X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মওদুদরা চলে গেলে রাজনীতি কলুষমুক্ত হবে

আনিস আলমগীর
১৩ জুন ২০১৭, ১৬:৩৮আপডেট : ১৩ জুন ২০১৭, ১৬:৪৫

আনিস আলমগীর খালেদা জিয়া এ-কী কথা বললেন! ‘জনগণ সব হিসাব রাখছে। এদেরকেও ওই এক কাপড়ে বাড়ি-ঘর থেকে সবাইকে বিদায় করে দেবে।’ রাজনীতিকে বলা হয় সবচেয়ে বড় 'জুয়াখেলা'। জুয়াখেলার চাল যে বুঝে না সে হারবেই। সেটা মাথায় রেখেই কথা বলা উচিত।
আগাম হুমকি ধামকি, ভয়ের কথা যদি বলেই ফেলেন তবে ক্ষমতায় আসার পথে তো বাঁধা সৃষ্টি হবেই। প্রতিপক্ষ সাজা পাওয়ার জন্যতো আপনাকে ক্ষমতা ছাড়বে না। জনগণও আপনার প্রতিহিংসা বাস্তবায়ন করার জন্য আপনাকে ক্ষমতায় আনবে না। বেগম জিয়ার উচিত ছিল কথাটা হজম করে যাওয়া। বেগম জিয়া নিজেও বাড়ি হারিয়েছেন কোর্টের সিদ্ধান্তে। মওদুদ আহমদও উচ্ছেদ হলেন কোর্টের ফয়সালা অনুসারে।
মিডিয়ায় দেখলাম, গত ৭ মার্চ বুধবার মওদুদের গুলশানের বাড়ির দখল বুঝে নিতে রাজউকের অভিযানের মধ্যে বেগম জিয়া এই হুমকি দিয়েছেন। সাত বছর আগে আইনি লড়াইয়ে হারের পর ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াও সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। দলীয় এক ইফতার পার্টিতে তিনি সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমার বাড়িতে আমি প্রায় ৪০ বছর যাবত ছিলাম, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এক কাপড়ে। এই বাড়িতে ব্যারিস্টার মওদুদ ৩০ বছর যাবত আছেন, আজকে থেকে তাকে রাস্তায় বের করে দিয়েছে।’

সবাই এর মধ্যে জেনে গেছেন যে, গুলশান এভিনিউর যে বাড়িটি মওদুদের দখল থেকে রাজউক উদ্ধার করেছে। এক বিঘা ১৩ কাঠা জমির মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান, পরে তার অস্ট্রিয়ান স্ত্রী ইনজে মারিয়া প্লাজ এর মালিক হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ছেড়ে গেলে ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়ার অভিযোগ এনে দুদক মামলা করলে তাতে আইনি লড়াই চালিয়ে হারেন মওদুদ।

অতীতেও কিন্তু উচ্ছেদ কম হয়নি। স্বাধীনতার পর পর যে সব শহীদ পরিবারকে সরকার বাড়ি ঘর আশ্রয় দিয়েছিল ৭৫ এর পর জিয়া এবং এরশাদ সরকার তাদের অনেককে সে সব বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে। তখন সবই ছিল সরকারি সিদ্ধান্তে। স্বাধীনতার পরে অবাঙালিদের বহু সম্পত্তি হাত-বেহাত হয়েছে নকল দলিল সৃষ্টি করে। মওদুদ সাহেবের ভাইয়ের সম্পত্তিটাও অনুরূপ প্রমাণিত হয়েছে। দেশের সর্বশেষ আদালতের সিদ্ধান্তের পরে মওদুদ সাহেব একজন আইনজীবী হয়ে কী করে বলেন যে তার বাড়ির বিষয়ে সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে! খালেদা জিয়াও কী করে বলেন বিএনপি করে বলে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে! তাদের এসব কথা প্রক্ষান্তরে আদালত অবমাননার শামীল।

এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত—এমন কথা বিএনপি ঘরানার লোক ছাড়া সাধারণ মানুষও কিন্তু বিশ্বাস করে না। রাজনীতিতে আগে পরে মওদুদ সাহেব বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু বজায় রাখতে পেরেছেন জানি না তবে এ সম্পত্তির ব্যাপারে আগাগোড়া মানুষ তাকে বিশ্বস্ত বলে মনে করছে না। অনেকে বলছেন মওদুদের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি হয়েছে এ সম্পত্তির কারণে।  ত্রিশ বছর মওদুদ সাহেব এ বাড়িতে বসবাস করেছেন কেউ তার বাড়ির মালিকানা সঠিক না বেঠিক তা নিয়ে ঘাটাঘাটি করেনি। কিন্তু দুদক যখন মামলা করেছে আর বাড়ির মূল মালিক যখন বাঙালি নন তখনই মানুষের মনে কেন যেন বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে দলিলটা বুদ্ধি করে সৃষ্টি করা হয়েছে। মওদুদ সাহেব সম্পত্তিটা ভোগ করার জন্য পরিশ্রম কম করেননি। ভাগ্য খারাপ সবই পণ্ডশ্রম হয়ে গেলো।

যেহেতু মওদুদ আহমদ রাজনীতি করেন তাই তিনি বিষয়টাকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করছেন। এটা তার না করাই উত্তম কারণ এসব কথা বলে মানুষের সহানুভূতি কুড়ানো সম্ভব হবে না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটা বিষয় উপলব্ধি করেছি যে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ধীরে ধীরে মানুষের সহানুভূতি হারাচ্ছেন। আগে একজন রাজনীতিবিদ দেখলে লোকে সমীহ করতো এখন একজন মন্ত্রী দেখলেও মানুষ উপেক্ষা করে চলে। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদেরা অর্থের জন্য, সম্পদের জন্য দেশপ্রেমকে, মানব প্রেমকে তার শেষ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োগ করেছে। এ বিষয়টা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বিশেষ করে মওদুদ সাহেবদের মতো লোকদের কারণে।

১৯৭৫ সালের পর ধীরে ধীরে এদেশে রাজনীতিটাও এতো নির্মমরূপ ধারণ করছে যে রাজনীতির প্রতিও মানুষ উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। মওদুদ সাহেব রাজনীতির ব্যবসাটা রপ্ত করেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান থেকে। তিনি নাকি জিয়াউর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাহেরকে ফাঁসি দিলেন কেন? জিয়াউর রহমান তার উত্তরে বলেছিলেন, পাকিস্তান ফেরৎ সামরিক আফিসারদের প্রেসারে। অথচ কর্নেল তাহের ও জিয়াউর রহমান একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। উভয়ে সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন।

আবার ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহের মাঝে জিয়াকে প্রাণে রক্ষা করেছেন তাহের। বিচারের সময় আতাউর রহমান সাহেব ট্রাইব্যুনালকে বলেছিলেন দুনিয়ায় কোথাও পঙ্গু লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রেওয়াজ নেই। সর্বোপরি তাহের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে পা হারিয়েছেন সুতরাং তাকে ক্ষমা করে দিন। কিন্তু ক্ষমা তাহেরকে করা হয়নি। মৃত্যুদণ্ডই ছিল তাহেরের শেষ পরিণতি।

এখানে উল্লেখ করার মতো একটা বিষয় রয়েছে। তা হলো তাহেরকে যে সামরিক বিধি বলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো তা রচনা করা হয়েছিলো তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের পর। ১৯৭৫ সালের পর আরও বহু নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো- শুধু জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য। বহু সামরিক অফিসারকে অনাহুত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে সামরিক বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা শূন্য করা হয়েছিলো। হয়ত তাদের পরিবারের চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসই জিয়ার জীবনকেও অভিশপ্ত করেছিলো।

রাজনীতি আগে জনসাধারণের মঙ্গলে দায়বদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের পর রাজনীতিকে সে দায়বদ্ধতা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি থেকে দায়বদ্ধতা তিরোহীত হলে রাজনীতিও ধর্মের মতো হবে। ধর্ম যেমন সাধারণ আবেদন হারিয়ে মোল্লাদের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে রাজনীতি আর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও রাজনীতির টাউট বাটপারদের হাতে চলে যাবে। তখন মানুষের বাড়িঘর আত্মসাৎ করাই হবে রাজনীতিবিদদের কাজ।

আগে আমরা দেখেছি রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। মানুষের মন জয় করে এক প্রতিদ্বন্দ্বী অপর প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করার চেষ্টা করতো। ১৯৭৫ সালের পর প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরানোর জন্য হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নেওয়ার সংস্কৃতি শুরু হলো। ২১ শে আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় যেভাবে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল একটা গ্রেনেড যদি মঞ্চের ওপর গিয়ে পড়তো তবে আওয়ামী লীগের সব শীর্ষ নেতার মৃত্যু হতো। ৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পর, জেল হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগ টিকেছিলো। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সফল হলে আওয়ামী লীগ ৫০ বছরের জন্য হয়ত পিছিয়ে যেত।

রাজনীতিতে হত্যা করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরানোর সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল জেনারেল জিয়ার আমলেই। খোন্দকার মোস্তাক ও তার দলীয় নেতাদেরকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য মোস্তাকের বায়তুল মোকাররাম এর জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। গ্রেনেড মঞ্চে না পড়ে ময়দানে পড়েছিল। ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিল ১১ জন লোক।

দেশের মানুষ অভিমান করে রাজনীতি বিমুখ হলে চলবে না। মানুষকেই সক্রিয় হয়ে রাজনীতি থেকে এসব টাউট, বাটপার হটিয়ে রাজনীতিকে জঞ্জাল মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। আর সবার আগে মওদুদের মতো লোকেরা চলে গেলেই রাজনীতি কলুষমুক্ত হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ