X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপহরণকারী এবং প্রপাগান্ডাবাজ, উভয়েই অপরাধী

গোলাম মোর্তোজা
০৫ জুলাই ২০১৭, ১৭:১৬আপডেট : ০৫ জুলাই ২০১৭, ১৭:২৩

গোলাম মোর্তোজা নিজেকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে দাবি করেন। সন্তানদের মানুষ করছেন মানবিক গুণাবলি সম্পন্নভাবে। এমন দাবি আপনার আমার আশেপাশের মানুষেরাই করেন। তারা আমার আপনার পরিচিত। এক একটি ঘটনা যখন সামনে আসে, তাদের অনেকের সেই মানবিকতার স্বরূপ দৃশ্যমান হয়। সেই স্বরূপ যে কতটা অমানবিক, কতটা কুৎসিত রকমের দানবীয় তার প্রকাশ্য রূপ দেখা যায়। এই প্রসঙ্গের অবতারণা ফরহাদ মজহার অপহরণ- ‘বেড়াতে যাওয়া’, ‘নিখোঁজ হওয়া’, ‘অতঃপর উদ্ধার' করাকে কেন্দ্র করে।
মানবিকতার দানবীয় রূপ বিষয়ে শুরুতেই পাঠককে একটু পেছনে নিয়ে যেতে চাই।
ক. ইটিভি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক ’শ কর্মীর চোখের সামনে অন্ধকার। সে এক বেদনাদায়ক দৃশ্য। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন কর্মীরা। সেই সময় উল্লাস চলছে শফিক রেহমানের বাড়িতে। ইটিভি বন্ধ করে দেওয়ার উল্লাস। সাফল্যে মিষ্টি খাচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন। আজকের ফরহাদ মজহার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো নূরুল ইসলাম ছোটনও সেই উল্লাসকারীদের অন্যতম একজন।
খ. ভয়ঙ্কর ২১ আগস্ট। উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে হত্যা। এত ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক আক্রমণের পরও যুক্তি দিতে দেখা গেলো‘হামলা আওয়ামী লীগই করেছে’। কত যে কূ-যুক্তি সে সময় দেখেছিলাম। জজ মিয়া নাটক তো এখন দেশের সব মানুষ জানেন।
গ. চৌধুরী আলমকে ধরে নিয়ে গেলো। পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করলেন, র‌্যাব পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপর যেসব প্রসঙ্গ সামনে আনা হলো- চৌধুরী আলম সন্ত্রাসী, নিজেই আত্মগোপন করেছে। বিএনপি তাকে গুম করে সরকারের ঘাড়ে দায় চাপাতে চাইছে। বিষয়টি এমন যে, যেহেতু চৌধুরী আলম সন্ত্রাসী, সেহেতু তাকে তুলে নিয়ে গুম করা যায়! সন্ত্রাসীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করবে, তদন্ত করে চার্জশিট দেবে। আদালত বিচার করবে। ‘তুলে নিয়ে যাওয়া’ হবে কেন? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। চৌধুরী আলম সন্ত্রাসী এই গান আবারও শোনা যায়।
ঘ. ইলিয়াস আলী হারিয়ে গেলেন। একদল বলতে শুরু করলেন, তিনি ছাত্রজীবনে সন্ত্রাসী ছিলেন। হ্যাঁ, এই তথ্য অসত্য নয়। ইলিয়াস আলী এক সময় এরশাদের নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ করতেন। তখন থেকেই যে সন্ত্রাসী ছিলেন। ছাত্রদলে যোগ দিয়ে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিজস্ব একদল অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যাডার বাহিনী ছিল। তো? তার জন্যে এত বছর পরে তাকে গুম করতে হবে?
আওয়ামী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, বিএনপির ছাত্রদলে ইলিয়াস আলীর মতো এমন সন্ত্রাসী তো আরও অনেকে ছিলেন। তাদের সবাইকে কি গুম করতে হবে? প্রশ্নের উত্তর নেই। ইলিয়াস আলীর সন্ধানে তার স্ত্রী-সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আর একদল মানবতার দাবিদার মানুষ বলছে, নিজেই আত্মগোপনে গেছে, সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যে।
ঙ. আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে সালাউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। কয়েক মাস পর পাওয়া গেলো, মেঘালয়ে। সেই একই কথা, নিজে নিজে গেছেন।
চ. সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী অপহৃত হলেন। একদল বলতে শুরু করলো নাটক। চোখ বাঁধা অবস্থায় রাস্তায় ফেলে গেলো কে বা কারা। ফিরে এলেন। তখন বলা শুরু হলো অপহরণ করলে মুক্তিপণ ছাড়া ছেড়ে দেবে কেন? এটা নাটকই ছিল।
১. পুরনো এসব জানা প্রসঙ্গ পাঠকের বিরক্তির কারণ হতে পারে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এবং তাদের কর্মী-সমর্থকরা যে কোনও ইস্যুতে যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, নীতি-নৈতিকতার ধারে-কাছে না থেকে যেভাবে অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছেন, তা শুধু আতঙ্কের নয়, শিহরণ জাগানো ভয়ঙ্কর। দলীয় কর্মী-ক্যাডারদের দ্বারা নিজের ভাই-বাবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে, স্ত্রী-কন্যা ধর্ষিত হলেও তারা দায় অন্য দলের ওপরে চাপাতে পারেন। সত্য বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা বা বিচার পাওয়া প্রধান বিষয় নয়। প্রধান বিষয় প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলা গেলো কিনা। প্রতিপক্ষের প্রতি যত বড় অন্যায়ই হোক না কেন, উল্লাস প্রকাশে তাদের বিবেকে বাধে না।
২. ফরহাদ মজহারকে ভোর বেলা তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, তার বাড়ির সামনে থেকে। তারপর থেকে যা ঘটল-
ক. সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেলো তিনি বের হয়ে যাচ্ছেন।
খ. বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর স্ত্রীকে ফোন করে জানালেন ‘আমাকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে মেরে ফেলবে।’
গ. ১৮ ঘণ্টা পর যশোরের অভয়নগর থেকে বাস থামিয়ে তল্লাশি করে তাকে উদ্ধার করা হলো।
ঘ. তারপর পুলিশ জানালেন, তিনি বেড়ানোর জন্যে বের হয়েছিলেন। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ আছে। ব্যাগে একটি জামা, কিছু টাকা আছে। মোবাইলের চার্জারও আছে।
ঙ. প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন, খুলনার গ্রিল হাউজ নামক রেস্টুরেন্ট থেকে তিনি ভাত খেয়েছেন।
৩. ফরহাদ মজহার তার সঙ্গের ফোন থেকে স্ত্রীকে চারবার ফোন করেছিলেন। স্ত্রীকে মুক্তিপণের টাকার কথা বলেছিলেন। ১৮ ঘণ্টা সময়কালে ফোনটি অধিকাংশ সময় খোলা ছিল। মাঝেমাঝে বন্ধ ছিল। আমাদের এত প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। তাদের কত রকমের তত্ত্ব কথা শুনি। কিন্তু যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন তারা মৌনতা অবলম্বন করছেন।
পারিবারিক সূত্রে প্রথমে এবং পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রেও জানা গেলো, মোবাইল ট্রাক করে অপহরণের পর মোট ছয়বার ফরহাদ মজহারের অবস্থান সনাক্ত করা যায়। প্রথমে দেখা যায় তিনি গাবতলীতে আছেন। রিং রোড থেকে শ্যামলী মাইক্রোবাসে ভোরবেলা ১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। প্রশ্ন আসে, অপহরণের পরপরই তাকে গাবতলীতে সনাক্ত করা গেলো, না পরে? পরে হলে কখন? এই সময়টা তিনি কোথায় ছিলেন?
তারপর আরও পাঁচবার ফরহাদ মজহারের মোবাইল ট্র্যাক করে অবস্থান জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানিকগঞ্জ, দৌলতদিয়া ঘাট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা। পরিবারের সদস্যরা যে সন্ধ্যা পর্যন্ত গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি, তার কারণ ফরহাদ মজহারের বাসায় বসেই পুলিশ মোবাইল ট্র্যাক করে তার অবস্থান জানছিলেন। পরিবার আশা করছিল, অবস্থান যেহেতু জানা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই তাকে পাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পরও যখন পুলিশ কোনও সুখবর দিতে পারে না, পরিবারের সদস্যরা হারানোর আতঙ্কে ভীত হয়ে পড়েন।
দেশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অবস্থা হয়েছে, অনেকটা আমাদের সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের মতো। একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি বিষয়ে কিছু তথ্য সরবরাহ করে তিন দিন নিখোঁজ ছিলেন। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মৌনতা পালনের এটাও একটা কারণ হতে পারে!
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা যেহেতু কথা বলছেন না, সাধারণ একজন সাংবাদিকের অবস্থান থেকে কিছু প্রসঙ্গ সামনে আনতে চাই।
ক. প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের থেকে জেনেছি, দেশের এজেন্সিগুলোর কাছে এখন এমন প্রযুক্তি আছে যা দিয়ে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়। এমনকি ফোন বন্ধ থাকলেও, অনেকটা জানা যায়।
খ. ফরহাদ মজহারের ফোন ১৮ ঘণ্টার অধিকাংশ সময় খোলা থাকল। ট্র্যাকও করা হলো। এর মধ্যে তিনি ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত চলে গেলেন। ফোন ট্র্যাক করে জানা গেল গাবতলী, মানিকগঞ্জ, দৌলতদিয়া ঘাট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনায় তার অবস্থান। ফোন ট্র্যাক করে নিশ্চিত হয়ে খুলনায় অভিযান চালাতে শুরু করলো র‌্যাব। প্রবেশ-বের হওয়ার সবগুলো রাস্তায় তল্লাশি শুরু হলো। এর মধ্যে ফরহাদ মজহার গ্রিল হাউজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাত খেলেন। কিভাবে গেলেন? সব রকমের তল্লাশি ফাঁকি দিয়ে! আমাদের মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের অবস্থা কি এত দুর্বল? গল্পে শোনা ‘সুনির্দিষ্ট করে ট্র্র্যাক করা যায়’ গল্প কি আসলেই গল্প? সত্য নয়? প্রকৃত ব্যাখ্যাটা দিতে পারতেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তারা যেহেতু বুদ্ধিজীবীদের মতো নিরব, আমরা ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও প্রশ্নটি রাখলাম। বিদেশে অবস্থানরত বিশেষজ্ঞরাও এগিয়ে আসতে পারেন, ব্যাখ্যা নিয়ে।
গ. যে বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হলো, হানিফ পরিবহনের বাসটি আসছিল খুলনা থেকে। খুলনা থেকে হানিফ পরিবহনের বাসসহ এসি বাসগুলো যাত্রীভর্তি হয়ে আসে, সাধারণত খালি আসে না। এই বাসটির যাত্রী সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

ঘ. ব্যাগ এবং বেড়াতে যাওয়ার যে কথা পুলিশ প্রচার করলো, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কোনও রকম তদন্তের আগে, রাতেই পুলিশের ডিআইজি বলে দিলেন, ফরহাদ মজহার বেড়াতে বের হয়েছিলেন, অপহরণ নয়।
ফরহাদ মজহার যখন ঢাকায় ফিরে স্ত্রীকে বললেন, তাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তোলা হয়েছিল, সন্ধ্যা পর্যন্ত তার চোখ বাঁধা ছিল। তখন পুলিশ বলছে, এর ভিত্তিতে এখন তদন্ত হবে। ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে তদন্ত হবে। তদন্তের আগে ‘বেড়াতে যাওয়ার গল্প’ বলা কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় হলো? কিসের ভিত্তিতে এই গল্প বলা হলো?
ঙ. সাম্প্রতিক সময়ে জনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নিয়ে আলোচিত ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া প্রশ্ন তুলেছেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে কেন বা কোন আইনে নিয়ে যাওয়া হলো? তাকে আদালতের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার জন্যে উপস্থাপন করা হয়েছে কিসের ভিত্তিতে? ফৌজদারী আইনের ৫৪/১৬৭ ধারায়? সেটার বিধিবিধান তো বদলে গেছে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর। ফরহাদ মজহারকে ভিকটিম হিসেবে দেখানো হয়েছে। পুলিশ ব্যাগ ব্রাশসহ ভ্রমণে বের হওয়ার কথা বলেছে। কেউ না নিয়ে গেলে তিনি ভিকটিম হবেন কেন?’
৪. বাংলাদেশের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। নীতি-নৈতিকতা, সত্য-অসত্যের বিবেচনায় নয়, রাজনৈতিক বা আদর্শিক যুক্তিতেও নয়। রাজনৈতিক ‘বিশ্বাস’ থেকে তারা বিভক্ত। এক পক্ষ যা বলবেন, অন্য পক্ষ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। লেখার শুরুতে যা বলেছি, প্রতিষ্ঠান বন্ধ থেকে ব্যক্তি গুম-অপহরণ, সব ক্ষেত্রে এর প্রমাণ দেখা গেছে।আরও কিছু পর্যবেক্ষণ-
ক. ফরহাদ মজহারের পছন্দের পোশাক লুঙ্গি। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশেও তিনি লুঙ্গি পরেই যাতায়াত করেন। ফরহাদ মজহার ‘নিখোঁজে’র সংবাদ সামনে আসার পর একদল রসিকতায় মেতে উঠলেন। ‘লুঙ্গি মজহার’ ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ নাম দিয়ে বলতে শুরু করলেন ‘নাটক’ করছেন নিজেই। তাদের ভাষায় ‘লুঙ্গি’ যেন একটি পাপের নাম। যারা ‘লুঙ্গি’ নিয়ে রসিকতা শুরু করলেন, তাদের প্রায় সবাই ঘরে লুঙ্গি পরেন। বঙ্গবন্ধুর লুঙ্গি পরা অনেক ছবি আছে। মাওলানা ভাসানীর তো আছেই। নেই সামরিক শাসকদের।
খ. ফরহাদ মজহার ‘অপহরণ নাটক’ করে সরকারকে বিপদে ফেলতে চাইছেন, ৩ জুলাই সারাদিন-রাত ধরে প্রপাগান্ডা চালালেন এক পক্ষ। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ৪ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন, ‘এখন পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের কোনও দোষ পাওয়া যায়নি।’ তার মানে কী, ফরহাদ মজহার নিজে অপহরণ নাটক করে সরকারকে বিপদে ফেলার মতো ‘অপরাধ’ করার চেষ্টা করেছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যারা নাটক বলে প্রপাগান্ডাচালালেন? ‘অপরাধ’ কী তারা করলেন না? এখন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার না?
গ. এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে। গাবতলী থেকে যশোর হয়ে খুলনা, কমপক্ষে ছয়বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফরহাদ মজহারের অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হলেন। এই পুরো রাস্তায় তাকে ধরার চেষ্টা করা হলো না। এসব সড়কের পাশে থানা আছে, র‌্যাবের ক্যাম্প আছে। হাইওয়ে পুলিশ আছে। যখন সনাক্ত করা গেল দৌলতদিয়া ঘাটে ফরহাদ মজহারের অবস্থান, ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে তল্লাশি চালালে না ধরতে পারার তো কোনও কারণ ছিল না। গাবতলী, মানিকগঞ্জ কোথাও পুলিশ, র‌্যাবকে ফরহাদ মজহারকে ধরা বা আটকানোর নির্দেশ দেওয়া হলো না। অভিযান চালানো হয়েছে সন্ধ্যার পরে খুলনায়।

সেই অভিযান এলাকা থেকেও তিনি বের হয়ে গেছেন। অভয়নগরে বাস থেকে তাকে খুঁজে পেলেন। পুরো ব্যাপারটায় অনেকগুলো ‘কেন’ আছে। ‘রহস্য’ আছে। উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। পুলিশ কেন ‘বেড়াতে যাওয়ার’গল্প বললো, তা জানতে চাওয়ার কেউ নেই। প্রপাগান্ডাবাজরা আপাতত নিরব, নতুন ফন্দি আবিষ্কারের চেষ্টায়।
৫. এখন পর্যন্ত মোটামুটি স্পষ্ট যে, ফরহাদ মজহার নিজে ‘অপহরণ নাটক’ করেননি। তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। অতীতে যেমন অনেককে অপহরণ করা হয়েছে। এসব অপহরণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম জড়িয়ে আছে। কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে। গাবতলী থেকে খুলনা, জানার পরও ধরার চেষ্টা না করায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্দেহের তালিকায় থাকছে। ‘নাটক’ করা হয়েছে ‘গফুর’ নামে তাকে ৩ জন যাত্রীর বাসে তুলে দিয়ে। প্রপাগান্ডা প্রথমাবস্থায় ধাক্কা খেয়েছে। এতে থেমে যাবে বলে মনে হয় না। ভিন্ন আঙ্গিকে প্রপাগান্ডা আবার হয়তো শুরু হবে।
ফরহাদ মজহার উদ্ধারে সোচ্চার বিষয়টি দিয়ে লেখা শেষ করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খ্যাত-অখ্যাত প্রায় সবাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের অনেকে শুরু করেছেন এভাবে, ‘তার মতের সঙ্গে আমার মিল নেই’‘তিনি জামায়াতি-বিএনপিপন্থি’ ‘তিনি হিজবুত তাহরীর আধ্যাত্মিক নেতা’ ‘তিনি শাহবাগকে অসম্মান করেছেন’‘মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করেছেন’- তবে তাকে উদ্ধার করার দাবি জানাই।’
যেভাবে বিএনপি বলতো, ‘তবে... আমরাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই।’
বিনীতভাবে বলতে চাই, ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তা আইনগতভাবে দেখার দাবি যে কেউ জানাতে পারেন। একজন মানুষ ‘অপহৃত’ হওয়ার সঙ্গে তো এসব বিষয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ বলছেন ‘ফরহাদ মজহার মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করার পরও তাকে উদ্ধারের দাবি জানানো হচ্ছে’। কী অদ্ভুত যুক্তি! মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানের বিচার করার জন্যে দেশে আইন আছে। সেই আইনে ব্যবস্থা না নিয়ে অপহরণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিচ্ছেন? আপনারা প্রগতিশীল?
উদ্ধার বা ‘অপহরণ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগে ‘ভূমিকা’দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে মূলত আইডেনটিটি ক্রাইসিসের কারণে। তারা সারাক্ষণ ভীত থাকছেন, ফরহাদ মজহার বিষয়েস কথা বললেই সম্ভবত তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’পরিচয়টি অক্ষুণ্ন থাকবে না। তাদের বোধের মধ্যে নেই যে, বিষয়টি এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের নয়। বিষয়টি অন্যায়-ন্যায়ের। যুদ্ধাপরাধীদেরও আইন অনুযায়ী বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, অপহরণ করে গুম করা হয়নি।

খ্যাতিমান অনেকের ‘বোধ’ যদি এত দুর্বল হয়, তারা যদি এতটা আইডেনটিটি ক্রাইসিস আতঙ্কে ভোগেন, রাজনৈতিক ‘বিশ্বাসী’ সাধারণদের আর দোষ দিয়ে লাভ কী!

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ