যারা নগরের মানুষ হিসেবে বাস করেন তাদের একটা স্বপ্ন থাকে ঈদে বাড়ি যাওয়ার। হয়তো বাবা-মা অপেক্ষা করে আছেন সন্তানের জন্য, বোন ভাইয়ের জন্য, পরিবার পরিজন সবারই অপেক্ষা থাকে। আবার এমনও হয় কেউ হয়তো শেষ বাড়ি গিয়েছেন সেই গেলো ঈদুল আজহার সময়। এই ঈদ এর সঙ্গে যেহেতু নতুন জামা-কাপড়ের একটা অনুষঙ্গ থাকে সে কারণে সবাই সাধ আর সাধ্যের মধ্যে প্রিয়জনের জন্য কিছু না কিছু কিনে নিয়ে যান। তো এই যে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে ট্রেন, বাস, লঞ্চ, বিমানে ছুটে চলা মানুষের এই যাত্রা নির্বিঘ্নে করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের। যেহেতু সে রাষ্ট্রের নাগরিক। কিন্তু রাষ্ট্র কি এবারের ঈদ যাত্রায় সেটা পেরেছে? বলা যায় মোটামুটি পেরেছে। ঈদের আগাম টিকিট বিক্রির হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ২১ জুন থেকে যদি ঈদ যাত্রা শুরু হয় তবে ২৪ জুন পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সেগুলো আলাদা আলাদাভাবে। আবার প্রতিদিন সড়কপথে দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। এমনও হয়েছে ছয় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টায়। সড়কপথে দুর্ভোগের চিত্রটা যেন বেশি। এ নিয়ে আলোচনা করছি শেষে।
এবার স্বস্তি ছিল না বিমানে। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি সিডিউল বিপর্যয়তো ছিলই। এর মধ্যেও কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩০ হাজার লোক দেশ ছেড়েছেন ঈদ উদযাপনে। বিমানের হিসাব আলাদা এবং সমাজের একটি শ্রেণির জন্য।
নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খান ঘোষণা দিয়েছেন, এবারে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ঈদের আগে ও পরে মোট দশ দিন বালুবাহী নৌ-যান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া হয়েছে এবং এসব তদারকি করার জন্য সত্যিকার অর্থে যেন কেউ ছিল না। (মন্ত্রী নিজে চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন) এক লঞ্চ মালিককে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করাতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং বলেছেন মানুষ ঠেকানো তার কাজ নয়, এসব দেখার জন্য প্রশাসন রয়েছে। কিন্তু আসলে কি প্রশাসন দেখে? না! তারা দেখেও না দেখার ভান ধরে থাকে। ফলে গাদাগাদি লোক নিয়ে ছেড়েছে প্রতিটি লঞ্চে। তবে আশার কথা এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।
রেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সিডিউল বিপর্যয়তো ছিলই। ছাদে করে হাজার হাজার মানুষ বাড়ি ফিরেছে। টিকিট কালোবাজারী হয়েছে। রেলের স্বয়ংক্রিয় সংকেত নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিটি বগির আসন আর অভ্যন্তরে ছাড়াও ছাদেও ঘরমুখী মানুষের ভিড়। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে না উঠতে কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশন কর্তৃপক্ষ মাইকে সতর্কবাণী দিলেও তা মানছেন না কেউ। বগির ভেতরের চেয়ে বাইরেই যাত্রীসংখ্যা বেশি। এরপরও প্রথম কয়েকদিনের তুলনায় শেষের দিকে এসে ট্রেনযাত্রা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।
এবারে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের আশঙ্কা করা হয়েছিল সড়কপথে। খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ঈদ যাত্রা খুব একটা স্বস্তির হবে বলে মনে হচ্ছে না। ’ তবে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন রাস্তায় পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য। আশার কথা বৃষ্টি অব্যাহত ছিল না এবং ২৪ জুন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী গাবতলীতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বিগত ১০ বছরের তুলনায় এবারের পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ’ এবার দেখা যাক কতটা সহনীয় ছিল পরিস্থিতি। গেলো কয়েকদিনে যতো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, গাড়ি উল্টে যাওয়া, ফিটনেস বিহীন গাড়ি, যানবাহন বিকল হয়ে যাওয়া, চালকের ঘুম ও সহকারীর গাড়ি চালানো। যানবাহন বিকল হলেও তা সরিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগা। আমাদের দেশে যে গাড়ি টানার রেকারগুলো রয়েছে সেগুলোতে টানা যায় ২০ টনের মতো। কিন্তু অনেক গাড়ির ওজন ৪০ টনও ছাড়িয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ যানজট ও গাড়ি ধীরগতি চলার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, উল্টো পথে গাড়ি আসা, চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ, বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ, পথে পথে যাত্রী উঠানো, বিভিন্ন মোড়, টোল আদায়ে ধীরগতি। লোকাল বাস বা মিনিবাস মহাসড়কে চলা, রাস্তার ওপরে বাজার, মার্কেট, ফুটপাত দখল করে ব্যবসা। এবার দেখা যাক, গেলো কয়েকদিনে ঘরমুখী যাত্রীরা রাস্তায় কী কী ধরনের সমস্যার সন্মুখীন হয়েছেন। রাস্তা চার লেইনের হলেও কাচপুর আর মেঘনা সেতু চলছে দুই লেইনে। এর কারণ সেতুতে কাজ হচ্ছে। অথচ সড়ক ও জনপদের হিসেব অনুযায়ী, এই পথে সাধারণ সময়ে গড়ে প্রতিদিন ১৩ হাজার গাড়ি চলাচল করে। সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে হাটিকামরুল পর্যন্ত যানবাহনের দীর্ঘ সারি ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। কারণ নলকা সেতুর কার্পেন্টিং ওঠে গেছে আর ধোপাকান্দি সেতুর রেলিং ভেঙে গেছে। গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহের চড়পাড়া পর্যন্ত প্রায় অনেক স্থানেই স্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে বাস, ট্রাক, রেন্ট এ কার, সিএনজি অটোরিক্সা, লেগুনা ও পিকআপ স্ট্যান্ড। এছাড়া রয়েছে ভাসমান দোকান ও বাজার। এগুলো যানজটের অন্যতম কারণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি, ঢাকা-ময়মনসিংহের গাজীপুর ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুরে ঈদযাত্রার প্রতিদিনই যানজটে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সব মিলিয়ে গাড়ি, টিকিট, যানজট, জনজট, রোদ আর গরমে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। এরপরও যেতে হবে বাড়ি। কিন্তু এতো হঠাৎ করেই আসা কোনও বিপর্যয় নয়। চাইলেই হয়তো এর প্রতিকার করা যেতো। কারণ এ ধরনের অবস্থা প্রতিবছরই নির্দিষ্ট সময়গুলোতে হয় তাই এর প্রতিকার অসম্ভব বলে মনে হয় না যদি সেই ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকে।
আমরা সমস্যা শুরু হলে প্রতিকার শুরু করি। যেমন, লোকজন বাড়ানো, পুলিশ নামানো, রাস্তার কাজ বন্ধ রাখা এসব। এ যেন কোনোমতে ঠেকার কাজ চালানো। কিন্তু গেলো দশ বছরের ডাটা নিয়ে যদি আমরা বিশ্লেষণ করতাম, কোন সময়ে কোথায় সমস্যাগুলো হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং সমস্যা চিহিৃত করার সাথে সাথে যদি প্রতিকারে নেমে পড়া যেত তবে এই দুর্ভোগ হতো না। এই সময়টাতে কত মানুষ বাড়লো, যানবাহন বাড়ালো, রাস্তা বাড়লো সবকিছু নিয়েই সমাধানের পথে এগুতে হবে। ভালো গাড়ি, দক্ষ চালক ও ভালো রাস্তার কেন বিকল্প নেই। ঈদ এলেই তড়িঘড়ি করে রাস্তা মেরামতের কাজে নামা হয় কিন্তু এসবতো আগেই করার কথা রয়েছে। প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠিন তৎপরতা। এমনও অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এলে এরা অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু পরে দেখা যায় ঢিলেঢালা ভাব।
ডিজিটালাইজেশনের কথা বলি, কিন্তু আমাদের টোলপ্লাজাগুলো এখনও ডিজিটাল হয়নি। রাস্তা মোটাতাজাকরণ করলেই হবে না এবং সঙ্গে সেতুগুলোও মোটা করতে হবে। রাস্তা চারলেন কিন্তু সেতু দু’লেনই যানজট হবেই। বিশেষ সময়গুলোতে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের একই দিনে ছুটি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ ঈদে বাড়ি যাওয়ার একটা বিশেষ অংশ শ্রমিকরা। তবে স্কুল-কলেজগুলো বেশ আগে আগেই ছুটি হয়। আরেকটি সমস্যার নাম ‘মোড়’। মহাসড়কে যদি মোড় থাকে তবে যানজট হবেই। এসব মোড় যতো বেশি যানজট ততো বেশি। অথচ উন্নতদেশে দেখা গেছে, মহাসড়কে মোড় নেই বললেই চলে। রাস্তার নসিমন করিমন, ভটভটি আর সাধারণ যানতো রয়েছেই। মাঝে মাঝে সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে ধরে, যানজটের কারণে প্রতিদিনের ক্ষতি। যা হাজার কোটি টাকার অঙ্ক পেরোয়। কিন্তু যাদের দেখার কথা তারা যেন নির্বিকার। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করতে হলে দ্রুত গতির অবকাঠামোর কোনও বিকল্প নেই। সমস্যার উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ না নিলে সমাধান মিলবে না। কোনও উৎসবের আগে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে সমস্যার সাময়িক সমাধান হয়তো সম্ভব, কিন্তু এটি যেহেতু স্থায়ী সমস্যা তাই প্রতিকারও করতে হবে স্থায়ীভাবে। দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখলে চিন্তাও করতে হবে সুদূরপ্রসারী।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক