X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাশের ভারে পাহাড়ে কান্না!

চিররঞ্জন সরকার
১৪ জুন ২০১৭, ১৬:১৮আপডেট : ১৪ জুন ২০১৭, ১৬:২০

চিররঞ্জন সরকার বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ সমাগত। কর্মজীবীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঈদে ঘরে ফেরার। আর পরিবারগুলো প্রস্তুত হচ্ছে সাধ্যমত এই উৎসবকে রঙিন করার। সেই সময় দেশের পাহাড় অধ্যুষিত এলাকা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আকস্মিক নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যাগে বিপন্ন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ! অবশ্য এই দুর্যাগ এখন আমাদের অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে। বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল, ইছালে ছওয়াব, জব্বারের বলি খেলার মতো পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যুও এখন আমাদের দেশে নিয়মিত বাৎসরিক একটা ‘উৎসব’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রতি বছর জুন-জুলাই এলে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। আর এই অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি এলাকায় মাটি আলগা হয়ে ধসের ঘটনা ঘটে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মৌসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টিতেই পাহাড়-ধসের ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যেই প্রায় শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহাণির খবর পাওয়া গেছে। শত শত পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
পার্বত্য জেলাগুলোয় প্রতিবছরই লাশের ভারে পাহাড় কাঁদে। সেই কান্না আমাদের প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছায় বলে মনে হয় না। এ পর্যন্ত পাহাড় ধস এবং প্রবল বর্ষণে পার্বত্যাঞ্চলে যে মৃত্যুর মিছিল আমরা দেখেছি তার পেছনে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক গাফিলতিই মূখ্য। পাহাড় ধসের মূল কারণগুলো বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ গত এক যুগেও নেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনায় যারা হতাহত হতে পারে, তাদের জন্য বিকল্প আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি। সেখানে সতর্কবার্তা হিসেবে মাইকিং করলেও ভুক্তভোগীদের বিকল্প কোনও মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় তারা ঘর ছাড়েনি। এ কারণে তাদের ফি বছর দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় ধসের মূল কারণ হলো পাহাড় থেকে মাটি কাটা, পাহাড়গুলো ৩০ ডিগ্রির বেশি ঢালু হলে সে পাহাড়ের পাদদেশে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়। পার্বত্য জেলাগুলোয় রয়েছে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত অসংখ্য ঢালু পাহাড়। মাটির জমাট বাঁধা পাহাড় যখন কাটার মহোৎসব চলে তখন প্রবল বর্ষণ হলে মাটির ওপরের আবরণ না থাকায় যে প্রবল জলধারা নিচে ধাবিত হয় তার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মাটি এসে পাহাড়ের পাদদেশে আছড়ে পড়ে। আর তখনই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। ২০০৭ সালের ১১ জুন লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। স্মরণকালের ভয়াবহ এই মর্মান্তিক ঘটনার পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠন করা হয়েছিল শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। ওই কমিটি পাহাড় ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করে যে ৩৬টি সুপারিশ প্রদান করেছিল। এছাড়াও পাহাড় ধস ও পুনর্বাসনে কারিগরি কমিটিসহ একাধিক তদন্ত কমিটি অর্ধশত সুপারিশ করেছিল।
সেই সময় পাহাড় ধসের কারণ হিসেবে ভারী বর্ষণ, পাহাড়ের বালির আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণে দুর্বলতাকে চিহিৃত করা হয়েছিল। আর উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে ছিল পাহাড়ে জরুরি বনায়ন, গাডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেয়া, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি। কিন্তু এক দশক পরও সেই সুপারিশমালার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। এতে পাহাড় ধস ও মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যায়নি।  আর সে কারণেই এবারও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল।

তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি ও সেটেলার জনগোষ্ঠী, কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বস্তিবাসী মিলে কয়েক লক্ষ মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্ষা মৌসুম এলেই তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড় ধস আতঙ্ক। কিন্তু তাদের পুনর্বাসন ও যথাযথভাবে পাহাড় রক্ষা করে ভূমি-ধস ঠেকানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ গত এক যুগেও লক্ষ করা যায়নি। নিয়তির জালেই যেন পাহাড়ের মানুষের জীবন বন্দি!

পাহাড়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিবাণিজ্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কর্তাব্যক্তিদের অবহেলা, দ্রুত নগরায়ন এবং মানুষের পরিবেশ বিধ্বংসী মনোভাব। তবে পাহাড় ধসের পেছনে রাষ্ট্রীয় নীতিও কম দায়ী নয়। এক সময় আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করতে পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে সমতল থেকে মানুষজন এনে জনবসতি গড়ে তোলা হয়। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে জমি, রেশন ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করা হয়। এই অভিবাসী জনগোষ্ঠীর চাপ দিন দিনই বেড়েই চলেছে। তারা জীবন-জীবিকার স্বার্থে নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। গাছ কাটা, পাহাড় কাটা, আবাদি জমি বের করা ইত্যাদি কারণে পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে।

আদিবাসীরা প্রকৃতির সন্তান। তারা জানে প্রকৃতিকে অবিকৃত রেখে কিভাবে সেখান থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু সেটেলার বা অভিবাসীদের সেই অভিজ্ঞতা নেই। তারা সমতলের মানুষ। তাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে সমতলের সংস্কৃতি। তারা কেটে, গর্ত করে বা ভরাট করে পাহাড়ি ভূমিকেও সমতল বানাতে চায়! এতে করে পাহাড়ের, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে দ্রুত। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হচ্ছে ভূমি ধস। পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ, উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির কারণেও আজ পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ।

একটি জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখার সংকীর্ণ কূটরাজনীতি, অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, এক শ্রেণির মানুষের অসাধুতা, দুর্নীতি, লোভ, প্রকৃতির প্রতি বিরুপ আচরণ- সব মিলিয়ে পাহাড় ধস এখন আমাদের বাৎসরিক দুর্ঘটনার কারণে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সহ্য সীমায় আঘাত করা হয়। আর এর প্রত্যাঘাতে  জীবন যায় নিরীহ মানুষজনের।

পাহাড় ধসের কারণে গত ৫ বছরে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত পাঁচশ মানুষ। শোকের পাশাপাশি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঝরে পড়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতিক্রিয়ায়। এই প্রতিক্রিয়া যেন তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ না হয়। আমরা যেন এই লাশগুলো সমাহিত হওয়ার আগেই ক্রিকেট নিয়ে মাতোয়ারা না হই। ক্রিকেটের অর্জন নিয়ে আমরা অবশ্যই মাতোয়ারা হবো। তবে মানবতার দাবিকে অগ্রাহ্য করে নয়। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক উদাসীনতা সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। এবার ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে বনখেকো, পাহাড়খেকো, খালখেকো ও নদী খেকো সংঘবদ্ধ চক্রের কালো হাত। আসুন, আজ সংঘবদ্ধ ভাবে আওয়াজ তুলি: দখলদারদের লোভকে চরিতার্থ করতে দরিদ্র, বস্তিবাসীদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। বন ও পাহাড় ধ্বংস করে যারা মুনাফা লুটতে চায় তাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। পরিবেশকে পুঁজি করে যারা টাকার পাহাড় গড়তে চায় জনসমক্ষে তাদের মুখোশ খুলে দিই। এ ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ না নিলে তাদেরও হিসেব চুকিয়ে দেওয়ার হিসেব শুরু করি!

কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃত্যুকূপ থেকে পাহাড়ের মানুষকে রক্ষা করা হবে, এটাই জনপ্রত্যাশা। প্রতিবছরই আমরা মাটি-চাপা লাশ দেখে আহা-উহু করছি তো করছিই! সেই কান্নার আওয়াজ যেন কিছুতেই ঢুকছে না দায়িত্বশীলদের কর্ণকুহরে। এবার অন্তত কিছু একটা করুন! না হলে সাফ জানিয়ে দিন, শোকবার্তা প্রদান ছাড়া পাহাড় ধসে মৃত্যু ঠেকাতে এদেশের সরকার ও প্রশাসনের আসলে কিছুই করার নেই!

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ