X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘ইনলাকেশ’ ঈদ

শুভ কিবরিয়া
২৩ জুন ২০১৭, ১৬:৪১আপডেট : ২৩ জুন ২০১৭, ১৬:৪৪

শুভ কিবরিয়া দেখতে দেখতে আবার ঈদ চলে এলো।  আবার সেই মহাউৎসবের আমেজ।  আবার প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হওয়ার অপার আনন্দের উদযাপনের প্রিয় মুহূর্ত প্রায় সমাগত।  ক্রমেই খালি হয়ে পড়বে ব্যস্তসমস্ত এই রাজধানী।  এখন উপচে পড়বে ঢাকার বাইরের সড়ক-মহাসড়ক।  বাস-ট্রেন-লঞ্চ-রেলগাড়ি সর্বত্রই এখন ঈদমুখী মানুষের ভিড়।  ঘরে ফেরার তাড়া মানুষের।  কে কাকে আগে ফেলে কত তাড়াতাড়ি নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে পারে সেটারই যেন প্রতিযোগিতা।
প্রতিবারের মতো এবারেও নিশ্চয় আমরা দেখবো সেই একই চেহারা , রাস্তায় মানুষের দুর্ভোগ। মানুষের অপার কষ্ট।  প্রতিবারের মতো এবারও হয়তো একই দুর্দশার চিত্র দেখা যাবে সর্বত্রই। কেননা একই সময়ে এতো মানুষের চাপ সইবার মতো সড়ক-রেলপথের সক্ষমতা নেই আমাদের। পরিবহন নেই আমাদের।  প্রশাসনের সক্ষমতাও নেই সেইহারে।  একই সময়ে এতো মানুষের চাপ সইবার যে মানসিক সক্ষমতা দরকার সম্ভবত সেটাও নেই আমাদের।  তাই হৈ চৈ যতই হোক না কেন, সরকারের পক্ষে যতই আওয়াজ তোলা হোক না কেন, যোগাযোগ মন্ত্রী যতই আশ্বাস দিন না কেন, জনতার পক্ষে আমরা যতই আবদার করি না কেন, ঈদমুখী মানুষের দুর্ভোগ যে কমবে তা মনে হয় না।  শুধু প্রার্থনা এ্টুকু রাস্তায় দুর্ঘটনা আর প্রাণহানি যেন না ঘটে।  সময় যতই লাগুক মানুষ যেন সুস্থ্যভাবে শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
২.
এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে, এই বিপুলতর গণতন্ত্রহীনতার দেশে, এই ভঙ্গুর সুশাসনের দেশে শেষ ভরসা কিন্তু মানুষই।  মানুষ যদি একটু সহনশীল হয়, একটু পরার্থপর হয়, একটু অন্যের জন্য নিজের জায়গাটা ছেড়ে দেওয়ার মনটা তৈরি করতে পারে তাহলে হয়তো আমাদের জীবনটা আরেকটু সহনশীল হতে পারে।  মনে রাখতে হবে আমরা যখন লাখে লাখে মানুষ ঘরে ফিরছি, প্রিয়জনদের কাছে যাচ্ছি তখন পাহাড়ে অসংখ্য মানুষ প্রিয়জনের মৃত্যু সহ্য করে অপ্রতিরোধ্য দুর্দশাময় জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।  তাদের শুধু প্রিয়জনই হারাতে হয়নি, হারিয়ে গেছে নিজস্ব আবাসটুকুও।  হারিয়ে গেছে অনেকের ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থাটুকুও।  শোক-যন্ত্রণা আর অন্ধকার ভবিষ্যত নিয়ে হতাশ-বিপর্যস্ত এই মানুষগুলোর জীবনেও ঈদ এসে দাঁড়াবে ঠিকই কিন্তু তা কি তাদের মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি দেবে? ঈদের নামাজে দাঁড়িয়েও কি ভেসে উঠবে না তাদের প্রিয়তম স্বজনের মুখ?
আমরা যারা সৌভাগ্যবান, যারা এইরকম দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণার বাইরে আছি তাহলে তাদের কর্তব্য কী?
৩.
এই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা অনুপ্রেরণাদায়ক কথার উল্লেখ করি।  কথাটা জেনেছি পত্রিকা মারফত।  এক অভিনেত্রীর বরাতে।  ব্রিটেনের এই অভিনেত্রীর নাম হেলেন মিরেন।  অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রী গিয়েছিলেন আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায়।  সেখানেই তিনি এই কথাটির উল্লেখ করেছেন।  মায়া সভ্যতার বিদ্যা থেকে কথাটি তিনি পেয়েছেন বলে জানান। কথাটি একটি প্রবাদ।  প্রবাদটি হচ্ছে স্থানীয় ভাষায় -‘ইনলাকেশ’।
এর অর্থ হোল-, ‘তুমিই আমি’।  আমিই তুমি।  আমরা এক। ’
কথাটির ব্যাপ্তি টেনেছেন হেলেন মিরেন এভাবে, ‘আমি যদি তুমি হই, তাহলে তোমার প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব আছে।  আবার তুমি যদি আমি হও, তাহলে আমার প্রতিও তোমার কিছু দায়িত্ব আছে। ’
সমাবর্তনে আগত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এই কথাটি উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ‘এখানে আমরা সবাই এক’-এ কথাটাই মায়ানরা আরও সুন্দর ভাষায় বলতে চেয়েছেন।
এই পৃথিবীতে আমরা সবাই একসঙ্গে আছি, কথাটি মনে থাকলে হয়তো আমাদের সবার জন্যই অনেক দুর্যোগ আর বিপত্তি মোকাবিলা করা সহজ হতে পারে।
৪.
মায়ান সভ্যতার এই কথাটি আমরাও ব্যবহার করতে পারি আমাদের জীবনে।  বাজার অর্থনীতির এই যুগে ক্রমাগত সমষ্টির কল্যাণ কামনা থেকে দূরে সরে এসে আমরা যে একক ব্যক্তিনির্ভর কেবলই ‘আমার’ চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছি সেইটা একটা ক্ষুদ্রতর চিন্তা।  সেই ক্ষুদ্রভাবনা থেকে যদি আমরা না সরতে পারি তবে বৃহত্তর মঙ্গল অসম্ভব।  আর বৃহত্তর মঙ্গল না হলে ‘ক্ষুদ্র-আমি’রও সেইভাবে কল্যাণ অসম্ভব।
ঈদ আমাদের সেই বৃহত্তর কল্যাণ কামনার একটা উপলক্ষ্য হতে পারে।  রমজানের একমাস যে সিয়াম সাধনার শেষে মানুষ এই আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে সেই সাধনার অন্তর্নিহিত বিষয়টিও কিন্তু তাই, অন্যের জন্য অনুভব।  ক্ষুধা -পিপাসার কষ্ট বুঝে মানুষ যেন নিরন্ন-অনাহারি মানুষের দুঃখ বুঝতে পারে।  অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে অনুভব করতে পারে।  যেনো ‘আমি’- ‘তুমি’ হয়ে উঠতে পারে।
৫.
এই ঈদযাত্রায় আমরা সবাই যদি ‘ইনলাকেশ’ হয়ে উঠতে পারি, অন্যের প্রতি আরেকটু সহনশীল হয়ে উঠতে পারি তবে হয়তো পথকষ্ট আরেকটু কমতে পারে।  ঈদযাত্রার এই ভীড়ে আমরা যদি শিশু, নারী, বৃদ্ধদের প্রতি আরেকটু সহমর্মিতা দেখাতে পারি তবে এই যাত্রা কষ্টকর হলেও সবার জন্য হয়তো সহনীয় হয়ে উঠতে পারে।  পরিবারের অন্যদের সাথে নিজের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে তো আমরা ঘরে ফিরতে পাগলপ্রায়, মরিয়া।  পথে যাদের সাথে যাচ্ছি তাদের যদি বড় পরিবারের সদস্য হিসাবে মনের মধ্যে ঠাঁই দিতে পারি তাহলে পথেই হয়তো আরেকটা বাড়তি ঈদ আনন্দ মিলতে পারে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ