X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর: দুটো প্রশ্ন

চিররঞ্জন সরকার
১৯ জুলাই ২০১৭, ১৪:১৩আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৭, ১৪:২৯

চিররঞ্জন সরকার খবরটা শোনার পর থেকেই দুটো প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর মধ্যেই ফেসবুকে দেখলাম প্রবাসী সাংবাদিক সওগাত আলী সাগর প্রশ্ন দুটি তুলেছেন। প্রশ্ন দুটি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে। চিকিৎসার জন্য গত ১৫ জুলাই বেগম জিয়া লন্ডন গেছেন। বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, পা ও চোখের চিকিৎসা করাতেই তার এ সফর।
প্রথম প্রশ্নটি ‘চিকিৎসা’র জন্য বেগম জিয়ার ‘বিদেশ’ যাওয়া নিয়ে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি এই সফরের স্বচ্ছতা নিয়ে। প্রথমেই ‘চিকিৎসা’র জন্য ‘বিদেশ’ সফর নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। প্রশ্নটা অবশ্য শুধু বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেই নয়, চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া অন্যান্য নেতানেত্রীদের জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের দেশে টাকাওয়ালা ব্যক্তিরা সামান্য রোগ-ব্যাধির চিকিৎসার জন্যও বিদেশে ছুটে যান। এই তালিকায় রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরাও যখন নাম লেখান তখন তা খুবই দৃষ্টিকটূ এবং লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ষোলো কোটি মানুষের দেশে আমাদের নেতানেত্রীরাও অসুস্থ হবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হবে কেন? তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা কি দেশে নেই? আর বেগম জিয়ার চোখ ও হাঁটুর সমস্যা কি এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, দেশে এর চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল?
বিদেশে চিকিৎসা করানোর মধ্য দিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি নেতানেত্রীদের অনাস্থাই প্রকাশ পায়। বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়া মানেই হলো- দেশের চিকিৎসা নিরাময়যোগ্য নয়। অথচ আমরা জানি, আমাদের প্রিয় নেতানেত্রীরা যে সব রোগের চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যান, তাদের রোগগুলো মোটেও বিরল নয়। চোখ, কিডনি সমস্যা, হাঁটুর সমস্যা, হার্টের বাইপাস ইত্যাদি বয়সকালীন রোগগুলো দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষেরই রয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, তাদের অধিকাংশকেই এ ধরনের সমস্যায় ভুগতে দেখা দেয়। বর্তমানে এ ধরনের সমস্যার বা রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশেই হচ্ছে। দেশে চিকিৎসা করে অনেকে সুফলও পাচ্ছেন। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাসপাতাল-ক্লিনিকের চিকিৎসা-ব্যয়ও ইউরোপের যে কোনও দেশে চিকিৎসা-ব্যয়ের চেয়ে সাশ্রয়ী। সাধারণ মানুষ যদি দেশে চিকিৎসা করে সুস্থ হতে পারে, তাহলে নেতানেত্রীরা তা পারেন না কেন? আমাদের জাতীয় নেতানেত্রীরা দেশে চিকিৎসা করালে তো সাধারণ মানুষের চেয়ে আরো কয়েকগুণ ভালো চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব! কারণ নেতানেত্রীদের চিকিৎসকরাও গুরুত্ব দেন। তাদের সেবা করার সুযোগ পেলে দেশের অনেক চিকিৎকই বর্তে যান! কিন্তু তারপরও তারা চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটে যান কেন? তারা পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে সর্বাধুনিক চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ্ হয়ে দেশে ফিরে আসবেন, তারপর দেশের সাধারণ মানুষকে সস্তায় উন্নত চিকিৎসা প্রদানের স্বপ্ন দেখাবেন, এর চেয়ে বড় প্রহসন, প্রতারণা আর কি হতে পারে?
একথা ঠিক যে বিরল ও জটিল কিছু রোগের ক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়তো এখনও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছোয়নি। তাই বলে সাধারণ রোগ-ব্যাধির নিরাময় দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় হয় না-এটা মেনে নেওয়া কঠিন। গরিব মানুষের জন্য কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও আমাদের দেশেও ভালো মানের অনেক চিকিৎসাকেন্দ্র ও চিকিৎসক আছেন। আর তারা আছেন বলেই এখনও দলে দলে শবযাত্রা হয় না! আর যদি ধরেও নিই যে, দেশের চিকিৎসা সেবার মান খারাপ, তাহলেও প্রশ্ন জাগে, এই মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন? স্বাধীনতা অর্জনের চার যুগ পরেও কেন এমন একটি হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব হলো না যেখানে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, এমপি ও নেতানেত্রীরা উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন?

আমাদের নেতানেত্রীরা নিজেদেরকে ‘জনগণের সেবক’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিভিন্ন জনসভায়, উৎসব-অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পারলে চেঁচিয়ে গলার রগ ছিড়ে ফেলেন! অথচ সাধারণ মানুষকে ভালো চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে নিজেরা ঠিকই মানসম্মত চিকিৎসার জন্য উন্নত বিশ্বের হাসপাতালে ছুটে যান। এটা কোন ধরনের জনসেবা?

জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নিবেদিত এই সকল এই নেতানেত্রীরাই তো বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় ছিলেন। তারা কেন দেশে একটি উন্নত মানের হাসপাতাল তৈরি করতে পারেননি, যেখানে যে কোনও রোগের উন্নত চিকিৎসা হয়? দেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষ যাদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের অনিশ্চিত চিকিৎসার মুখে ফেলে, নিজেরা প্রচুর ব্যয় করে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সময় তাদের বিবেকে কী একটুও খচখচানি অনুভব হয় না? লজ্জা বোধ হয় না?

৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র বাংলাদেশে একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ৩২টি সরকারি ও ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১৮টি বিশেষায়িত চিকিৎসা ইনস্টিটিউট, ৬৪ জেলায় জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা, ইউনিয়নে ছোট বড় ৪ হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিদ্যমান। এইসব হাসপাতালে ৬০ হাজার নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন। দেশসেরা মেধাবীরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নের সুযোগ পান। প্রতিবছর স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় বাজেটের একটা বড় অংশ বরাদ্দ করা হয়। তারপরও কেনও আমাদের জাতীয় নেতানেত্রীরা এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে? যে দেশের নেতানেত্রীরা তাদের নিজেদের হাতে গড়া চিকিৎসা-ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখেন না, বিদেশে তাদের চিকিৎসার গ্রহণের ওপরে নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলা কি অযৌক্তিক হবে?

এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে। বেগম খালেদা জিয়া সত্যিই কি চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেছেন? নাকি নতুন কোনও ‘রাজনৈতিক বুঝ-পরামর্শের’ খোঁজে গেছেন? বিষয়টি বেগম জিয়া স্পষ্ট করেননি। একজন জাতীয় নেত্রী হিসেবে এতে তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। একজন নেতা বা নেত্রী নানা কারণে বিদেশ যেতে পারেন। অবকাশ কাটাতে যেতে পারেন, দলের তহবিল সংগ্রহ করতে যেতে পারেন, দলের মিটিং করতে যেতে পারেন। বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে তো সবচেয়ে বড় কারণ, তার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করা-সে জন্যও তিনি লন্ডন সফরে যেতে পারেন। এর কোনোটিই দোষের বা সমালোচনার যোগ্য নয়। কিন্তু আসল কারণ না বলে ‘চিকিৎসা’র কথা বলে বিদেশ যাওয়া কি শোভনীয়? জাতীয় নেতানেত্রীদের কাছ থেকে দেশের মানুষ সত্য কথাটা শুনতে চায়। কিন্তু সত্য গোপন করে কোনও খোড়া অজুহাতকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে সুষ্ঠু রাজনীতি করা যায় কিভাবে? এটা কি সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা নয়?

বেগম জিয়া যে শুধু চিকিৎসা করাতে বা ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লন্ডনে যাননি তা একই সময়ে বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার দেশ ছাড়ার ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। বেগম জিয়ার সফরসঙ্গি হয়ে লন্ডনে গেছেন তার একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার ও নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল। এছাড়া গত কয়েকদিনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ বেশ কয়েকজন নেতা লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান বেশ কয়েক বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ফলে চেয়ারপারসনের সঙ্গে তার এই সাক্ষাৎ যে শুধু মা ছেলের সাক্ষাৎ হবে না, বরঞ্চ দলের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দুই শীর্ষস্থানীয় নেতার শলাপরামর্শেরও ক্ষেত্র তৈরি করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রী বিদেশ যাবেন, সেখানে রাজনীতি, দলীয় নীতি-কৌশল-কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হবে-এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি বলতে পারত, হ্যাঁ, বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন গেছেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলে বিএনপির ভবিষ্যৎ রণনীতি ঠিক করতে, তাহলে কী সমস্যা হতো? এতে তো বরং বিএনপির স্বচ্ছতা ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকাই প্রকাশিত হতো। তা না করে এই ঢাক-গুড়-গুড় নীতি কেন? তাহলে কি ধরে নিতে হবে ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা যা বলছেন, ‘বেগম জিয়া লন্ডন গেছেন ষড়যন্ত্র করতে’-এটাই সত্যি? তা না হলে বেগম জিয়ার সফর নিয়ে বিএনপির এই অস্বচ্ছ অবস্থান কেন?

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ