X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ও কল্পনা তুই আয়, কুধু গেলে?’

জোবাইদা নাসরীন
১২ জুন ২০১৭, ১২:৩২আপডেট : ১২ জুন ২০১৭, ১২:৩৪

জোবাইদা নাসরীন ‘পরানে ডাগের তরে কুধু তুই গেলে… রেদোত জাগি চোঘোত ভাজে ত’ ডাগানা কানত এলে … ও কল্পনা তুই আয় না কুধু গেলে…’ ।  জাতিতাত্ত্বিক লোকায়ত জ্ঞান ও সংস্কৃতি পাঠকেন্দ্র-মৃত্তিকার উদ্যোগে মৃত্তিকা গ্রন্থকেন্দ্রে শিশু কিশোররা একুশ বছর আগে পাহাড়ের কোল থেকে অপহৃত হয়ে আজ পর্যন্ত নিখোঁজ থাকা হিল উইমেন ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে এই গানের মধ্য দিয়েই স্মরণ করছিলেন। কল্পনা চাকমার অপহরণ সম্ভবত প্রথমবারের মতো দেশের বাইরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই অপহরণ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিশ বছর পর ২০১৬ সালে তদন্ত শেষের ঘোষণা দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ এবং সে সাথে মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লোজ করে দেওয়া হয়। সাধারণত কোনও মামলার তদন্তে কিছু না পেলে মামলাটি আর এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয় সেটিকে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলে। তবে কল্পনা চাকমার স্বজন ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা রাষ্ট্রের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে খারিজ করেছেন এবং গ্রহণ করেননি মর্মে আবেদন জানান। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কিছুটা লঘু এবং সান্তনাসূচকভাবে জানানো হয় যে,  ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া গেলে বা তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হবে।
আমি এতক্ষণ যে কল্পনার কথা বলছি যে আমার বন্ধু ছিল। ছিল নয় ঠিক সারা জীবনের বন্ধু হয়েই আছে। পাহাড় সম্পর্কে বেশ কিছুটা অন্ধ আমাকে আলো দিয়েছিল। নিজ সমাজের লিঙ্গীয় বৈষম্য নিয়েই প্রথম কথা বলতে  হয় সেই ১৭ বছর বয়সী কল্পনা আমার মাথায় ঢুকিয়েছিলো। ১৯৯২ সালে লোগাং গণহত্যার পর কৈশোরের শেষভাগে মধুর ক্যান্টিনে কল্পনার সাথে আমার পরিচয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তখন বেশ সুগঠিত কিন্তু আবার কিছুটা আন্ডারগ্রাউন্ডের মতো। তবে তখনও এতো ভাঙন ধরেনি। তাদের লড়াইয়ের মেজাজে আমি মুগ্ধ এবং নিজেও আমিও বন্ধুদের সঙ্গে যাই সেই প্রতিবাদ মিছিলে। তবে মিছিলটি মৌন হয়েছিলো। সেখানেই একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, জানতে পারি মেয়েটি হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। আরও জানলাম আমরা দুইজনেই একই শ্রেণিতে পড়ি। সেই মেয়েটিই ছিল কল্পনা। মেয়েটি বলেছিলো অনেক দূরে তার বাড়ি। আমি বুঝতে পারিনি মেয়েটির ভেতর কী আগুন খেলা করছে, কী প্রতিবাদের দাবানলকে বুকে ধরে সে আছে।

পাহাড়ে ঘটতে থাকে একের পর এক নিপীড়নযজ্ঞ। সেই কল্পনার সাথেও মাঝে মাঝে পাহাড় ছাত্র পরিষদের প্রোগ্রামে দেখা হয়, আমরা পরস্পর চিঠি বিনিময় করি, তবে খুব বেশি নয়। কল্পনার চিঠি থাকতো তিন চার পৃষ্ঠার। কল্পনার লড়াই ছিল অনেকগুলো। শুধু পাহাড়ের নিপীড়কদের বিরুদ্ধেই নয়, নিজ সমাজে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও তার লড়াই ছিল, ভাবনা ছিল। সেই চিঠি পড়ে আমি ভাবতাম আমার বয়সী একটি মেয়ে কিভাবে পাহাড়ে বসে এতো কিছু ভাবতে পারে? কল্পনার ভাবনা আমার চেতনাকে শাণিত করেছিল, আমাকে সাহসী করে তুলতো।

এসে গেলো ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচন। কল্পনা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেছিলেন ইপিজেডে একটি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দিতে। অপহৃত হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে সেই সময়ে আমার সঙ্গে তার দেখা। এসেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ১১ জুন নির্বাচনের রাতে কল্পনাকে অপহরণ করা হয় রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে। অপহরণের পরদিন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন। কল্পনার অপহরণ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে তোলপাড় চলে। প্রতিবাদ ওঠে। সেই প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্মারক নং স্ব.ম.(রাজ-২) পার্বত্য ৩/৫ (অংশ) ৭/৯/৯৬ তারিখে দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট ১৯৫৬-এর ৩ প্যারার ক্ষমতাবলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু কোনও সরকারই এই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩৫ জন কর্মকর্তার হাতে ঘুরেছিল মামলা। নেওয়া হয়েছিল ৯৪ জনের সাক্ষ্য।

যেকোনও অপরাধের ঘটনা তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা। অথচ তদন্ত কমিটি আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যক্ষদর্শী কল্পনার দুই ভাই কালিন্দকুমার ও লালবিহারী চাকমার সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং খারিজ করা হয়েছে নানা ছুতায়।

একুশ বছর অতিবাহিত হলো। অপহরণের এক বছর পরে করা বহুল আলোচিত শান্তি চুক্তিতেও কল্পনার অপহরণ বা পাহাড়ে নারী নিপীড়ন নিয়ে কোনও ধারা নেই। এই বিষয়ে অনেকটাই চুপ থেকেছেন পাহাড়ি নেতারাও। যতোটুকু মনে পড়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চর্চিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঘরানার নারী আন্দোলনে কল্পনার অপহরণ প্রথম পাহাড়ি এবং বাঙালি নারী আন্দোলনের মধ্যে সেতু স্থাপন করে। সেই আন্দোলন থেকেই স্লোগান ওঠে, ‘আমাদের ধমনীতে কল্পনা চাকমার রক্ত, এই রক্ত কোনোদিন পরাভব মানেনা...’। কেমন আছে কল্পনার পাহাড়? কল্পনার পাহাড়ে আজও থামেনি নিপীড়নের সংস্কৃতি। তুচ্ছ ঘটনায় জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। চর্চিত হচ্ছে নিপীড়নের নতুন নতুন কৌশল। আমি পাহাড় দেখি, পাহাড়ের পাল্টে যাওয়া রাজনীতি দেখি,  আর এর ভেতরই দেখি আমারই ভালোবাসার বন্ধু কল্পনাকে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ