুলোর খোল নলচে আমরা আমূল বদলে দিচ্ছি।  ফলে কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও চিন্তা সমাজ চেতনার স্তর ও লোক মানস পাল্টে দিচ্ছে।  রাজনৈতিক সন্ত্রাসের জন্য বিশ্বের সমস্ত প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অপশক্তিকে শুধু দায়ী করলে চলবে না, আমরা নিজেরাও দায়বদ্ধ।
জগৎ জুড়েই কাদের রাজনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে দেখুন; বাজারকেন্দ্রিক, বিতর্কিত, মানুষের মধ্যে ঘৃণা উসকে দিতে পারঙ্গম কর্তৃত্ববাদীদের। এমন জল্পনা কিন্তু ২০০২ সালেও উঠেছিল।  মনে আছে কিনা আপনাদের ফ্রান্সে সোশ্যালিস্ট প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম রাউন্ড ভোটে হারিয়ে দিয়েছিলেন এমন একজন প্রেসিডিন্সিয়াল প্রার্থী, যিনি হলোকাস্টকে বাতিল করে দিয়েছিলেন।  চরম দক্ষিণপন্থী এমন একজনের উত্থানে ইউরোপের সেদিন ‘হাহাকার’ অবস্থা।  ইউরোপ জুড়ে এদের জয়জয়কার বেড়ে চলেছে।  এখন নিজ নিজ ঝোলা খামচে ধরে আলাদা হওয়ার কাল, মেলবার নয়। উদাহরণ ব্রেক্সিট।
দুনিয়ার একনায়কদের একটু নিরীক্ষণ করলেই বুঝবেন, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকরা কোনও না কোনও জনপ্রিয় মিথ, কল্পনা বা বিশ্বাসকে আশ্রয় করে, সস্তা জনপ্রিয়তার কাঁধে চড়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। দশকের পর দশক এদেরই উত্থান চলছে।  প্রধান জোয়ারটা জেগে উঠেছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে।

ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে দু’ভাবে; সরবে, নিরবে।  ধর্মবাদী অথবা মৌলবাদী কিংবা ধর্ম ব্যবহারকারী সরকার তীব্রভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ। তাদের রাজনীতি পার্টিকেন্দ্রিক মাত্র নয়, সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় মৌলবাদী আর্থ-সামাজিক ও লিঙ্গিয় রাজনীতি।  সশস্ত্র বা পেশী ক্ষমতা প্রয়োগে সরকার গঠনে আগ্রহীরা এসব রাজনীতিকদের একনিষ্ঠ ভক্ত।  দুঃখজনক হলেও সত্য, রক্ষণশীল গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ধার্মিক, মডারেট ধার্মিক ও ধর্মীয় মৌলবাদী চরমপন্থী সব দলেই এদের আধিপত্য।

বাংলাদেশেই ধর্ম রাজনীতি কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম প্রবণতা। সন্ত্রাস প্রয়োগের মাধ্যমে প্রথাগত ধর্মনিরপেক্ষ পথ ও পদ্ধতির বিরোধিতা এখানে নানাভাবে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করছে।  বাঙালি বনাম অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, পাহাড়ি-বাঙালি, লীগ-দল, সেক্যুলার-ননসেক্যুলার, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ পক্ষ-বিপক্ষ, গণতান্ত্রিক বনাম ইসলামিক রাষ্ট্র কাঠামো এভাবে বিরোধিতাকে ক্রমাগত চাঙ্গা করে রাখছে।  বর্তমানে তা সশস্ত্র বিরোধিতায় রূপ নিয়েছে।

মডরেটগণ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠছে লোকমানসকে দলে টানার আকাঙ্ক্ষা থেকেই।  এই লোক মানস বলতে বোঝায় জনতার সেই অংশকে, যারা তথ্যপ্রবাহ থেকে দূরে বলে কম অবহিত, যুক্তিবাদী শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত, বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা স্বত্ত্বেও দার্শনিক চিন্তা ও যুক্তি চর্চার ধারায় নেই, ফলে তেমন সচেতন নয় অথবা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ।  ক্ষমতায় নেই কিন্তু ক্ষমতা ভালোবাসে এমন চরিত্রও সহজেই এদের সঙ্গে ভিড়ে যায়। 

প্রভাবের কেন্দ্র যখন অন্ধবিশ্বাস, তখন এ গণমানসকে দিয়ে যে কোনও কিছু করানো সম্ভব।  তাই কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকরা ধর্মের পাহারাদার। প্রশ্নকারী ব্যক্তি বা দলকে তারা ছাঁটাই করেন, বিরুদ্ধবাদী বলে চিহ্নিত করেন।  এক ভাস্কর্য নিয়ে রাজনীতির প্রতিবাদ করায় গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বকে পেশি ও আইন দ্বারা প্রতিহত করা, কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মী সনাতনের একটিমাত্র স্লোগানের কারণে ঘর বাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টার ভেতর এই কর্ত্বত্ববাদী রাজনীতির এক বিভৎস চেহারা ফুটে উঠেছে। 

কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকদের সমর্থকগণ সবাই নিজেরা যে কর্তৃত্ববাদী তা নয়।  মূলত তারা ঐক্য অনুভব করেন পরিবর্তনের প্রশ্নে।

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে একটি গোপন নিরব বিপ্লব ঘটেছে।  আকস্মিকভাবেই রাষ্ট্রসমূহের সামনে তা প্রত্যক্ষ।  এ পরিবর্তন অনুভবের, বোধের ও চেতনার।  তা দ্রুত ঘটে চলেছে নতুন জেনারেশনকে আশ্রয় করে।  পরিবার, সমাজ, যৌনতা, রাষ্ট্র চিন্তা, বহুজাতি সমন্বয়, নতুনকে গ্রহণের সহনশীলতা, সবক্ষেত্রেই যে পরিবর্তন ঘটছে, দেশে দেশে নবীন মানুষেরা তাকে সহজেই গ্রহণ করছে। বাংলাদেশেও। প্রযুক্তি হাতে বৈশ্বিক চেতনার অন্যতর উচ্চতায় এই জেনারেশন পৌঁছুতে চাইছে।

দুঃখজনকভাবে এদের অধিকাংশই ক্ষমতা বলয়ের বাইরে।  বাংলাদেশে এ জেনারেশন খোল নলচে পাল্টে দিতে চাইছে এমন একটি সমাজের, যার শেকড়ে কুরে কুরে খাচ্ছে দ্বিজাতিতত্ত্বের হিংস্রতা, শতাব্দী প্রাচীন ধর্মীয় কুসংস্কার ও কর্তৃত্ববাদ। 

মুক্তিযুদ্ধের পরই সবচেয়ে বড় যে সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে, এর কেন্দ্রে রয়েছে নারী এবং নতুন মানুষেরা।  যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভেঙে পড়া, বিধ্বস্ত পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নারীর উদয়াস্ত শ্রম বিশেষ করে নিহত পুরুষদের লাখ লাখ পরিবারের মেরুদণ্ডরূপে কাজ করেছে।  এই নারী ধর্মীয় মৌলবাদের অস্বস্তির কারণ। বাংলাদেশ গত চার দশকে যে প্রধান বাধাগুলোর মুখোমুখি হয়েছে তারও কেন্দ্রে রয়েছে নারী-প্রগতি ও উন্নয়ন।

এগিয়ে যাওয়া অর্থনীতি ও তার চেয়ে অগ্রগামী নারী ও পুরুষদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আনতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে।  সামরিক শাসনকালে দেশের ধর্ম পাল্টে দেওয়া হয়েছে।  পরিবারের ও দেশের অর্থনীতির দৃষ্টিতে নারী-শ্রম এক সম্ভাবনা ও সুযোগ।  যে কারণে  সরকারি বেসরকারি কলকারখানার সস্তা-শ্রম-চাহিদা, ক্রমবর্ধমান বাজার নির্ভরশীলতা, বৈদেশিক চাপ সব মিলিয়ে নারীকে বাদ দিয়ে চলা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। নারীর সার্বিক মুক্তির প্রশ্ন উচ্চকিত হওয়ার সঙ্গে ধর্মের শাসনও কঠিনতর হচ্ছে।  নারী এখন সর্বত্র আক্রান্ত যেমন আক্রান্ত মুক্তবুদ্ধি।

জন-মূল্যবোধের পরিবর্তন অর্থনৈতিক অগ্রসরতায় সদর্থকভাবেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবণতার আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব দেশে তরুণ সম্প্রদায় ফিলসফি ও বিজ্ঞানে বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে, যেখানে বামপন্থী রাজনীতি ও র‌্যাশনাল মূল্যবোধের চর্চা চলমান, দীর্ঘ সামাজিক গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেখানে মরে যায় নি, সে সব দেশেই সমাজ উদারনৈতিক হয়ে উঠছে। জনগণের ভাববিনিময়ের সুযোগ বাঁচার বাস্তব ভাবনা ও মুক্তচিন্তার মিলমিশ ঘটাচ্ছে। চিন্তার বিকাশ, মুক্ত বুদ্ধির মূল্যবোধ ও মত প্রকাশ গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের অবিভাজ্য উপাদান রূপে-নাগরিকদের কাছে বোধগম্য হয়ে উঠছে। ফলে যৌথ দেশ ও সমাজ ভাবনা পথ পরিবর্তনে উৎসাহী।

কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমতালে র‌্যাশনালিটি, ফিলসফি ও বিজ্ঞান শিক্ষা নেই। রাষ্ট্র এখন গণতন্ত্রের চর্চা সীমিত। জন-ক্ষমতায়নের উদ্যোগ সঙ্কুচিত।  কিন্তু তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা এখন প্রায় মোট জনসংখ্যার অর্ধেক।  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দ্রুতগতির কালে অস্তিত্বরক্ষার উপায় হিসেবে এরা স্বাভাবিক জৈব চেতনার তাগিদেই অন্ধ-বিশ্বাস ও মূল্যবোধ ফেলে সেক্যুলার মূল্যবোধে অস্তিত্ব রক্ষায় উদ্যোগী।

কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পায়িত সমাজে যেতে থাকা সমাজে নাগরিকের জৈব নিরাপত্তার চেতনাও এক নয়।  এখানে ব্যক্তিজীবনে ব্যাপক বদল ঘটবে, কেননা ব্যক্তি নিজেকে উত্তীর্ণ করে শিল্প থেকে জ্ঞান চেতনায়।  সমাজের অভ্যন্তরে, জেণ্ডার, জেনারেশন, এথনিসিটি, ধর্ম, শিক্ষা, আয়, ইত্যাদি মূল্যবোধের নানা স্তরে অগ্রগতি ও পিছুটানের দ্বন্দ্ব তাই ঘনিয়ে উঠছে ।

বুদ্ধির মুক্তি গণতন্ত্র প্রয়োগ-ক্ষেত্রের সীমা বৃদ্ধি করে।  সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি যদি উদার দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে তাহলে বেশি সংখ্যক মানুষ গণতন্ত্রের সুফল গ্রহণ করতে পারে।  মুক্তবুদ্ধি ও চেতনা গণতন্ত্রের অবশ্যিক শর্ত।  তা একটি দেশের জনতাকে, তার দেশের গণতন্ত্রের কোনও স্তর কিভাবে সহযোগিতা কিংবা পিছিয়ে দিচ্ছে, সে সব বিষয়ে সুক্ষ্মভাবে দেখার দক্ষতা তৈরি করে।

উন্নত দেশে মূল্যবোধ বদলের কালে নাগরিককে রাষ্ট্র সোশ্যাল সেফ গার্ড সিকিউরিটি দেয়।  তার বাঁচার নিশ্চয়তা দেয়।  বাংলাদেশে রাষ্ট্র ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে চায়।  ব্যক্তির অস্তিত্ব রক্ষায় তার পদক্ষেপ কী?

লেখক: কথাসাহিত্যিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ