X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট খুশি করলো কাদের ?

বিভুরঞ্জন সরকার
০৭ জুলাই ২০১৭, ১৫:৫১আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৭, ১৪:৩৫

বিভুরঞ্জন সরকার অর্থনীতির ‘অ আ ক খ’ও আমি বুঝি না। বাজেট  বিষয়েও নাদান। বাজারের প্রতিক্রিয়া দেখেই বাজেটের ভালো মন্দ বোঝার চেষ্টা করি। গণমাধ্যমের লেখালেখি, আলোচনা – সমালোচনার মধ্যেই আমার বাজেট জ্ঞান সীমাবদ্ধ। কাজেই গভীর কোনও বিশ্লেষণ বা আলোচনা, নয় একেবারেই সাধারণ কিছু আলোচনা তুলে ধরছি।
জাতীয় সংসদে  মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বিশাল বাজেট পেশ করেছিলেন ১ জুন। এতো বড় অংকের বাজেট এই প্রথম। দেশের অর্থনীতির শক্ত অবস্থান এবং সরকারের সক্ষমতা বোঝানোর জন্যই কি এই বিপুল অংকের বাজেট? এতো সেই গবেট স্কুলবয়ের পরীক্ষার খাতা ইয়াব্বড় ‘ক’ লিখে দেখো কত বড় ‘ক’ মন্তব্য করার মতো নয়? ঢাউস বাজেট দিয়ে মন্ত্রিসভার বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য অর্থমন্ত্রী সবাইকে চম দেখাতে গিয়ে নিজেই যে গ্যাড়া কলে পড়বেন সেটা হয়তো আগে ভাবেননি।
বাজেট পেশ হলে বাজেট নিয়ে আলোচনা – সমালোচনার ঢেউ বয়ে যাওয়া আমাদের দেশের একটি সাধারণ রীতি। আগে সংসদে বাজেট পেশ শেষ হতে না হতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজপথে বাজেটের পক্ষে – বিপক্ষে মিছিল বের করতো। সরকার পক্ষ বাজেটকে স্বাগত জানাতো, আর বিরোধীরা ‘গরিব মারার বাজেট, গণবিরোধী বাজেট’ ইত্যাদি বলে স্লোগান দিত। মানি না মানবো না বলে বাজেট প্রত্যাখ্যান করতো। এতে বাজেটের কিছু আসতো যেতো না। তবু এটা ছিল একটা রুটিন রাজনৈতিক কর্মসূচি। তবে এখন অবস্থা একটু বদলেছে। মিছিল মিটিংয়ের বদলে এখন বিবৃতি দেওয়া, টকশোতে অংশ নেওয়া, সভা-সেমিনারে বক্তব্য দেওয়াই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার বাজেট ঘোষণার পরও এর ব্যতিক্রম  হয়নি।
বজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘মনে হয়েছে, এবার জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট দিয়েছি। এ জন্য অনেক কষ্টও করেছি। প্রশাসনের অন্যরাও আমার মতোই কষ্ট করেছেন’। কথায় আছে, কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। কিন্তু এবার অর্থমন্ত্রীর বেলায় তা হলো না। অনেক কষ্ট করে জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট দিয়েও তিনি কোনও মহলের কাছ থেকে প্রশংসা না পেয়ে পেলেন নিন্দা-সমালোচনা। শুধু সরকারের বাইরে থেকে নয়, সরকারি দলের মন্ত্রী -এমপি-নেতারাও অর্থমন্ত্রীকে ছেড়ে কথা বললেন না। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই অর্থমন্ত্রী সমালোচিত হলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কাউকে নিবৃত করার চেষ্টা করলেন না। পরে আওয়ামী  লীগের দু’এক জন নেতা বলেছেন, এতে সংসদ প্রাণবন্ত হয়েছে। এটাই নাকি গণতন্ত্রের ‘বিউটি’। হতে পারে। ওনারা যখন বলেছেন, তখন সেটাই হয়তো ঠিক । তাদের কথাতো আর অর্থহীন হতে পারে না। এই ‘বিউটিফুল’ গণতন্ত্র চর্চা কত দিন অব্যাহত থাকে সেটাই দেখার বিষয়।
বাজেট সমালোচকরা কী বলছেন তা একটু দেখা যাক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাজেট বিশাল অঙ্কের, কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে হয় না। অর্থমন্ত্রীর মহাসড়কে ওঠার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতা দূর না করে মহাসড়কে উঠে পড়লে তো দুর্ঘটনা ঘটবে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, বাজেটে সার্বিকভাবে কিছু সাহসী পদক্ষেপ আছে। কিছু ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষ আছে। কিছু ক্ষেত্রে উদাসীনতাও আছে। আবার কিছু পদক্ষেপ সঠিক পথে নেই। অর্জনযোগ্য নয় জেনেও দেখানোর জন্য হলেও বড় বাজেট দেওয়া হয়েছে।

সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ছাড়া নতুন অর্থবছরের বাজেট হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলেছে, কোনও ধরনের সংস্কার ছাড়া বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেটের অনেক প্রক্ষেপণের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। হিসাব মেলাতে অবাস্তব তথ্য দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি বাজেটকে খারাপ এবং অগ্রহণযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাদের ভাষায় ‘অনির্বাচিত’,‘জবাবদিহিতাহীন’ একটি সরকার জনকল্যাণকর বাজেট দেয় কিভাবে?  যেন তারা ক্ষমতায় থাকতে কত  জনবান্ধব বাজেট দিত। বিএনপি বাজেটকে এক কথায়‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে বাতিল করেছে। ( বিএনপি কবে থেকে প্রগতিশীল হলো তা অবশ্য দেশবাসীর জানা নেই) । 

বাজেটে ভ্যাট আইন প্রয়োগ, বাড়তি আবগারি শুল্ক, ব্যাংক আমানতে সুদ আরোপ এবং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর প্রস্তাব করায় বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হওয়ায় বাজেটের ভালো মন্দ অন্য সব কিছু আড়ালে চলে যায়। বাইরের উত্তাপ সংসদের ভেতরেও সংক্রমিত হয়। সরকারি দলের কয়েক জন মন্ত্রী, এমপি, নেতাও বাজেট সমালোচনায় শরিক হয়ে অর্থমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্যও দেন। সংসদে সরকার দলীয় সদস্যদের সাময়িকভাবে বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখে জাতীয় পার্টির সদস্যরাও চুপ থাকতে পারেননি। তারাও অর্থমন্ত্রীর প্রতি বাণ ছুড়েছেন। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা,যারা অর্থমন্ত্রীর কাছে নানা সময়ে নানা বিষয়ে ‘তদবির’ ‘সুপারিশ’ নিয়ে গিয়ে পাত্তা পাননি, বাজেট বক্তৃতায় তারা ঝাঁজ ছড়িয়ে কিছুটা গায়ের জ্বালা জুড়িয়েছেন।  

তার বয়স নিয়ে খোটা দিয়ে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন জাপার জিয়াউদ্দিন বাবলু। সরকারি দলের কেউ কেউ তাকে কম কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। বেচারা অর্থমন্ত্রী! নীরবে বসে সব শোনা ও হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। দুই জন সিনিয়র মন্ত্রী আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদসহ কয়েক জন সদস্য অর্থমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন, তার পক্ষ নিয়েছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত সংসদে একটি ভারসাম্য এসেছিল। কিন্তু ২৯ জুন সংসদে যে বাজেট পাস হলো সেটাকে ভারসাম্য পূর্ণ বলা যাবে কি?  মাননীয় প্রধানমন্ত্র তার বাজেট বক্তৃতায় কতিপয় বিতর্কিত  বিষয় বাজেট থেকে বাদ, পুনর্বিবেচনা অথবা আপতত স্থগিত রাখার পরামর্শ অর্থমন্ত্রীকে দেন। যেমন ভ্যাট বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য স্থগিত, আবগারি শুল্ক, ব্যাংক আমানতে সুদ আরোপ, সঞ্চয়পত্রে সুদ কমনো ইত্যাদি।

অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, যা তার কাছে আদেশতুল্য, শিরোধার্য করেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ  মেনে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য স্থগিত হয়। কর, শুল্ক এসবও কমে যায়। এ রকম যে হবে সেটা আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সামনে নির্বাচন রেখে সরকার জনঅসন্তুষ্টির কারণ ঘটানোর মতো বাজেট পাস করে কিভাবে?  তবে পেশ করা আর পাস হওয়া বাজেটে যে বিরাট পরিবর্তন হলো সেটা খুব অস্বাভাবিক। আগে পাস করার সময় পেশকৃত বাজেটে টুকটাক সংশোধন করা হলেও এবারের সংশোধন ছোটখাট নয়। নির্বাচনের দেড় বছর আগে বাজেট দিয়ে বিভিন্ন মহলকে রুষ্ট করার ঝুঁকি সরকার নিতে চায়নি। জোড়াতালি দিয়ে সবাইকে তুষ্ট করতে চাইলেও আসলে কী তা হলো, না কি হওয়া সম্ভব?

তাছাড়া অন্য প্রশ্নও আছে। ভ্যাট আইন করার তাগিদ ছিল বিশ্বব্যাংক -আইএমএফের তরফ থেকে । জনতুষ্টির বাজেট করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ভ্যাট ও কর প্রস্তাবনায় সংশোধনী আনায় রাজস্ব আয়ের যে বড় ঘাটতি দেখা দেবে তা কিভাবে মেটানো হবে? ব্যবসায়ীদের চাপ, দলীয় চাপ এবং অন্যান্য মহলের সমালোচনার মুখে ভ্যাট আইন স্থগিত করায় বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে সরকার। সরকারের অনেক পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।

এই বাজেট পাসে সবচেযে খুশি হয়েছেন ব্যবসায়ীরা বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকার ব্যবসায়ীবান্ধব। তাহলে সরকার কি গরিব বা দরিদ্রবান্ধব থাকতে চাচ্ছে না? গরিবের স্বার্থ আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ এক নয়। (ছোট ব্যবসায়ীরা অবশ্য ব্যতিক্রম)। এক শ্রেণি খুশি হলে আরেক শ্রেণি অখুশী না হয়ে পারে না। আরেকটি প্রশ্নও বোদ্ধা মহলে উঠছে। নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রণয়ন  করলেও তিনি কি সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা ছাড়া কিংবা পরামর্শ ছাড়া তার একক সিদ্ধান্তে নীতিগত কোনও কিছু করতে পারেন? সংসদে বাজেট পেশের আগে তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করতে হয়। এবারও হয়েছে। তাহলে কর প্রস্তাবনার দায় কি এককভাবে অর্থমন্ত্রীর ওপর বর্তায়? অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতা বা সমালোচনা তো কার্যত সরকারেরই ব্যর্থতা বা সমালোচনা । নয় কি?  

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটনো’র রাজনীতি সারা জীবন করেছেন। তার কন্যা শেখ হাসিনাও  একই লক্ষ্যে রাজনীতি করছেন। কিন্তু এবারের বাজেট ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে’ কতটুকু সক্ষম হবে সেটাই প্রশ্ন। দেখা যাক। 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
রানা প্লাজার ভুক্তভোগীর আক্ষেপ‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ