X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদেরও একটি সংবিধান আছে!

রুমীন ফারহানা
১২ জুন ২০১৭, ১২:১২আপডেট : ১২ জুন ২০১৭, ১২:১৫

রুমীন ফারহানা পৃথিবীর আর সব দেশের মতই আমাদেরও একটি সংবিধান আছে। কাগজে কলমে লিখিত একটি সংবিধান। একদম স্পষ্ট আর পরিষ্কার, লিখিত বলেই কোনও অস্পষ্টতা নেই এতে। ‘লিখিত’ শব্দটি ব্যবহার করছি কারণ এমন দেশও আছে যেখানে কোনও লিখিত সংবিধান নেই, যেমন বিলেত। সেখানে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন, আদালতের রায় আর প্রথাই সংবিধানের কাজ করে। আমাদের সংবিধানের মলাটের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। বাংলাদেশের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হবে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন 'গণ' বা মানুষের কথা আসছে বারবার। আর অনুচ্ছেদ ৭(১) তো পুরো বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে বলছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক এর জনগণ। এই মালিকানা বিভিন্ন ভাবে নিশ্চিতকরনের সাথে সাথে অনুচ্ছেদ ৬৫ বলে দিচ্ছে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। জনগণ যে রাষ্ট্রের মালিক সেই মালিকানার চর্চা তারা কিভাবে করে? মালিকানার চর্চা তারা করে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাদের পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে। যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন তাই তাদের জবাবদিহিতা থাকে জনগণের কাছে। কোনও সরকার যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয় তাহলে জবাবদিহিতারও কোনও প্রশ্ন থাকে না। আর জবাবদিহিহীনতা যে কোনও ক্ষেত্রেই বড় মারাত্মক।
আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য ছোট্ট একটি সংবাদ যা ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি একজন সাংসদ মহান সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন ‘আমরা কোনও ইলেকশন চাই না। প্রধানমন্ত্রী আছেন, থাকবেন। আরও পাঁচ দশ বছর দেশ চালাবেন।’ বিভিন্ন কারণেই কথাগুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এখানে ‘আমরা’ বলতে উনি কাদের কথা বুঝিয়েছেন? জনগণ, দেশের আপামর জনসাধারণ নাকি সংসদের ৩০০ আসন আঁকড়ে থাকা সরকার ও আধা সরকার দলীয় সাংসদদের কথা? কারণ এর পরপরই আবার সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রীও একই ধরনের কথা বললেন। আমাদের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের সযত্নে লালিত কাণ্ডজ্ঞানহীন মাত্রাতিরিক্ত তৈলমর্দনের যে সংস্কৃতি, এ কথাগুলো নিঃসন্দেহে তারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সাথে হালকা মামাবাড়ির আবদার শ্রেণির ঔধ্যত্বপূর্ণ চিন্তার প্রকাশও আছে, আছে জনগণ এবং সংবিধানকে তাচ্ছিল্য করার এক ধরনের স্পর্ধা। তবে এই অতি তৈলমর্দন শুধু যে আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তাই নয় এটি সরকারি দলের যে দাবি তার সাথেও খাপ খায় না। উন্নয়নের যে মহাসড়কে বর্তমানে আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাংলাদেশ দৌড়াচ্ছে বলে তারা দাবি করে তাতে যে কোনও সময় যে কোনও অবস্থায় নির্বাচন দিলেই তাতে বিপুল ভোটে তাদের জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার কথা। সুতরাং নির্বাচন এড়িয়ে পাঁচ দশ বছর দেশ চালাবার কোন প্রয়োজন দেখি না।
আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতানেত্রীবৃন্দ সম্প্রতি কিছু বিষয় স্পষ্ট করেছেন। যেমন- ক্ষমতায় না থাকলে টাকা পয়সা নিয়ে পালাতে হবে, তারা ক্ষমতায় আছে বলে তাদের লোকজন এত কিছু করতে পারছে, না থাকলে তো পারতো না, আবার ক্ষমতায় আসতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই গ্রহণ করা দরকার, ক্ষমতায় না থাকলে অস্তিত্ব থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সম্ভবত এই সকল বক্তব্যের সারমর্ম হলো ওই সাংসদের বক্তব্য যে দেশে আর নির্বাচনের কোনও প্রয়োজন নাই। আর নির্বাচন যেহেতু প্রয়োজন নাই তাই জনগণের করের টাকায় শুধু শুধু একটি নির্বাচন কমিশন রাখারও কোনও প্রয়োজন দেখি না। তাছাড়া দেশ যেভাবে চলছে তাতে শুধু নির্বাচন কেন আরও অনেক কিছুই তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে।

দেশে খুন, ধর্ষণ কিংবা গুম যে কোনও অপরাধে সবাই এখন বিচার চায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আদালত বা জনগণের করের টাকায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তাহলে আর প্রয়োজন কি? এমন কী মাননীয় প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি বলতে বাধ্য হয়েছেন যে দেশে কোনও আইনের শাসন নেই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই এমন কী উচ্চ আদালতকেও কজ্বায় নিতে চায় সরকার। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ মতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তাও আজ বিলুপ্তির পথে।
অর্থমন্ত্রী খোলাখুলি স্বীকার করেছেন সাগরচুরির কথা, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটের বিচারে তার অসহায়ত্বের কথা। মেগা প্রজেক্ট মেগা দুর্নীতি এখন স্বীকৃত সত্য। অর্থমন্ত্রী এক পর্যায় বলতে বাধ্য হয়েছেন যে দুর্নীতি এমন একটি বিষয় যা তারা টাচই করতে পারেনি। মেগাচুরির চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো এখন মূলধন ঘাটতিতে আছে ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার যা জনগণের করের টাকায় মেটানোর চেষ্টা চলছে। বাড়ছে দুর্নীতি, কমছে বিনিয়োগ, রফতানি হচ্ছে টাকা। গত ১ দশকে টাকা পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকার মতো। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কাদের কারণে হয়, মন্দ ঝণের দাতা এবং গ্রহীত কারা, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মূল হোতা কারা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটের সাথে কারা জড়িত, টাকা পাচার কারা করে তাদের যদি আইনের আওতায় নাই আনা যায় তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজটাই বা কী? 

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য উপযুক্ত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নির্বাচন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কর্ম কমিশন দেশব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচন করে বলেই আমরা এতদিন জানতাম। আজকে খবরে দেখলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলেছেন ‘লিখিত পরীক্ষায় টেকো, চাকরি আমি দেব।’ অর্থাৎ কর্মকমিশনের যে দায়িত্ব সংবিধানের ১৪০ অনুচ্ছেদে বলা আছে তাও অনেকটা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এর আগেও একই ধাঁচের কথা বলেছিলেন সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টা। 

রাষ্ট্রের মূল যে তিনটি স্তম্ভ- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতা পৃথকীকরনের যে আবশ্যকতা (Separation of power) সেটি ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। সাংবিধানিক ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার কথা বারবার বলা হলেও কে শোনে কার কথা। যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকাই যখন মূখ্য হয়ে ওঠে যাতে নির্বাচনকেই এক প্রকার অপ্রয়োজনীয় ‘বালাই’ মনে হতে থাকে তখন সংবিধান এবং জনগণ দুটিই তার গুরুত্ব হারায়। তবে আশার কথা হলো এই যে এধরনের নৈরাজ্য যখন চরমে পৌঁছে তখন তা আসন্ন পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দিয়ে যায়। 

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ