X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

একজন পারভেজ ও আয়শা লতিফ

লীনা পারভীন
০৯ জুলাই ২০১৭, ১৯:৪০আপডেট : ০৯ জুলাই ২০১৭, ১৯:৪২

লীনা পারভীন গত কিছুদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’টি ঘটনা বেশ আলোচিত। প্রচুর লেখালেখিও হচ্ছে এ দু’টি ঘটনা নিয়ে। তবে আয়শা লতিফের ঘটনাটি নিয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সবাই।
আয়শা লতিফ নামের একজন গৃহবধূ। তার বাসায় কাজ করতো ১১ বছরের সাবিনা। ডিম পোচ করতে গিয়ে কুসুম ভেঙে ফেলার অপরাধে তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা করা হয়। মারতে মারতে এমন অবস্থা যে, বাচ্চাটির চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ দু’টি ফুলে ঢোলের মতো হয়ে আছে। চারপাশে কালো হয়ে আছে। আমরা কেবল তার মুখের ছবিটি দেখতে পেয়েছি কিন্তু আমার বিশ্বাস তার শরীরে আরও এমন অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাবে। বাবা-মা কতটা অসহায় হলে তার সন্তানকে অন্যের বাসায় কাজে দেন এটা সবাই বুঝতে পারে। আমাদের দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে আমরা অনেকেই কমবয়সী শিশুদের নিয়োজিত করি।
প্রথমত ১১ বছরের এই বাচ্চার জন্য চুলার কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তার তো আগুনের কাছেই যাওয়া উচিত নয়। তার মধ্যে আয়শা নিজে একজন সন্তান সম্ভবা। এই সময়টাতে নারীর শরীরে অনেক রকম পরিবর্তন আসে। সে যখন থেকে অনুভব করে তার পেটের ভেতর বেড়ে উঠছে আরেকটি মানব সন্তান তখন সব শিশুকেই নিজের সন্তান মনে হয়। কল্পনায় সেই অনাগত শিশুটির চেহারা ভেসে আসে। কিন্তু আমরা এই আয়শার বেলায় দেখলাম উল্টো ঘটনা।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই আয়শা জীবনে কোনও দিন তার সন্তানকে ডিম পোচ করে খেতে বলবেন না। কারণ সে তার নিজের পেটের বলে। এখন প্রশ্ন জাগে—মাতৃত্ব কি তবে কেবল নিজের সন্তানের জন্য? অন্যের শিশু হলে কি তার প্রতি কোনও মায়া জন্মায় না? আপনার বাসায় কাজ করতে এসেছে বলেই কি সে আপনার অত্যাচারের শিকার হবে? একজন উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছ থেকে যদি এরকম দাসপ্রথার পরিচয় ফুটে ওঠে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা হয় আমাদের সমাজ থেকে কি মানবতা, মানবিকতা, মাতৃত্ব, দয়া-মায়া সব উঠে যাচ্ছে? আমাদের সমাজে কিন্তু এই আয়শাদের সংখ্যা কম নয়। কয়দিন পরপরই আমরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনেকের এই রূপ দেখি। এসবের কয়টা ঘটনারইবা বিচার পাই? তাছাড়া বিচার হলেই বা কী? বিচার বা শাস্তি দিয়ে কি আমরা হারানো মানবতাকে ফিরিয়ে আনতে পারব? প্রশ্নটি থাকলো সবার কাছে।

একই সময়ে আরেকটি ঘটনা আমরা দেখতে পেয়েছি। ‘কুমিল্লার দাউদকান্দিতে পুলিশ কনস্টেবলের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতায় প্রাণে বেঁচে গেছে দুর্ঘটনা কবলিত একটি বাসের অন্তত অর্ধশত যাত্রী’।

সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গৌরীপুরে প্রায় অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে চাঁদপুরগামী বাস ‘মতলব এক্সপ্রেস’ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ডোবায় পড়ে যায়।  দুর্ঘটনা কবলিত বাসটি দেখছিলেন অনেকেই কিন্তু এ সময় গৌরীপুরে দায়িত্বরত দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার কনস্টেবল পারভেজ মিয়া ডোবায় লাফিয়ে পড়েন। প্রথমে দ্রুত গাড়ির জানালার কাচ ভেঙে দিলে গাড়ির ভেতরে থাকা যাত্রীরা বেরিয়ে আসেন। পরে পানিতে ডুব দিয়ে সাত মাস বয়সী এক শিশু ও পাঁচ নারীসহ মোট ১২জনকে ওপরে তুলে আনেন।

গণমাধ্যমে ঘটনাটি এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। পারভেজ মিয়া একজন পুলিশের কনস্টেবল। আমরা বর্তমান সময়ে পুলিশের বিভিন্ন ভূমিকা নিয়ে অনেকভাবেই নেতিবাচক কথা থাকি। পুলিশের ভালো কাজগুলোর চেয়ে কোনও একটা নেতিবাচক খবর পেলেই সেটা নিয়ে মাইক বাজাতে থাকি। পুলিশ সমাজের বন্ধু না শত্রু, এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হই। কিন্তু পুলিশও যে সমাজের মানুষ। তার ভেতরেও লুকিয়ে আছে মানবিকতা। তার ভেতরেও বিবেক কাজ করে। সেও মানুষের কষ্টে কষ্ট পায়। এরই আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে এই ঘটনা। আমার কাছে পারভেজের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের চেয়েও তার ভেতরে থাকা মানুষ পারভেজের পরিচয়টিই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

আয়শা ও পারভেজ, দু’জনেই আমাদের এই প্রচলিত সমাজের প্রতিনিধি। তাদের দু’জনেই একই আলো-হাওয়া ও সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছে। দু’জনেই রক্ত মাংসের মানুষ। গড়নেও একজন মানুষের যা-যা বৈশিষ্ট্য থাকার কথা সবই সমানভাবেই আছে দু’জনের। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়?

পার্থক্য দু’জনের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায়। দু’জনের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়। মানুষকে ভালোবাসতে জানার বোধের পার্থক্যই দু’জনকে আলাদা করেছে আমাদের কাছে।

ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখি মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পাশের লোকটির প্রতি যেন আমরা সদয় থাকি, সে শিক্ষার কথা আমরা সবাই শিখি। কিন্তু ক’জন এই শিক্ষাগ্রহণ করি সেটাই তফাৎটা তৈরি করে আমাদের মধ্যে।

প্রসঙ্গত, এখানে একটি বিজ্ঞাপনের কথা আমি না বলে থাকতে পারছি না। ইউসি ব্রাউজারের একটি বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। সেই ফেসবুকেই প্রচার হচ্ছে। আমাদের দেশেই তৈরি করা হয়েছে বিজ্ঞাপনটি। বিষয়টি এ রকম যে, একজন মা গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করেন। সঙ্গে তার ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে যায় কাজে। বাচ্চাটির বয়স কত হবে? বড়জোর ৭/৮ হবে। সেই বাসায় একই বয়সের একটি বাচ্চাও আছে। বাচ্চাটি অনলাইনে একটি জামা পছন্দ করে তার মাকে কিনে দেওয়ার আবদার ধরে যেটি পড়লে তাকে এঞ্জেলের মতো মনে হবে। মা সঙ্গে-সঙ্গেই অনলাইনে অর্ডার করে দেয়। গৃহকর্মীর বাচ্চাটি এঞ্জেল শব্দের অর্থ জানতে চায়। মালিকের কন্যাটি তখন অর্থ বলে দেয়। এমন সময় গৃহকর্মীটির বাচ্চাটি মায়ের কাছে আবদার ধরে সে কি এঞ্জেল হতে পারবে? এই দৃশ্যটি গৃহকর্ত্রীর মনকে আলোড়িত করে। কল্পনায় দেখতে পান তার বাচ্চাটি সেই নীল জামাটি পরে পরি সেজে দৌড়ে আসছে আর ভৃত্যের একই বয়সী বাচ্চাটি মন খারাপ করে বসে আছে। এই দৃশ্যটি তিনি নিতে পারেননি। অবশেষে তিনি দু’টি বাচ্চার জন্যই একই রকমের জামা কিনে আনেন।

বিজ্ঞাপনটি হয়তো আমাদের অনেকেই দেখেছি আবার অনেকেই দেখিনি। এই লেখায় বিষয়টি আনার কারণ হচ্ছে—আমাদের মাঝে বিবেকের আজকে বড় অভাব।  আমাদের সমাজ বাস্তবতার কারণে এখনও আমরা গৃহকর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। একটি গ্লাস পানিও আমরা নিজেরা ঢেলে খাই না। এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি অন্যের শ্রমে। কিন্তু এই তাদের প্রতিই আমরা সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর হই। আমরা ধরেই নেই যেহেতু তারা আমাদের বাসায় টাকার বিনিময়ে শারীরিক শ্রম দিতে আসে সুতরাং সে একজন মেশিন। তার শরীরের কোনও ব্যথা, বেদনা বা তার কোনও অবসরের দরকার হয় না। এমনকি তাদের জীবনে কোনও খায়েশও থাকা যৌক্তিক না। এটা একান্তই দাসপ্রথার ভাবধারা। এই দাসপ্রথার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি। একজন মানুষ নেয়াহেত পেটের দায়ে পড়ে আমার বাসায় শ্রম দিতে আসে। আপনি আমি হয়তো সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির অংশ বলে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছি, আরামের জীবনের অধিকার পেয়েছি। ভেবে দেখলে আমি-আপনিও একই ধারার শ্রমিক। পার্থক্য সে সারাদিন গতর খেটে কায়িক শ্রম দিচ্ছে আর আপনি আমি স্যুটেড বুটেড হয়ে চেয়ারে টেবিলে বসা শ্রমিক। চূড়ান্ত অর্থে আমরা সবাই শ্রমিক।

তবে আমি আশাবাদী হই সমাজে কেবল আয়শারাই নেই, আছে পারভেজরাও। এই পারভেজরাই আমাদের সমাজের প্রতিনিধি। তাদের সামনে আনতে হবে বেশি বেশি। আয়শাদের ব্যাপারে আমাদের সবারই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের অপরাধমূলক কাজের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করাই নয় কেবল, তাদের মনোজগতেও পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজ থেকে আয়শাদের মানসিকতার যত দ্রুত লুপ্ত ঘটবে, ততই সমাজ ও সভ্যতার জন্য ইতিবাচক আলোর রেখা দেখা যাবে।

লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ