X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৃতীয় ধারার অপমৃত্যু!

আনিস আলমগীর
১৮ জুলাই ২০১৭, ১৪:০৬আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৭, ১৪:৪৬

আনিস আলমগীর তৃতীয় ধারার রাজনীতির কথা আবার মাঠে ফিরে এসেছে। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সময়ও তৃতীয় ধারার কথা এসেছিলো। তখন তৃতীয় ধারার অর্থ ছিল মাইনাস টু ফর্মুলা। অর্থাৎ রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনরা তৃতীয় ধারা কার্যকর করার জন্য একটা রাজনৈতিক দলও সৃষ্টি করেছিলেন। নেতা ছিলেন ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী। দলের নাম দিয়েছিলো পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, সংক্ষেপে পিডিপি। অফিস করেছিলো সেগুন বাগিচায়। দলের মার্কা নিয়েছিলো বাঘ। সারাদিন সেগুন বাগিচার অফিস লোকে লোকারণ্যে থাকতো। ‘গয়ারাম’দের ভীড়ে।
‘গয়ারাম’ শুনে আবার বিভ্রান্ত হবেন না। ভারতের রাজনীতিবিদ গয়ারাম নাকি ২৬ বার দলবদল করেছিলো। সেগুন বাগিচায় যারা ভীড় করেছিলো তারাতো প্রায় সবাই ‘গয়ারাম’। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বাঘে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে খেয়ে ফেলার আগেই দু’নেত্রী বাঘকে খেয়ে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। অর্থাৎ হাসিনা-খালেদা। তাদের কাছে ভেসে গেছে কোরেশীর পিডিপি। ভেসে গেছেন ড. ইউনূসও। এক এগারর কুশীলবরা তাকে মাঠে নামান কিন্তু মাঝপথে রণেভঙ্গে দিয়ে পালান তিনি। অঙ্কুরে মারা যায় তার দল ‘নাগরিক শক্তি’।
এক এগারো কালে সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন। অনেকে বলেন তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল তার উদ্যোগের প্রতি ভারতের আশীর্বাদ কামনা। ভারত আশীর্বাদ করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই ৭টি ঘোড়া দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলো। তারপর তারা সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ এখন দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।

সম্ভবতো ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব দলই তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বিএনপি জোট বিশেষ সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে। সেই ব্যবস্থা কী হবে- বেগম জিয়া লন্ডন থেকে ফিরে তার নাকি রূপরেখা দেবেন। এখন দেশে বিএনপির ২০ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টির জোট, আর আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোট বিদ্যমান। আসলে বিএনপি জোটে উল্লেখ করার মতো দল আছে বিএনপি আর জামায়াত। আর এরশাদের জাতীয় পার্টির জোটে উল্লেখ করার মতো কোনও দলই নেই। তবে সারাদেশে জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব বিদ্যমান। তারা ৩০০ আসনে নির্বাচন করতে সক্ষম।

আওয়ামী লীগ জোটে উল্লেখযোগ্য পার্টি আওয়ামী লীগই। তবে রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং হাসানুল হক ইনুর জাসদেরও সারাদেশে কম বেশি অস্তিত্ব আছে। এরশাদের রাজনৈতিক জীবনে হয়ত এটাই হবে শেষ নির্বাচন। তিনি যদি এ নির্বাচন নিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো খেল তামাশা করেন তবে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এরশাদ তার কথায় স্থির থাকতে পারেন না বলে দেশের লোক সহজে তার ওপর আস্থা রাখতে পারে না। না হয় তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় যাওয়ারও সুযোগ পেতেন হয়তো। কোনও সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনীতিতে এতোদিন টিকে থাকার নজির নেই।

এদিকে, তৃতীয় ধারার রাজনীতির কথা বলে গত ১৪ জুলাই জেএসডি প্রধান অ স ম রব তার উত্তারার বাসায় কিছু নেতার একটা বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। বিকল্পধারার সভাপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি সুব্রত রায় চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, বাসদের খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহামুদুর রহমান মান্না ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ এই বৈঠকে যোগদান করেছিলেন। বাসদের খালেকুজ্জামানের উপস্থিতিতে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। যা হোক, পত্রিকায় দেখলাম তারা ১৫ জুলাই বৃহত্তম বাম মোর্চা গঠনের জন্য বৈঠক করেছেন। এ বৈঠকে কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, বাসদ (এম), ওয়ার্কাস পার্টি (বিপ্লবী)সহ আরও কয়টি দল যোগদান করেছে। তারা আগামী ২৭ জুলাই ঢাকায় সমাবেশ করবে। কওমি ওলামারাও তাদের বিভিন্ন সংগঠন নিয়ে একটা মোর্চা গঠনের চেষ্টা করছেন।

তৃতীয় ধারার রাজনীতির সৃষ্টির লক্ষ্যে আ স ম রবের বাসায় যে বৈঠক হয়েছে জোট গঠন নিয়ে তা শেষ পর্যন্ত সফল হবে বলে মনে হয় না। কারণ রব আর মান্না ছাড়া আর কেউ হয়তো এ জোটে থাকবেন না। শুনেছি রব আর মান্নার গুরু কাপালিক সাধুর অবয়ব ও চরিত্রগুণের অধিকারী সিরাজুল আলম খান দাদাভাই ২০ দলের বাইরে যারা আছেন তাদেরকে দিয়ে একটা জোট গঠনের ঠিকাদারী নিয়েছেন- বিশ দলীয় জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করার জন্য। খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে নির্বাচকালীন সরকারের যে রূপরেখা নিয়ে আসবেন, সে রূপরেখার ভিত্তিতেই যুগপৎ আন্দোলন হবে। খালেদা জিয়া নাকি উভয় জোটের মাঝে সিট ভাগাভাগিরও প্রস্তাব দিয়েছেন।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের একমাত্র প্রার্থী কাদের সিদ্দিকী। তিনি ঋণখেলাপী। নির্বাচন করা তার পক্ষে কঠিন- যতই বলুক তিনি ঋণখেলাপী নন। দশ কোটি টাকা ২০ বছর ধরে তার কাছে পড়ে আছে তারপরও কোন আইনে বলবেন যে তিনি ঋণ খেলাপী নন! ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী আর ড. কামালের বয়স এখন ৮৪/৮৫ বছর। তারা দীঘির পাড়ের তাল গাছ। বন সৃষ্টির ক্ষমতা নেই।
তৃতীয় ধারা সৃষ্টির জন্য যে নেতারা একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা জনসাধারণের কাছে অতি পরিচিত মুখ। জেএসডির আ স ম রব সাহেব জাসদের প্রতিষ্ঠালগ্নে সেক্রেটারি ছিলেন। আওয়ামী লীগ ভেঙে যখন তারা জাসদ সৃষ্টি করেছিলেন তখন তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে আওয়ামী লীগের মেধাবী ও বিপ্লবী ৭৫ শতাংশ কর্মী নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন যখন গণজোয়ারে কিছু করতে পারেননি এখন জলশূন্য কলস নিয়ে কিছু করতে পারবেন তা রাজনৈতিক সচেতন মানুষ বিশ্বাস করবেন না।

অথচ ভগ্নদশা থেকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর, চার নেতার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, দুটি সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার পরও সুসংগঠিত হয়ে এ পর্যন্ত তিনবার ক্ষমতায় গিয়েছে। শেখ হাসিনা তার বাবার হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতে রবের ভূমিকা ছিল জেনেও অনুগ্রহ করে রবকেও একবার মন্ত্রী করেছেন। সম্ভবতো শেখ হাসিনার অনুরূপ অনুগ্রহ না পেলে রব তার জীবনে মন্ত্রী হতে পারতেন না। জোটে না থাকলে হাসানুল হক ইনুও মন্ত্রী হতে পারতেন না আর বেগম জিয়ার অনুগ্রহ না পেলে শাজাহান সিরাজ মন্ত্রী হতে পারতেন না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যর্থদের প্রতি খুব বেশি সাহানুভূতি দেখানোর রেওয়াজ নেই। ব্রিটিশ রাজ আলামেইনের যুদ্ধে বার বার পরাজিত হওয়ার পর ফিল্ডমার্শাল মন্টোগোমারিকে শেষবারের যুদ্ধে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি তখন বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরাজিত সৈনিকদেরকে আলামেইনে একত্রিত করেছিলেন আর বলেছিলেন তোমরা পরাজিত সৈনিক, আলামেইনের যুদ্ধে জিতে তোমাদেরকে আত্মগ্লানী থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। মনে রাখতে হবে যুদ্ধের নেতা ফিল্ড মার্শাল মন্টোগোমারি ছিলেন অপরাজেয় জেনারেল।

রাজনীতিতে দল আর জোট করতে গিয়ে রব সাহেব, বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাহেব, ড. কামাল সাহেব, মাহামুদুর রহমান মান্না সাহেব- তারা সবাই তো পরাজিত ও ব্যর্থ ‘জেনারেল’। সুতরাং তাদের নেতৃত্বে আলামেইনে জেতা যাবে না।

ফরাসি দেশে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নামের ৩৯ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে বললেন আপনারা আমাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করুন ফরাসি জাতিকে আমিই উদ্ধার করে আনবো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত ৭২ বছর যে দুটি বৃহৎ দল পালাক্রমে ফরাসি জাতিকে শাসন করে আসছিলো তারা তাদের কোনও প্রার্থী দিতেই সাহস করেনি। এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জিতে এসেছেন। তার পূর্বের কোনও সফলতা ব্যর্থতায় নেই। সাহসী আওয়াজই তাকে জিতিয়ে এনেছে। ফরাসি জাতি সাহসী আওয়াজকেই বিশ্বাস করেছে। ঠিক তেমনিভাবে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনাও প্রাচীন দুই দলকে পরাজিত করে জিতে এসেছেন।

১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় রুজভেল্ট বললেন, আমি মার্কিনিদেরকে উদ্ধার করতে পারবো। তার সাহসী আওয়াজকে মার্কিনিরা বিশ্বাস করলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। আর তিনি মার্কিনিদেরকে সত্যই মহামন্দার করালগ্রাস থেকে উদ্ধার করেছিলেন। চারবার মার্কিনিরা তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন প্রতিবন্ধী লোক। দুইহাতে দুই লাঠি নিয়ে হেলে দুলে হাঁটতেন। মার্কিন ইতিহাসে তিনিই দীর্ঘতম সময়ের প্রেসিডেন্ট। শেষবার তিনি মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মারা যান।

রব সাহেবেরা, যারা উত্তরায় একত্রিত হলেন তারা কবিগানের ঘোষক দল। তারা কবির আওয়াজকে জোরদার করার জন্য সব সময় মঞ্চে বলতে থাকেন ‘ভালো বেশ বেশ বেশ’। ঘোষক দল কখনও কবিয়াল হয় না।

আমি ভেবে অবাক হই যখন দেখি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির মঞ্চে ওঠে বক্তৃতা করছেন আর ইফতার পার্টিতে গিয়ে মঞ্চের নিচে রবের সঙ্গে বসে থাকেন। খালেদা জিয়া আর তারেক জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাকে নির্মমভাবে অপমানিত করে বঙ্গভবন থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। তার দোষ কী ছিল? বিএনপির রাজনীতিতে সম্ভবতো তিনিই অন্যতম সৎ, স্বচ্ছ ব্যক্তি ছিলেন।

আসলে যার আত্মমর্যাদাবোধ নেই তার অন্য যতই গুণই থাকুক না কেন রাজনীতিতে সেই ব্যক্তি আশ্রয়হীন লতার মতো দুর্দশাগ্রস্ত হয়েই দিন কাটায়। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অবস্থা হয়েছে এখন তাই। কর্মহীন বার্ধক্য বেদনাদায়ক। সেটাই যদি ড. কামাল ও ডা. চৌধুরীর হয়ে থাকে তবে তারা বসে বসে আপন জীবনীগ্রন্থ প্রণয়ন করতে পারেন। রব আর মান্নার ধোকায় পড়ে বহু তরুণ জীবনে লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে। ওনারা কেন শুধু শুধু আত্মমর্যাদা হারাচ্ছেন! এখন কি তাদের বয়স আছে টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেওয়ার!

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ