X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘হলি আর্টিজান’ কী করে থামবে?

আনিস আলমগীর
০৪ জুলাই ২০১৭, ১৩:০৩আপডেট : ০৪ জুলাই ২০১৭, ১৩:১১

আনিস আলমগীর হলি আর্টিজানের ঘটনার এক বছর অতীত হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। যে বাংলাদেশ আতিথেয়তার জন্য এই দেশটিতে ভ্রমণকারী প্রায় প্রতিটি বিদেশির কাছে ছিল অশেষ সুনামের, এই দেশের মানুষের আন্তরিকতার প্রশংসা করতো যারা আমৃত্য- সেই বিদেশিদের হত্যা করেছি আমরা এই দিনে। একটি কলঙ্ক আর কালিমার দিন আমাদের জাতীয় জীবনে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতেই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি নামের রেস্টুরেন্টে জঙ্গিরা ২০ জনকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি নাগরিক। তিন জন বাংলাদেশি। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন দুজন পুলিশ। এক জুলাই মধ্যরাত থেকে শুরু করে দুই তারিখ সারাদিন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে খবর ছিল এই জঙ্গি হামলার বিষয়টি।
হলি আর্টিজান ছিল আসলে আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার ঘটনা। সরকার এবং জনগণ দু’পক্ষের জন্য। বাংলাদেশের জঙ্গি আছে কী নেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে কিন্তু এই ঘটনা। একের পর এক মুক্ত চিন্তার মানুষ, পীর, পাদ্রী, পুরহিত, সমকামী অ্যাকটিভিস্টকে হত্যা করা হলেও রাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি এসব দমনের। কিন্তু হলি আর্টিজানের পর এ ধরনের মৃত্যু যেমন কমেছে আমাদের বিশ্বাসও দৃঢ় হয়েছে এর পেছনের ব্যক্তিদের অপকর্ম সম্পর্কে। এই ঘটনার পর যেসব বড় বড় সন্ত্রাসী আখড়ার সন্ধান মিলছে তাতে মনে হয় সরকার যদি চিরুনি অভিযান অব্যাহত না রাখতো হালি আর্টিজানের ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতো।
মধ্যপ্রাচ্যে আইএস-এর পতন হচ্ছে কিন্তু মনে রাখতে হবে আইএস এর চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর শায়খ আবদুর রহমানের জেএমবির চিন্তাধারা। আবদুর রহমানের ফাঁসি হয়েছে অনেক দিন। কিন্তু তার সংগঠনটিকে নির্মূল করা যায়নি। গতকালও পত্রিকার খবরে দেখলাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় জঙ্গি নিহত হলেও নতুন নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এই গোষ্ঠী।

এ মুহূর্তে এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছে কামরুল ওরফে আসাদ। নব্য জেএমবি গত রমজান মাসেও বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করেছিল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সতর্কতা ও জঙ্গিবিরোধী টানা অভিযানের কারণে জঙ্গিদের সেই চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে গেছে।

আমাদের দেখতে হবে শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসি হয়েছিল সত্য কিন্তু তিনি রায়ের পরে আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি। তিনি তার পক্ষে কথা বলার জন্য কোনও উকিল নিযুক্ত করেননি, আবার রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর তিনি আপিল দর-আপিলেও যাননি, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষাও চাননি। তিনি বলেছেন, এসব কিছু তাগুদি (শয়তানি) ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার কাছে তিনি আত্ম-সমর্পন করবেন না। চিন্তা ভ্রান্ত হতে পারে কিন্তু এটা তার কঠিন বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় বহন করে। সাংগঠনিক পর্যায়ে তিনি এ শিক্ষায় তার কর্মীদেরকেও শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন নিশ্চয়ই।

শোলাকিয়ায় যে যুবককে আহত অবস্থায় ধরা হয়েছিলো সে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় বার বার বলছিলো তোমাদের এ তাগুদি ব্যবস্থা থেকে আমাকে অব্যাহতি দাও, আমাকে মেরে ফেল। ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে দিনাজপুরের এক যুবককে ধরে পাড়ার মানুষ পুলিশে দিয়েছিলো। লোকজনের অভিযোগ যে, এরশাদ নামের সেই যুবক ঘরে বসে বোমা বানাচ্ছিলো। ৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে সে বলেছে, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় শায়খ আবদুর রহমানের বই পড়ে ঘর থেকে পালিয়ে সে জেএমবিতে যোগদান করেছে।

আমি শায়খ আবদুর রহমানের লিখিত কোনও বই পড়িনি। তবে ধৃত যুবক এরশাদের জবানবন্দীতে অনুমান করছি যে শায়খ আবদুর রহমানের লিখিত বইতে অনুপ্রেরণার খোরাক রয়েছে। শায়খ আবদুর রহমানের জেএমবির লোকেরা আত্মহননেও দ্বিধা করছে না। সুতরাং বলা যায় তাদের মোটিভেশনের ব্যাপারটাও খুবই মজবুত। এটাকে উপেক্ষা করা যাবে না, শুধু বন্দুক দিয়ে দমন করাও যাবে না।

এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোজা পথে, বাকা পথে আইএস-এর জন্য হিজরত করা লোকজন দেশে ফিরে আসবে। আমার মনে হয় তারা দলে দলে জেএমবিতেই যোগদান করবে। কারণ সম্ভবত জেএমবিই তাদের খোরাক জোগাতে পারবে। জেএমবি ছাড়া অন্য কোনও গোপন সন্ত্রাসী সংগঠনের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক নেই। ফলে জেএমবি শক্তিশালী হবে।

এখন পর্যন্ত যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে তারা কেউ বুড়ো বা মধ্যবয়সী লোক নন। সবাই তরুণ-যুবক। মনে হচ্ছে যে তারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়ও নয়। এখন সরকারে উচিত হবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে দিয়ে পুস্তিকাকারে ইসলামের সঠিক বক্তব্য প্রাঞ্জল ভাষায় লিখে বাংলাদেশের সর্বত্র বিলি বণ্টন করা বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর মাদ্রাসায়। মোটিভেশনকে মোটিভেশন দিয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে এখানে।

ধরা পড়া এরশাদ ২০১৫ সালে তার প্রদত্ত ৬৪ ধারার জবানবন্দীতে রাজিব গান্ধীর কথা বলেছে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে হলি আর্টিজানের ঘটনায় রাজিব গান্ধীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। টাঙ্গাইল থেকে ধৃত এই রাজিব গান্ধী পুলিশের কাছে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। সম্ভবতো ভিন্ন জেলায় ধৃত সন্ত্রাসীদের ৬৪ ধারার জবানবন্দী কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে না। যে কারণ দীর্ঘ সময় ধরে তথ্য পাওয়ার পরও রাজিব গান্ধী অধরা রয়ে গিয়েছিলো। 

আমার যতটুকু মনে পড়ে শায়খ আবদুর রহমান মদিনা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছিলেন। তিনি ওহাবি মতবাদে বিশ্বাসী লোক। তারা পীর ফকিরে বিশ্বাস করেন না। যে কারণে তার অনুসারীরা নির্বিচারে পীর ফকির হত্যা করেছে। কুষ্টিয়ার পীর ইস্রাফিল (পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান) থেকে চট্টগ্রামে বায়েজীদ বোস্তামীর লেংটা ফকির কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। অথচ এটাও তাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা। এ উপমহাদেশের লোক পীর ফকিরের অনুসারী তারা তাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে।

সুতরাং সাধারণ মানুষের কাছে জেএমবির গ্রহণযোগ্যতা কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। ধ্যানেই জ্ঞান। ধ্যানই ঐশী জ্ঞানের উৎস। হযরত মুহাম্মদ (স.) হেরা পর্বতের গুহায় বছরের পর বছর ধ্যান করে সত্যে উপনীত হয়েছিলেন। যারা পরম সত্যে উপনীত হতে চান তাদের কাছে ধ্যান অপরিহার্য। এটা সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য না হলেও যারা ধ্যানে জ্ঞান লাভের সাধনা করে সাধারণ মানুষ তাদেরই অনুসারী। সুতরাং জেএমবি সাধারণ মুসলমানের কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে যুব সমাজকে এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে বাঁচাতে হলে ব্যাপক মোটিভেশনের জ্ঞান সমৃদ্ধ পুস্তিকা লিখে প্রচার করতে হবে। জাতিকে এ ব্যাপারে হক্বানী আলেম সমাজ ও সাহায্য করতে পারে। 

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ