X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

যৎসামান্য ক্ষতি!

প্রভাষ আমিন
১৪ জুলাই ২০১৭, ১১:২০আপডেট : ১৭ জুলাই ২০১৭, ১৬:১৬

প্রভাষ আমিন জরুরি কোনও বিষয়ে সংসদকে অবহিত করতে হলে মন্ত্রীরা কার্যপ্রণালী বিধির ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেন। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে ৩০০ বিধিতে দুটি আলাদা বিবৃতি দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কথা বলেছেন চিকুনগুনিয়া নিয়ে। আর অর্থমন্ত্রী কথা বলেছেন সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার নিয়ে। তাদের বক্তব্যে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। যাক দেশে চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। আর দেশ থেকে অর্থ পাচারও হচ্ছে না, যা হচ্ছে তা যৎসামান্য।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কৌশলে চিকুনগুনিয়ার দায় সিটি করপোরেশন আর গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, চিকুনগুনিয়া একটি সাধারণ ভাইরাস। এডিস মশা থেকে এর উৎপত্তি হয়। এই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এর দায়িত্ব কোনোভাবেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেও ডাক্তার নন, ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান। কিন্তু সংসদে তিনি রীতিমত প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন- ‘চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি প্যারাসিটামল খেলে, প্রচুর পানি পান করলে এবং বিশ্রাম নিলেই ৩/৪ দিনের মধ্যে এ রোগ সেরে যায়। এ রোগ হলে স্বাভাবিক খাবার খেতে পারবে’। আশা করি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতির পর চিকুনগুনিয়া নিয়ে আপনারা কেউ আর আতঙ্কিত হবেন না। চারদিন তিনটা করে প্যারাসিটামল খেলে আপনি ভালো হয়ে যাবেন। খরচ হবে বড় জোর ২০ টাকা। প্রচুর পানি খেতেও টাকা লাগবে না, বিশ্রাম নিতেও টাকা লাগবে না। মাত্র ২০ টাকায় ভালো হয়ে যায়, এমন একটি অসুখ নিয়ে এত হইচই করা গণমাধ্যমের মোটেই ঠিক হচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সঠিকভাবেই বলেছেন, চিকুনগুনিয়া নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানো গণমাধ্যমের একদম ঠিক হচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেছেন, আপনাকে ধরলে আপনি বুঝতেন চিকুনগুনিয়া কাহাকে বলে, কিভাবে হয়। ঐখানে বসতে পারতেন না। তিনি আরো বলেন, আমরা যারা এই সংসদে আছি, যমেও আমাদের কাছে আসে না ভয়ে। গরিবের কাছে যায় চিকুনগুনিয়া। প্রত্যেক ঘরে ঘরে আক্রান্ত। কাজী ফিরোজ রশীদকে ধন্যবাদ, তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মুখের ওপর সত্যি কথাটি বলে দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে বিবৃতিতে যাই বলুন, আমরা কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারি না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেই তো আর চিকুনগুনিয়া সাধারণ ভাইরাস বা সামান্য অসুখ হয়ে যাবে না। চিকুনগুনিয়া যার হয়েছে, সেই জানে চিকুনগুনিয়ার যন্ত্রণা কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী।

কাজী ফিরোজ রশীদ ঠিকই বলেছেন, চিকুনগুনিয়া হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে কেন বসেও বিবৃতি দিতে পারতেন না। প্যারাসিটামল খেলে ৩/৪ দিনে জ্বর হয়তো ছেড়ে যাবে। কিন্তু চিকুনগুনিয়া হলে পুরোপুরি ভালো হতে কারো কারো
ক্ষেত্রে তিন মাস পর্যন্ত লেগে যায়। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন মে মাসের শুরুর দিকে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি দুই মাস অফিস করতে পারেননি। এখন পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। একতলা সিঁড়ি ভাঙলেই হাপিয়ে ওঠেন। মোবাশ্বের ভাইয়ের প্রচণ্ড প্রাণশক্তি। সবকিছুতেই তিনি ব্যস্ত। এই ব্যস্ত মানুষ দুই মাস বিছানায় শুয়ে ছিলেন, ভাবা যায়। চিকুনগুনিয়ার যন্ত্রণার কথা জানতে চাইতেই তিনি বললেন, না হলে কেউ বুঝবেন না, এর যন্ত্রণা। আমার হার্টের অপারেশনের সময়ও এত কষ্ট পাইনি, এত লম্বা সময় শুয়ে থাকিনি। তিনি বললেন, চিকুনগুনিয়ার যন্ত্রণা এতটাই ভয়ঙ্কর, শুয়ে থাকাও কষ্টকর। শুরুর দিকে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। মোবাশ্বের ভাইয়ের কথা শোনার পর আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছি। আমাদের বিল্ডিঙে আমাদের বাসা ছাড়া আর সব বাসায় চিকুনগুনিয়া হানা দিয়েছে। ফিরোজ রশীদ ঠিকই বলেছেন, ঘরে ঘরে এখন চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক। মোবাশ্বের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর আমি আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছি না। সরি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, গণমাধ্যম অহেতুক চিকুনগুনিয়ার মতো একটি সাধারণ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আবারও সরি। একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবেও আমি তার কথার সাথে একমত হতে পারলাম না। গণমাধ্যম আতঙ্ক ছড়াচ্ছে না। বরং
গণমাধ্যম সঠিক সময়ে সঠিক দায়িত্ব পালন করছে। চিকুনগুনিয়া আগেই এলার্ম দিলেও সরকার দেরিতে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যম সঠিক সময়েই চিকনগুনিয়া নিয়ে জনগণকে সঠিক তথ্য জানিয়ে আসছে। সচেতনতা তৈরি সরকারের কাজ। সেই কাজ করে দিচ্ছে গণমাধ্যম। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উচিত ছিল গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ দেওয়া। গণমাধ্যম কোনও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে না। বরং তারা জনগণকে সঠিক তথ্যটি জানাচ্ছে। যাতে মানুষ মশা থেকে সাবধান থাকতে পারে। যাতে তারা আশেপাশে
পানি জমতে না দেয়। যাতে তারা দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে পারে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেই যেমন চিকুনগুনিয়া সাধারণ ভাইরাস হয়ে যাবে না। তেমনি গণমাধ্যম অহেতুক আতঙ্ক ছড়ালেও মানুষ আতঙ্কিত হবে না। চিকুনগুনিয়া যার হয়েছে, শুধু সেই বুঝবে। বিষয়টা আতঙ্কের নয়, সচেতনতার। গণমাধ্যম যত
বেশি চিকুনগুনিয়া কথা বলবে, মানুষ তত সচেতন হবে।

একই দিনে সংসদে অর্থমন্ত্রী অর্থ পাচার নিয়ে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দিয়েছেন। তার বিবৃতিও আমাদের আশ্বস্ত করেছে। যাক বিদেশের সাথে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে, অর্থ পাচার হয়নি। যা হয়েছে, তা যৎসামান্য। কিন্তু অবাক লাগে অর্থমন্ত্রীও অর্থ পাচার নিয়ে সংবাদ প্রকাশের দায় গণমাধ্যমের ওপরই চাপিয়েছেন। তিনি বলছেন, সাংবাদিকরা অতিশোয়াক্তি করেছেন এবং অত্যন্ত অন্যায়ভাবে একে পাচার বলছেন। অর্থমন্ত্রী অবশ্য একে পাচার বলতে রাজি নন।

চিকুনগুনিয়া হোক আর অর্থ পাচার, সব দোষ সাংবাদিকদের। তবে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অর্থ পাচার সংক্রান্ত যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা নিজস্ব অনুসন্ধান নয়। গত ১ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত রিপোর্টের সূত্র ধরেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অর্থ পাচারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। জিএফআই প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। আর গত এক দশকে পাচার হয়েছে প্রায় চার লাখ কোটি টাকা। আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের
প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে। এখন অর্থমন্ত্রী দায়টা বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে না দিয়ে জিএফআইকে দিলে ভালো করতেন। অর্থমন্ত্রী দাবি করছেন, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে
ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, এটা মোটেই পাচার নয়।

অর্থমন্ত্রীর কথা শুনে গর্বে আমার বুক ফুলে যায়, বাহ বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দারুণ শক্তিশালী ও গতিশীল। বিদেশের সাথে আমাদের লেনদেন বাড়ছে। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, কালো টাকা লুকিয়ে রাখার স্বর্গ সুইজারল্যান্ডের সাথেই
আমাদের ব্যাংকিং লেনদেন হঠাৎ এমন ফুলেফেপে উঠছে কেন? অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, কিছু অর্থ পাচার হয়, তবে সেটি অতি যৎসামান্য। এটা নজরে নেওয়ার মতোই নয়। অর্থমন্ত্রী অবশ্য সেই যৎসামান্য টাকার অঙ্কটা বলেননি। অবশ্য অর্থমন্ত্রীর কাছে হাজার কোটি টাকাও কিছুই না। তাই তার যৎসামান্যও আমাদের কল্পনার ক্যালকুলেটরে আটবে না।

ব্যাপারটা এমন নয় যে শুধু আওয়ামী লীগ আমলেই টাকা পাচার হয়। পাচারের ঐতিহ্য আমাদের অনেক পুরনো। এখন অর্থমন্ত্রী উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুজে, টাকা পাচার হয়নি বা যৎসামান্য হয়েছে বললেই কেউ তা বিশ্বাস করবে না। বরং যৎসামান্য হলেও কারা টাকা পাচার করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনলে, তাদের নাম সংসদে প্রকাশ করলে আমরা আশ্বস্ত হবো।

ভয়ঙ্কর চিকুনগুনিয়াকে স্বাস্থ্যমস্ত্রী সাধারণ ভাইরাস বললে, হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়াকে যৎসামান্য বললে, আমার খালি রবিঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার কথা মনে হয়। এও তো যৎসামান্য ক্ষতি!

 

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ