গতকাল ছিল বাংলাদেশ ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ। খেলা হয় ঢাকা থেকে আট হাজার কিলোমিটার দূরে। বাইশ গজের ক্রিজে খেলেছে বাইশ জন খেলোয়াড়, যাদের এগারোজন বাংলাদেশের। সন্দেহ নেই, সামর্থ্য সম্ভাবনা সুযোগ সব কিছু মিলিয়ে সবকিছু উজাড় করে খেলেছেন এই এগারোজন। অথচ প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে খেলে গেলাম আমরা ১৬ কোটি মানুষ, অবশ্যই মাঠের বাইরে। কোনোদিন যে ক্রিকেট বলটা হাতে নিয়েও দেখে নাই। একটা ক্রিকেট ব্যাটের ওজন কতটা, যার জানা নেই, সেও বোদ্ধা হয়ে ওঠে। ক্রিকেট ম্যাচের আগে। খেলা আর খেলা থাকে না। খেলা হয়ে ওঠে রাজনীতি। খেলা আর আনন্দের থাকে না। খেলার সাথে ছড়ায় ঘৃণা। তুমুল ঘৃণার এক পর্যায়ে বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। গতকালকে যে ভারতের বিপক্ষে ঘৃণা ছড়ানো হলো। আগামীকাল পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের খেলা হলে তখন সমর্থন পাবে কে?
দুইটা দলকেই আমরা যথেষ্ট ঘৃণা করে ফেলেছি। কিন্তু আবার ক্রিকেট পছন্দ করি। তাইলে যখন দুই ঘৃণিত দল মুখোমুখি, তখন আমাদের অবস্থান কী হবে ? আমরা খেলা দেখবো। কেউ পাকিস্তান কেউ ভারতকে সমর্থন দেব। যে ভারতকে কাল ঘৃণা করলাম আগামীকাল তাকে সমর্থন দিতে দ্বিধা হবে না! যেমন দ্বিধা হয় না অনেকের পাকিস্তানকে সমর্থন করতেও। ফাইনাল খেলবে মাঠে ভারত পাকিস্তান। আর ঘৃণা ছড়াবে এক দলের সমর্থক আরেক দলের বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত খেলা কোথায়? কোথায় নিছক বিনোদন? পুরাটাই কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা। বিভক্ত হয়ে যাওয়া, নিজেদের ভেতর। খেলা থেকে রাজনীতি, রাজনীতি থেকে ধর্ম, ধর্ম থেকে সংস্কৃতি কোথায় আমাদের বিভক্তি নেই? বলতে কষ্ট হয়, মানতে আরও বেশি কষ্ট হয়। কিন্তু সত্য হলো আমরা শতবিভক্ত। সর্বত্র আমরা বিভক্ত।
খেলার প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করি। দেখছিলাম ফেসবুকে লাইভ। খেলার সঙ্গে দেখা যায়, দর্শকদের মন্তব্য। সৌম্য সরকার আউট হওয়ার আগে থেকেই আসছিল অশ্লীল মন্তব্য সৌম্যকে নিয়ে। নানারকম কটাক্ষ। এবং অবধারিতভাবেই সৌম্যের ধর্ম এখানে একটা ইস্যু! এই যে ঘৃণার বীজ বুনেছিল, ব্রিটিশেরা সেখান থেকে আজও আমরা বের হতে পারিনি। বরং বাড়িয়ে দিয়েছি। এই ফাঁকে কেউ কমেন্ট করলো, ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’। শুরু হয়ে গেলো একের পর এক আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ। কেন নোয়াখালী বিভাগ হবে এবং কেন হবে না এই নিয়ে নোয়াখালী এবং এন্টি নোয়াখালী গ্রুপের বাক বিতণ্ডা। যদিও কিনা আমরা দেখছিলাম চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমি ফাইনাল!
মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুব ভালো একটা ব্যাপার। কিন্তু মতের প্রকাশ মানে কুতর্ক নয়। মানুষকে নাজেহাল করা নয়। বিদ্বেষ ছড়ানো নয়। আমার মতের সাথে গেলো না বলেই, তুমি ডাবল জিরো রসগোল্লা। তোমাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবো তা তো নয়। অথচ এটাই হচ্ছে। হচ্ছে অনলাইনে, অফলাইনে, শহরে গ্রামে, নারীতে পুরুষে সর্বত্র। একটা গল্প বলি। একেবারে ওভেন ফ্রেশ এবং নিজের চোখে দেখা। বছর পয়ত্রিশের এক দিন মজুর। একেবারে গ্রামে তার বসবাস। শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হয় সব সময় সেজন্য ততটা সুস্থও না। বিয়ে করেছিল ভালোবেসে অন্য ধর্মের মেয়েকে ধর্মান্তরিত মুসলিম করে। নিতান্তই অভাবের সংসার। একটা মেয়ে কিছুটা প্রতিবন্ধী। কিশোর বয়সী ছেলেটা সিগারেট গাঁজা থেকে শুরু করে ইয়াবা সব কিছুতে আসক্ত। কারণ গ্রামে এখন এইগুলা খুব সহজলভ্য। এইরকম টানাটানি, সমস্যা সঙ্কুল পরিবারে তার ধর্মান্তরিত বউ এখন অতি ধার্মিক। সেই অতি ধর্মের চর্চা করে তার স্বামীর ওপর। এমন বাড়িতে যাওয়া যাবে না, খাওয়া যাবে না যেখানে রান্নার লোক নামাজ পড়ে না। গরিব মানুষ, পেটে ক্ষুধা। যেখানে কাজ সেখানে খাওয়া। তার দেখার সময় নেই, কে নামাজ পড়ে কে পড়ে না। তাতে কী? কিছুদিন আগে খবর পেলাম সেই লোক আহত। কী হয়েছে? অতি ধার্মিক বউ তাকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। কারণ সে ধর্ম মানছে না। এই যে উগ্রতা। যেটা বলছিলাম- ধর্মের নামে, সংস্কৃতির নামে অসহিষ্ণুতা। বদলে যাচ্ছে সহিংসতায়। পরিবারে, সমাজে এবং বৃহৎ অর্থে রাষ্ট্রে। ইদানিং এরকম ভুলভাল অপব্যাখ্যা চালু হচ্ছে দেদারছে। লাভটা হচ্ছে কার? জানি না। তবে ঘৃণা যে ছড়িয়ে যাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছি। যারা সংখ্যায় বেশি আপাত দৃষ্টিতে তারা জিতে থাকছি, মনে হচ্ছে। কিন্তু আসলে কি জিতছি?
খুব সুক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল চেলে, বহু ব্যয় করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য জনসংহতি সমিতির পাল্টাপাল্টি আরেকটা গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। যেই বিভেদে পাহাড়িরা বিভক্ত হয়েছে। পাহাড়িদের মধ্যে স্বার্থান্বেষী মানুষ তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি পাহাড়িরা ঘৃণা করতে শিখেছে। এখন তারা কাদের ঘৃণা করছে, জানেন? আপনাকে ঘৃণা করছে, আমাকে ঘৃণা করছে। সাজেক বা নীলগিরি বেড়াতে গিয়ে আপনি যে দৃশ্য দেখছেন, যাদের সাথে মিশছেন। সেটাই পুরাটা না। ভেতরে ভেতরে তাদের বয়ে যাচ্ছে ঘৃণার অগ্নিগিরি। যেটা একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছে পাকিস্তানিদের। এখন পাহাড়িরা করছে আমাদের। পাকিস্তানের আদি পুরুষরা জিন্নাহ, আইয়ুব খান, ভুট্টোরা যে প্রক্রিয়ায় বাঙালিদের ভেতর ঘৃণার বীজ বুনে দিয়েছিল। সেই একই প্রক্রিয়ায় এখন আমাদের শাসকেরা পাহাড়ে ঘৃণা রোপন করছে। যে ঘৃণার প্রকাশ দেখা যায়, সাম্প্রতিক পাহাড় ধ্বসের ঘটনায়। শতাধিক মৃত্যু, দুর্যোগকালীন অবস্থা চলছে। সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সৈনিকরা যারা মারা গেলো, তাদের যারা আত্মীয় পরিজন, বন্ধু, স্বজন তারা হাহাকার করছে। আবার উল্টা দিকে একই ঘটনায় উল্লাস প্রকাশ করছে কিছু পাহাড়ি চরমপন্থী। সমতল বা পাহাড় কোনও খানেই আর মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। দেখা হচ্ছে প্রতিপক্ষ হিসেবে।
ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করছি। নতুন নতুন মাসালা আবিষ্কার হচ্ছে। বিদ্যুৎগতিতে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী দরিদ্র সবার ভেতরে। কিন্তু ধর্মের মূল থেকেও সরে যাচ্ছি। কোনও ধর্মই আমাদের ঘৃণা করতে শেখায় না। কোনও ধর্মই আমাদের প্রকৃতি ধ্বংস করতে শেখায় না। সুনির্দিষ্টভাবে যদি ইসলামের কথা বলি। পবিত্র কোরআনে বলা আছে ‘তিনি (আল্লাহ) পৃথিবীতে পর্বতমালা বসিয়েছেন, জমিনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য’ (সূরা লোকমান, আয়াত ১০-১১)। অথচ আমরা পাহাড় কাটছি নির্বিচারে, তখন কোথায় ধর্ম? কাটা পাহাড় ধ্বসে মানুষ মরে যাচ্ছে, তখন কোথায় মানবতা? কোথায় একতা? বরং পাহাড়ি, বাঙালি, আদিবাসী, সেটেলার, সেনাবাহিনী নানাভাগে ভাগ করে ফেলছি মৃতদেহও। ভাগে ভাগে মিশে থাকছে হিংসা, দোষ। ভুলে যাই দিন শেষে আমাদের ভূখণ্ড একটাই। আমরা সবাই মানুষ।
জন্ম থেকেই বাংলাদেশের একটাই সম্পদ ছিল, তা হলো একতা। যেই একতা আমরা সর্বশেষ প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৭১ সালে। কোথাও কোনোদিন কোনও গবেষণা হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটা আমার মাথায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তা হলো স্বাধীনতা পরবর্তী এদেশের ইতিহাসে অনেক উত্থান পতন হয়েছে। আমরা এখন বুঝতে শিখেছি এগুলো অনেকটাই ছিল বৈশ্বিক রাজনীতির কূটচাল। তাহলে এদেশের মানুষের একতা নষ্ট করার জন্যও কি কোনও খেলারাম পেছন থেকে খেলে গেছে ইউরি বেজনেভের গেম অব সাবভার্সন? আমরা যেটা টেরই পাইনি। শুধু খেলার পুতুল হয়ে নেচে গেছি রঙিন মঞ্চে?
লেখক: উন্নয়নকর্মী