X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হান্টিংটন, ফুকোয়ামা ও ধর্মযুদ্ধ

চিররঞ্জন সরকার
০৩ জুলাই ২০১৭, ১৭:৪৯আপডেট : ০৩ জুলাই ২০১৭, ১৭:৫০

চিররঞ্জন সরকার বার্লিন দেয়াল পতনের দুবছরের মাথায় ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনের নাটকীয় থিসিস-‘সভ্যতার সংঘাত’। ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থী রক্ষণশীলদের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক। সেখানেই হান্টিংটন এ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে প্রভাবশালী ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ সাময়িকীতে থিসিসটি আরও সুসংগঠিতভাবে প্রকাশ পায়। এরপর ১৯৯৬ সালে তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন্স অ্যান্ড রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার (The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order)’ এ তত্ত্বটিকে আরও সম্প্রসারিত করেন।
হান্টিংটনের মতে, এই নতুন বিশ্বে সংঘাতের মূল উৎস আদর্শগত বা অর্থনৈতিক হবে না বরং মানবজাতির মধ্যকার সবচেয়ে বড় বিভাজন ও সংঘাতের প্রধান উৎস হবে সংস্কৃতি ও ধর্ম। সভ্যতার এই সংঘর্ষে কারা হবেন দুই যুযুধান পক্ষ? এক ধর্মের লোকজনেরা অন্য ধর্মের লোকজনদের সঙ্গে সংঘর্ষে মাতবেন। এক সংস্কৃতির লোকজন অন্য সংস্কৃতির লোকজনদের ‘শত্রুপক্ষ’ বলে আক্রমণ করবেন। এককথায় বলা যায়, ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ বহুযোজন দূরে। চলবে ধর্মসংঘর্ষ। সংস্কৃতি সংঘর্ষ।
হান্টিংটনের যুক্তির সূত্র ধরে অগ্রসর হলে আমরা বলতে পারি যে, স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তীকালের পরস্পরবিরোধী শক্তিগুলো তাদের শত্রু চিহ্নিত করছে 'ধর্মীয় পরিচিতি'র ভিত্তিতে। হান্টিংটনের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের কালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে 'ধর্মভিত্তিক জঙ্গি' বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। আর এতে ধর্মীয় সামরিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জিয়াউল হক প্রত্যক্ষভাবে আশ্রয়, সৈন্য ও রসদ দিয়ে সহায়তা করেছেন। এরপরে যখন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয় এবং ‘ধর্মভিত্তিক জঙ্গিরা’ যখন আমেরিকার টুইন টাওয়ারে এবং পেন্টাগনে ৯/১১-এ আক্রমণ করে তখন ‘বৈশ্বিক রাজনীতির রসায়ন’ পাল্টে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের হাত ধরে গত দুই দশকে দুনিয়াজুড়ে বৃদ্ধি পাওয়া সন্ত্রাসবাদ, গৃহযুদ্ধ, জঙ্গিবাদ, হামলা, হস্তক্ষেপ প্রভৃতি হান্টিংটনের তত্ত্বটির প্রাসঙ্গিকতাই প্রমাণ করে।
এরপর ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা নামে আরেক আমেরিকান অধ্যাপক একটি বই লিখে পৃথিবীজুড়ে হইচই বাধিয়ে দিয়েছিলেন। বইটির নাম ‘দি এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান (The End of History and the Last Man)’। সেটিও প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। নামে বেশ চমক আছে বলতেই হয়। কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? সোভিয়েত দেশ ভেঙেচুরে গিয়েছে। উদার গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে দেশে দেশে। মুক্ত বাজার। পশ্চিমের ধনতন্ত্র মানুষকে মুক্তির আশ্বাস এনে দিয়েছে। মানুষ এখন যে সরকার গড়ছে তার রয়েছে অসীমান্তিক ঔদার্য। আর পৃথিবীর কোনও কিছু বদলাবার নেই। ইতিহাসের তাই সমাপ্তি। আর তেমনটাই তার বইয়ের নাম। আমেরিকার দুই নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়ান। আগে পড়িয়েছেন জন হপকিন্‌স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন। এমন মানুষদের ভালো জায়গায় ঠিকানা গড়ে না দিলে তার কথা পৃথিবীর লোকজন শুনবে কেন? খুব ‘গণতন্ত্র ভক্ত’ তিনি। এমন একাধিক সংগঠনে তার নাম দেখা যায় যেখানে ‘গণতন্ত্র বা ‘ডেমোক্র্যাসি’ কথাটা জ্বলজ্বল করছে। কেউ ‘লেখাপড়ায় ভালো’ হলেই ‘মানুষ ভালো’ বলা যায় না। কেউ ভালো কবিতা লিখলে বা ভালো নাটক লিখলে, কেউ ভালো অভিনয় করলে বা ভালো ছবি আঁকলে তার কাজের জন্য তিনি পেশাদারি প্রশস্তি প্রত্যাশা করতে পারেন। মানুষ যে তারা ‘ভালো’ হবেনই এর কোনও গ্যারান্টি নেই। এমন কথা বলতে ইচ্ছে হলো কেন? ফুকোয়ামা নামের ভদ্রলোক একসময় রোনাল্ড রেগান সাহেবের নৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। সেই রেগান, যিনি বিজ্ঞান গবেষণায় টাকা কমিয়ে নক্ষত্রযুদ্ধ প্রকল্পের জন্য অনেক টাকা বাড়িয়ে ছিলেন। আমেরিকাতেও সিংহভাগ বিজ্ঞানী ছি ছি করছিলেন। মনে পড়ে আমাদের, দুবার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লাইনাস পাউলিং ‘বিশুদ্ধ’ বুদ্ধিজীবীর মতো বোবাযুদ্ধ করেননি। কোনও রাখঢাক না রেখেই প্রকাশ্যে রাষ্ট্রপতির যুদ্ধংদেহি উন্মাদ ভাবনাকে ধিক্কার জানিয়েছেন।
ফুকোয়ামা বললেন, কমিউনিস্টরা নেই তাই পৃথিবীর পরম শান্তি! তার বইটি লেখার মাস কয়েক পর দুই জার্মানির দেয়াল ভাঙল বলে নিজের কথায় আরও বেশি জোর পেয়ে গেলেন। ফুকোয়ামা নিশ্চয়ই ঋষিপুরুষ। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। এই ফুকোয়ামা একসময় হার্ভার্ডে যে মাস্টার সাহেবের কাছে পড়েছেন ও গবেষণা করেছেন তার নাম স্যামুয়েল পি হান্টিংটন!
তবে পরিস্থিতি বদলাতে বেশিদিন লাগলো না। যিনি কমিউনিজমকে চিরনিদ্রায় শায়িত মনে করে উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তার কপালে চিন্তারেখার ভাঁজ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এক সাংবাদিক পৃথিবীর হিংস্র চেহারা দেখে ফুকোয়ামার কাছে জানতে চান, তিনি তার পূর্বের সিদ্ধান্তে স্থিত রয়েছেন কিনা।
কারও যদি চোখ কান খোলা থাকে, যিনি পূর্বসিদ্ধান্ত এরপর আর মেনে চলবেন কেমন করে? সাংবাদিককে সোজাসুজি বললেন, ‘পঁচিশ বছর আগে ভেবে দেখিনি যে গণতন্ত্র কেমন করে পিছু হটতে পারে। আজ তো চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে তা সম্ভব। হয়তো আমি খুব সরলীকরণ করেছিলাম। বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার পর ভেবেছি, সারা পৃথিবী এবার মুক্তির আনন্দে মাতবে। ইউরোপে ব্রেক্সিট দেখলাম। আমেরিকায় ট্রাম্পের রাষ্ট্রনীতি হতে দেখলাম। সব বিষয় আমাকে হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে। আটলান্টিকের দুই পাড়ে দক্ষিণপন্থী উগ্র জাত্যভিমান মাথা চাড়া দিচ্ছে। ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থা জায়গা করে নিচ্ছে। সে দেশের এক নেত্রী বলছেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিশ্বায়ন চালু করে ভেবেছিলেন এবার সুখে থাকবেন। ফল যা দাঁড়ালো তা এককথায় ভয়াবহ।’ রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফুকোয়ামার ‘অসহ্য’ লাগছে। সাংবাদিককে যা বলেছিলেন ফুকোয়ামা, এর বাংলা করলে দাঁড়ায় : ‘আমি খোলাখুলি বলছি, আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী যে কজনকে আমি দেখেছি, তাদের যে কারও ব্যক্তিত্ব তার চেয়ে বেশি। সমালোচনা বিন্দুমাত্র সে সহ্য করতে পারে না। নিজেকে সব সময় নিরাপত্তাহীন মনে করে। কিছু সমালোচনা করলে ব্যক্তিগতভাবে তেড়ে আসে ও আক্রমণ করে।’
ফুকোয়ামা সাংবাদিককে আরও কিছু কথা বলেছেন। ‘দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ধীরে ধীরে অবক্ষয় হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থা থেকে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হোক এমনকি মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যম হোক, কেউ রাষ্ট্রপতির কোনও কাজের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি ক্ষেপে যাচ্ছেন।’
পৃথিবীর অনেক গণমাধ্যমই হয়তো ধোয়া তুলসিপাতা নয়। তবু বিবিসি, গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস এক ধরনের মান্যতা অর্জন করেছে। ভাবতে পারছেন কী, কেমন গণতন্ত্র বহাল আছে মার্কিন দেশে, হোয়াইট হাউসে ওইসব মাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রবেশ বারণ!
বার্লিনের দেয়াল ভাঙার পর ফুকোয়ামা তার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ভেবে উল্লসিত বোধ করেছিলেন। জীবদ্দশাতেই তাকে দেখে যেতে হচ্ছে, ট্রাম্প সাহেব আমেরিকা আর মেক্সিকোর মাঝখানে প্রায় ৩১০০ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে দেওয়াল তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন। দেওয়াল ভাঙলেই কি দেওয়াল ভেঙে যায়? দেওয়াল তুললেই কি দেওয়াল উঠে যায়? সে না হয় আলাদা কথা। দেওয়াল তৈরির খরচ জোগাবে কে? চমৎকার বলেছেন মার্কিন দেশের নবরাষ্ট্রপতি। ‘আমি গ্রেট ওয়াল তৈরি করবো। আমার চেয়ে ভালো কেউ দেওয়াল তুলতে পারবে না। বিশ্বাস করুন, খুব কম খরচে আমি তৈরি করবো।’ কত খরচ লাগবে? দশ থেকে বারো বিলিয়ন ডলার। ইঞ্জিনিয়াররা শুনে মুচকি হাসছেন। কোথায় এই হিসেব পেয়েছেন ট্রাম্প, কে জানে! ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটা হিসেব করিয়েছে। সে টাকার পরিমাণ পঁচিশ বিলিয়ন ডলারের মতো।
মামার বাড়ির আবদার রাখলেন ট্রাম্প। অর্ধেক টাকা তিনি দেবেন। অর্ধেক টাকা মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতিকে দিতে হবে। মেক্সিকান রাষ্ট্রপতি মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছেন, এক কপর্দকও দেবেন না। রাজনীতির কথা তো হচ্ছেই। পরিবেশবিদরা এক নতুন বিপন্নতার কথা বলছেন। এই বিশাল সীমান্ত দিয়ে বহু জীবজন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ থেকে উত্তর আমেরিকা মহাদেশে চলাচল করে। উত্তর আমেরিকার জাগুয়ার বা কালো ভাল্লুক যদি ওপারে গিয়ে মেক্সিকান ভাল্লুকদের সঙ্গে না মেলামেশা করতে পারে তবে বিপন্ন জাগুয়ার বা কালো ভাল্লুক এক সময় হারিয়ে যেতে পারে।
মার্কিন-মেক্সিকান সীমান্তে কতগুলো স্বাভাবিক বন্যা অঞ্চল রয়েছে। বন্যার সে স্বাধীনতা দিতে হয়। দেওয়াল যদি বাধা তুলে দেয়, কী হবে আগামী দিনে ওই ভূ-অঞ্চলের চিত্র, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
আমেরিকার মহান (!) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পঞ্চাশ ফুট উঁচু দেওয়াল তুলতে চাইছেন। তবে আমেরিকার পক্ষ থেকে দেওয়ালের গায়ে শিল্প সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকলার ছাপ থাকবে। গণতন্ত্রপ্রেমীরা প্রমাদ গুণছেন। পরিবেশবিদরা সতর্ক সংকেত দিচ্ছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, ওই যে দেওয়াল তুলবো আমি, তা দেখতে হবে ‘ভেরি বিউটিফুল’।
জার্মান একনায়ক হিটলার ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক নীটশের অনুসারী। তিনি নীটশের নিহিলিসমের দ্বারা প্রভাবিত হন। নীটশের শূন্যবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পথ চলা শুরু করলেও হিটলার এক উগ্র প্যান-জার্মানিজমে উপনীত হন। নীটশের তত্ত্ব-দর্শনের ভয়াবহ অংশগুলো তিনি বাস্তবে প্রয়োগ ঘটিয়ে পৃথিবীকে মহাপ্রলয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। আর এখন হান্টিংটন-ফুকোয়ামার তত্ত্বের ভয়াবহ দিকগুলো চর্চা করে বুশ-ওবামা-ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বসভ্যতাকে ঘোরতোর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছেন।
এর থেকে উত্তরণের পথ সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। মানব জাতির জন্য এর চেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় আর কি হতে পারে?

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ